আল্লামা মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান আলী শাহ্ (রহ.)

142

অনাদি অনন্তের মহা প্রভু আল্লাহ জাল্লাশানুহু আসমান-যমিন চন্দ্র সূর্য প্রাকৃতিক জাগতিক সমুদয় বস্তু তথা দৃশ্য-অদৃশ্য সব কিছুর শুধু তিনিই মালিক। তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং একমাত্র প্রতিনিধি মানব জাতিকে প্রেরণ পূর্বক তাদের সঠিক পথে অবিচল রাখার জন্য দুটি অলৌকিক শক্তি সৃষ্টি করেছেন। প্রথমটি হলো নবুয়্যত আর দ্বিতীয়টি হলো বেলায়ত। চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনীয়া বেতাগী ইউনিয়নে দরবারে বেতাগী আস্তানা শরীফের রাহবার আল্লামা হাফেয বজলুর রহমানের ঔরষে আল্লাহর পরিচয় দানপূর্বক ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তির জন্য হোদয়তের মশাল নিয়ে দুনিয়াতে তশরীফ আনেন পীরে ত্বরিকত কুতুবে যমান আল্লামা জিল্লুর রহমান আলী শাহ (রহ.)। মওলা আলী শেরে খোদা (রাদি.) খাজা গরীবে নেওয়াজের রূহানী তাওয়াজ্জোর কারনে তিনি মাদারজাত (মায়ের গর্ভ হতে অলি হয়ে আসাকে বলা হয় মাদারজাত অলি) অলি হয়ে দুনিয়াতে তশরীফ আনেন। শিশু বয়সে হুজুর কেবলার কাশ্ফ (অদৃশ্য জ্ঞানের) এর কারনে দাদা হযরত কেবলার নিকট যারা আসত,পথেই তাদেরকে তাদের সমস্যার সমাধান করে দিতেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে নিজ গ্রামে প্রাইমারি শিক্ষা সমাপন করেন।পরে কদলপুর হামিদিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্তের সাথে দাখিল পাস করেন। দাখিল পাস করে আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঁচলাইশ ওয়াজেদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন সেখানেই কোরান- হাদিস ফেকাহ ইত্যাদি বিষয়ে ভ্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি হাটহাজারী গুমানমর্দন নিবাসী খ্যাতিমান বুর্যুগ ওস্তাদুল আসাতেজা ফখরুল মুহাদ্দেসীন আল্লামা আবুল হায়াত মুহাম্মদ ওবাইদুল মুখতার (রহ.) ছাহেবের কন্যার সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদেঁর পবিত্র ঔরষে পাঁচ সন্তান ও তিন কন্যা দুনিয়াতে তশরীফ আনেন। সাংসারিক জীবনে হুজুর কেবলা শুরুতে কাপড়ের ব্যবসা করেছিলেন পরে সময়ের সল্পতায় তরিকতের আঞ্জাম দিতে গিয়ে ব্যবসা- বাণিজ্য ত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কঠিন রিয়াজত করেন। হুজুর কেবলা নির্লোভ ও নিরহংকার ছিলেন। তিনি কখনো তাঁর সেবা করুক সেটা পছন্দ করতেন না কখনো সেবা করার চেষ্টা করলে রাগাহ্নিত হয়ে যেতেন। তিনি সাইকেল আরোহন করে বিভিন্ন যায়গায় সফর করতেন। তিনি একজন বুর্যুগ সেটা যেন কেউ বুঝতে না পারে সেভাবে চলা ফেরা করতেন। তিনি সমাজ সেবায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। একসময় তিনি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদে নির্বাচিত হয়ে সমাজের বিভিন্ন উনয়নমুখী কাজের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং কিছু বাস্তবায়নে সক্ষমও হয়েছিলেন । স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপক্ষে দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য অসংখ্য খতমে খাজেগান, কোরআন খতম, মাহফিল করে দোয়া করতেন। দেশের স্বাধীনতা সর্বভৌম তথা দেশ জাতি মানবতার কল্যাণে তিনি সবসময় দোয়া করতেন। ধর্মীয় সেবা তথা দ্বীন,ধর্ম-মাজহাবের কল্যাণে কয়েকটি মাদ্রাসা, মসজিদ ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন- ধর্মপুর রহমানিয়া মাদ্রাসা, বেতাগী রহমানিয়া জামেউল মাদ্রাসা (পূনঃ স্থাপন), বেতাগী আস্তানা শরীফের মসজিদ, আস্তানা শরীফ, মুন্সিগঞ্জ ডুলিহাটা আইডিয়াল রহমানিয়া মাদ্রাসা এছাড়াও বেতাগী চম্পাতলি মসজিদ, পুকুর চম্পাতলি হাফেজ বজলুর রহমান ঈদগাহ ময়দান (সংস্কার)ইত্যাদি। তাঁর বহুমুখী সেবামূলক বিচরণ সম্পর্কে চট্টগ্রাম ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার প্রধান মুহাদ্দিস হযরত হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ সোলাইমান আনসারী (মা.জি.আ.) সাহেব বলেন, “তাঁর বেলায়তী শক্তির প্রভাবে অনেক গুণাহগার ব্যক্তি নেক্কার ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। দেশের অনেক অঞ্চলে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ও অনুরক্ত রয়েছে। তিনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে হযরত জিল্লুর রহমান আলী শাহ্ (রহ.) তাঁর বুযুর্গ পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজকে কামালিয়াতের উচ্চ স্তরে উন্নীত করেন। শরীয়ত ও তরীক্বতের প্রচার ও প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশেষতঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের একজন পুরোধা হিসেবে তিনি সর্বজন স্বীকৃত ছিলেন। একজন মানুষকে আপন করে নেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল ছিলেন। একজন সত্যিকার নায়েবে রাসূলের(দরুদ) পরিপূর্ণ গুণাবলী তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সহজ-সরল ও সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী। মেহমান আপ্যায়নে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। মেহমান বেশি আসলে তিনি অত্যাধিক খুশি হতেন। কোন সুন্নী আলেম তাঁর নিকট গেলে তিনি তাকে আন্তরিকভাবে অভিবাদন জানাতেন।এ মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ আধ্যাত্মিক সাধকের দরবারে অনেকবার আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি আমাকে পেয়ে সীমাহীন খুশি হতেন”। তাঁর সুমধুর ব্যবহার, আন্তরিকতা ও মেহমানদারিতে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তাঁর সান্নিধ্য থেকে আসতে আমার অত্যন্ত কষ্ট হতো। এছাড়াও হযরত অধ্যক্ষ সৈয়দ মোহাম্মদ নুরুল মোনাওয়ার (রহ.) ছাহেবকে হুজুর কেবলা জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হুযুরে পাকের উম্মতের মধ্যে যারা দ্বীনের ধারক ও বাহক, উনাদের স্থান যে কত ঊর্ধ্বে তা বর্ণনা করা অসম্ভব। হযরত জিল্লুর রহমান আলী শাহ (রহ.) এদের মধ্যে অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব। যিনি স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, ইলম-আমল, জাহের ও বাতেন সহ বহুগুণে গুণান্বিত বলে ইতিহাসে অ¤øান সত্তা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল”। আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয় তাঁরই সুযোগ্য পিতার থেকে পেয়েছিলেন। তাঁর বয়স যখন এগার বছর তখন তিনি খেলাফত পান। প্রসঙ্গতঃ ঐ দিন হযরত বজলুর রহমান রহ. ছাহেবে সবাইকে খেলাফত প্রদান করেন। দিনটি ছিল আট-ই ছফর এ ধারাবাহিকতা হুজুর কেবলা তাঁর পাঁচ পুত্রদেরও ঐ আটই ছফর খেলাফত প্রদান করেন বড় শাহজাদা হযরত মাওলানা গোলামুর রহমান আশরফ শাহ (ম.জি.আ.) ছাহেবেকে তাঁর স্থলাভিসিক্ত করে যান। আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে এত উচ্চ স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন যে. আল্লাহর দরবারে তিনি যা চাইতেন তা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যেতেন। আমি তাঁর ইশারাই বৃষ্টি বন্ধ হতে দেখেছি,এছাড়াও ভক্ত মুরিদানের সমস্যায় পতিত হলে তিনি সাহায্য করে সমাধান করে দিতেন। এ মহান সাধকের ওরছ শরীফ হাজার হাজার ভক্ত মুরিদানের উপস্থিতিতে তিনি কত উচুঁ স্তরের বুযুর্গ তা অনুধাবন করা যায়। আল্লাহপাক আমাদের তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইহ-পরকালের মুক্তির পথ সুগম হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক