আমাদের শিক্ষকরা ভালো নেই

33

 

শিক্ষক, এই নামটার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের শিক্ষা, জ্ঞান, আদব, চরিত্র এবং মানুষ হওয়ার সূচনা। শিক্ষক শব্দটার সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের সকলেরই কোনো না কোনো শিক্ষক আছেন। যারা যত বেশি জ্ঞান অর্জন করেন, তাদের তত বেশি শিক্ষক রয়েছে। শিক্ষাদানের মহান ব্রত নিয়ে যার কাজ করেন তাদেরকেই শিক্ষক বলা হয়। আমি তাদের বলি মানুষ গড়ার কারিগর। আজকাল এই মানুষগুলো ভালো নেই। বড্ড ভয়ে আছেন তাঁরা। কি অদ্ভুত তাই না! যাঁরা মানুষ গড়ার ব্রত নিয়ে জীবন পার করেন তাদের জীবনেও ভয়! তাহলে বলা যায় এই সমাজে অমানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মানুষ যাতে অমানুষ হতে পারে সেজন্যই শিক্ষকদের প্রতি এই লাঞ্ছনা, বাঞ্ছনা। আমাদের বাবা-মা’রা অনেক সময় যে কাজটা করতে পারে না, আমাদের শিক্ষকরা সেটা করে থাকেন। বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকদের স্থান হওয়ার কথা থাকলেও আজ শিক্ষকদের স্থান হচ্ছে লাঞ্ছনা, বাঞ্ছনায়।
আমি যদি কয়েকটি ঘটনার কথা বলি তাহলেই হয়তো বিষয়টি অনেকের কাছে আরও স্পষ্ট হবে। চলতি বছরের ১০ জুন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় এক স্কুল শিক্ষককে মারধর করেন একই উপজেলার ফুকুরহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জিয়া। মারধরের শিকার হওয়া ওই শিক্ষকের নাম আনোয়ার হোসেন। তিনি জান্না উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চলতি বছরেই আরও একটি ঘটনা ঘটে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজের এক শিক্ষককে মারধর করেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনান। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেছেন ওই শিক্ষক। চলতি বছরের ৩০ জুন বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। শিক্ষকের নাম সাজ্জাদ হোসেন। তিনি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। কলেজের অন্যান্য শিক্ষক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, ওইদিন বিকেলে আনোয়ারুল আজীম আনার (সংসদ সদস্য) হঠাৎ কলেজে ঢুকে অতর্কিত ভাবে শিক্ষক সাজ্জাদ হোসাইনকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। এরপর শিক্ষকদের কমন রুমে যান ওই সাংসদ। সেখানে প্রবেশ করে সবার উদ্দেশ্যে হুমকি-ধমকি দিয়ে চলে যান। একই রকম গত বছরের ১১ নভেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাঘাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে অফিস কক্ষে চার শিক্ষককে পিটিয়ে আহত করেন ইউপি সদস্য ও তার ছেলে। এসময় তারা স্কুলের বঙ্গবন্ধু কর্নারও ভাঙচুর করে। এই হামলার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে যে দেশের আনাচে-কানাচে আমাদের কত শিক্ষক হেনস্তার শিকার হচ্ছেন তার কোনো শেষ নেই। আমাদের সকলের কাছে এই বিষয়টা এতোদিন পরে উঠে আসার কারণ হচ্ছে ভাইরাল হওয়া। ভাইরাল না হলে আমরা এমন অনেক শিক্ষকের ঘটনা জানতাম না। বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে মামলা দেওয়া, হেনস্তা করা, বাড়ি-ঘর ভাংচুর করার ঘটনা আমরা সকলেই দেখেছি। কেউ প্রতিবাদ করেছি, কেউ নিরব থেকেছি। এরপর আসলো সাভারে হাজী ইউনুছ আলী কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। উৎপল স্যারের বিষয়টা বেশি আলোচনায় আসার কারণ তিনি মারা গিয়েছেন। তারই শিক্ষার্থী তাকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। এরপর এলোপাতাড়ি মারধর করে হত্যা করা হয়। একজন মেধাবী শিক্ষকের প্রাণ চলে গেলো নিমিষেই। অথচ এরপরেও টনক নড়েনি সরকারের। যদি টনকই নড়তো তাহলে পুলিশের সামনে হাজারও মানুষের সামনে নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষকে জুতার মালা গলায় পরিয়ে রাস্তায় হাঁটানো হতো না। ছাত্রীর কাছে হিরো সাজতে স্যারকে হত্যা করা, ক্লাসে বিজ্ঞান নিয়ে স্যারকে প্রশ্ন করে ভিডিও করা কিংবা সবার সামনে স্যারকে জুতার মালা পড়ানো আর নিরব তাকিয়ে থাকা পুলিশ আমাদেও কি বার্তা দেয়?
আমি শুরুতেই শিক্ষক পেটানোর কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছি। যার দুটো চলতি বছরেরই ঘটনা। অথচ অনেকেই জানেন না এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে। কারণ এই ঘটনাগুলো আলোচনায় আসেনি। এমন অনেক ঘটনায় আলোচনায় আসে না। এই না আসতে আসতেই এখন এটা হচ্ছে হরহামেশা। যার উদাহরণ নড়াইলের স্বপন কুমার, সাভারের উৎপল কুমার, বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডল। তবে এখানেই খটকা শেষ নয়। খেয়াল করলে দেখা যায়, সামপ্রতিক সময়ে হিন্দু শিক্ষকদের সাথেই এমন ঘটনা ঘটছে। এটা কি কাকতালিয় নাকি আরও একটি পরিকল্পনার অংশ সেটা হয়তো অনুসন্ধানেই জানা যাবে। এটুকু নিশ্চিত যে আমাদের শিক্ষকরা নিরাপদ নেই, ভালো নেই। আমাদের শিক্ষকদের উপর নির্যাতন, হেনস্তা, লাঞ্ছনা হয়ে আসছে আরও আগে থেকে। আপনারা হয়তো হৃদয় মন্ডলের ঘটনা জেনেছেন, জেনেছেন সভারের উৎপল কুমার সরকারের মুত্যুর ঘটনা সম্পর্কে। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া জুতার মালা পড়ানো শিক্ষক স্বপন কুমারের ঘটনাটাও জানেন সকলে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের সাথে ঘটে যাওয়া অজানা আরও অনেক ঘটনা আছে। তার কিছু ইন্টারনেটে পাবেন, কিছু হয়তো থানায় মামলার হিসেব দেখলে জানবেন। আরও কিছু হয়তো আড়ালেই রেখেছেন শিক্ষকরা। কারণ প্রকাশ্যে বলতে গেলেই বিপদ।
আমার এই লেখাটি শেষ করার আগে আমার নিজের এক শিক্ষককে পেটানোর দৃশ্য বলে যাই। কারণ আমার মৃত্যু হয়ে গেলে এই ঘটনাটিও অজানা থেকে যাবে অনেকের কাছে। আমার স্কুলের নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না। সেই স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। তার নাম বাবুল স্যার। তিনিও বিজ্ঞানের শিক্ষক। অংকটাই করাতেন বেশি। আমি তখন নবম শ্রেনীতে পড়তাম। সময়টা ২০১৩ কিংবা ১৪ ছিলো। একদিন দুপুরবেলা স্কুলে তখন ব্রেক দিয়েছিলো দুপুরের খাবারের জন্য। স্যার বাসায় গিয়ে হয়তো খেয়ে আসবেন। যেহেতু স্যারের বাসা কাছে। আমরাও যার যার মতো খেতে যাচ্ছি। একটু পরেই দেখি অনেক হই-হুল্লড হচ্ছে। মার.. মার.. আওয়াজ আসছে। দৌঁড়ে গিয়ে দেখলাম আমাদেরই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা স্যারকে মারছে। আমরা অনেক শিক্ষার্থীরা স্যারকে বাঁচানোর জন্য দৌঁড়ে গেলাম। অনেক শিক্ষার্থী স্যারের জন্য মারও খেয়েছে।
স্যার স্কুলের গেইট দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে, পেছন দিয়ে কয়েকজন সন্ত্রাসী দৌঁড়াচ্ছে। স্যারের শার্ট সম্পূর্ণ ছেড়া। এই দৃশ্যটি একবার আপনিও কল্পনা করে দেখুনতো আপনার প্রিয় কোনো শিক্ষককে নিয়ে। ভাবতেই অবাক লাগবে। গা শিউরে উঠবে। বাস্তবে এই অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ অস্বস্থিও দিয়েছে। স্যারকে বাঁচাতে গিয়ে আরও একজন স্যার হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন সেদিন। আমাদেরই কোনো এক শিক্ষার্থী সেদিন নিজের জামা খুলে স্যারকে পরিয়ে দেন। সেদিনের ওই সন্ত্রাসীরা যেকোনো একটি কারণে স্যারকে আক্রমণ করেছিলো। কিন্তু ভাবতেই অবাক লাগে তারা ওই শিক্ষকেরও ছাত্র ছিলেন। এরপর স্যার কয়েকদিন আর স্কুলে আসলেন না। প্রায় ১০/১৫ দিন পর স্যার আসলেন স্কুলে। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি স্যার স্বস্তি পাচ্ছেন না। আমাদেরও ক্লাস পেয়েছিলেন এর দুয়েকদিন পর। কিন্তু ক্লাসে সেই আগের বাবুল স্যারকে পাইনি। যে বাবুল স্যার পড়া না পারলে কান ধরিয়ে রাখতো, শাস্তি দিতো সেই স্যার যেন একদম সহজ মানুষ হয়ে গেলেন। আগের মতো বাড়ির-কাজ না করলে কিংবা অংক না পারলে অথবা পড়া না শিখলে স্যার কিছুই করেন না। স্যার যেন তখন সবাইকেই ভয় পাচ্ছিলেন। সেইসাথে লজ্জা যে পাচ্ছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আস্তে আস্তে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। পেয়েছেন সকলের সাপোর্ট। স্কুল থেকে ২০১৫ সালে আমিও চলে এলাম। জানিনা স্যার এখন কেমন আছেন! এখনও নিশ্চই স্যারের সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়লে বড্ড কষ্ট লাগে। এখনও সেই স্মৃতি হয়তো স্যারকে তাড়া করে বেড়ায়। এমনও শত শত ঘটনা আজকের বাংলাদেশে হচ্ছে। অথচ আমরা সেভাবে এইসব দিকগুলো দিয়ে ভাবিনি। কিন্তু পরম শ্রদ্ধার এই শিক্ষকদের নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে তাদের জীবন-যাপন নিয়ে। ভাবতে হবে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে। এই শিক্ষকরাই এই দেশের অন্যতম প্রধান কারিগর। আজেকর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, পুলিশ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীদেরও শিক্ষক আছেন। তারাও কারো না কারো কাছে শিক্ষা লাভ করে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। তাই শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান যেমন তাদের দিতে হবে, ঠিক তেমনি তাদের উপর অত্যাচার, অন্যায়, লাঞ্ছনা বন্ধ করতে হবে। কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে এসকল অপরাধীদের। তবেই শিক্ষকদের দিকে আঙ্গুল তুলে তাকাতে পারবে না কেউ। প্রশাসন, সরকার যেন এই শিক্ষকদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে তড়িৎ পদক্ষেপ নেয় সেই কামনা করছি।
লেখক: সাংবাদিক- কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক