আপনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন ?

138

আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন আছে। কোন ব্যক্তি নিজের চেষ্টা ও উদ্যোগ খাটিয়ে যদি ধনী হয়, সমৃদ্ধি অর্জন করে, আমরা তাকে সফল ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলব। কোন গরিব-ধনী হলে, লোকে তাকে হিরো বলে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি কাভার্ড ভ্যান থেকে মাল চুরি করে কিংবা সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বড় লোক হয়, আমরা তাকে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলব? কোন সরকারি অফিসার যদি ঘুষ খেয়ে গাড়ি বাড়ি করে আমরা তাকে সৌভাগ্যবান বলব? আমরা তা বলতে পারি না। কারণ দুর্নীতি খুব অন্যায় কাজ। দুর্নীতি যে মাত্রার হোক না কেন, দুর্নীতি বড় অপরাধ। যে বা যারা দুর্নীতি করুক না কেন- দুর্নীতি শাস্তিযোগ্য। কোন সমাজ বা কোন রাষ্ট্র বরবাদ হয়ে যেতে পারে, যদি সে রাষ্ট্র বা সমাজ- অনৈতিক পন্থায় টাকা কামানোকে, অবৈধ পথে সমৃদ্ধি অর্জন, প্রবৃদ্ধি অর্জনকে নিজের লক্ষ্য বানিয়ে নেয়। যদি কোন রাষ্ট্র দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়- সেটা দুর্ভাগ্যজনক। মোস্ট আন ওয়ান্টেড। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বলুন, কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমন করাকে কি আপনি আবশ্যকীয় কাজ মনে করেন? যদি আবশ্যকীয় মনে করেন, তবে আপনি সোচ্চার হোন। আপনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন ? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ অবশ্যই তার ওয়াদা পূরণ করবে। আওয়ামী লীগ নিজ দলের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করবে। চতুর্থবার শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি সরকারের নিট এন্ড ক্লিননেসের একটি বার্তা। আমি সরকারি সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থার যেটুকু তৎপরতা লক্ষ্য করছি, তাতে মনে হচ্ছে- এই সরকার দুর্নীতি ঠেকাবে। এখন যারা দুর্নীতি করে তারা লজ্জাও পায় না। অনেকে লুকিয়ে ঘুষ খায় না। আমাদের সমাজ এতই ভীরু প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছে যে, দুর্নীতিবাজ এখন সমাজে সম্মানিত হয়। দুর্নীতিবাজ রাজাকারের মতোই ভয়াবহ। কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি দুর্নীতিতে ধরা পড়ে সে আর মুক্তিযোদ্ধা থাকে না। কেন আমাদের পরিবার ও সমাজ দুর্নীতিবাজকে খারাপ চোখে দেখে না ? আপনার দুর্নীতিবাজ আত্মীয় প্রচুর দান খয়রাত করে। আপনি তার আতিথেয়তা নেন কেন? যে সরকারি কর্মকর্তা সৎ, যে নির্বাহী দুর্নীতি করেন না, সে সমাজে অপাংক্তেয়। তার বৌ ছেলে মেয়ে তাকে হেলাফেলা করে। সৎ অফিসারদের শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। কপালে জোটে জ্বালা। তারা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মতো আত্মীয়-স্বজন পাড়া পড়শীকে দিতে পারেনা, খাওয়াতে পারে না। দুর্নীতিবাজকে আপনারা জনগণ ঘৃণা করেন না কেন ?
দুর্নীতি নাই কোথায়। আমেরিকা, লন্ডনে দুর্নীতি নাই ? চীন, ভারতে দুর্নীতি নাই? আমেরিকা বা লন্ডনে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ভোগবাদী সমাজ সম্প্রসারিত হচ্ছে। পণ্যের অতি ব্যবহার হচ্ছে। অতি বিজ্ঞাপন হচ্ছে। পণ্যের অপব্যবহার হচ্ছে। পন্যে বিষক্রিয়া বাড়ছে। ফরমালিন, নানা কেমিক্যাল, রেডিয়েশনসমৃদ্ধ পণ্য বাজারে আসছে। তারা নিজের দেশ নয় গোটা বিশ্বকে এমন যায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যে- ধ্বংসের প্রকোপ থেকে ফেরা যাবে না। এই কাজগুলি হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। খাদ্যপণ্য বিষাক্ত হওয়া, দূষিত পণ্য বাজারজাত করা, এসব কাজ বড় মাপের দুর্নীতির দ্বারা সম্ভব। এসব করার জন্য ঘুষ, উৎকোচের ব্যবহার চলে। দেশে মন্ত্রণালয় বা সংস্থাগুলি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কেন জিরো করাপশন নীতি গ্রহণ করছে না?
নব্য উদার অর্থনীতিতে মানুষ অর্থের পেছনে ছুটছে। কেবল অর্থ আর অর্থ। ছুটতে ছুটতে মানুষ ক্রমাগত একা হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের বন্ধন, পারস্পরিক সম্পর্ক ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে বিলীন হয়ে গেছে। এই নিষ্ঠুর নিঃসংগতার পেছনে কি আছে? তুমি যত দুর্নীতি করবা, দুর্নীতি করে ধনী হইবা, তত তুমি স্বস্তি হারাবে, নিষ্ঠুর নিয়তি তোমার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বুঝতে পারছ, কেন তোমার মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বাড়ছে ? কেন, বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি চাও ? তাহলে দুর্নীতি ছাড়। সৎ হও। সমাজকে দুর্নীতি প্রবণ হতে দিও না। দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ জড়ো করতে করতে এক সময় তোমার মনে হবে, এসব কেন করলাম ? কার জন্য করলাম ? কেন মানুষকে ঠকালাম? কেন রাতে আমার ঘুম হয় না ?
একটা খারাপ বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদ এখনো অনেক শক্তিশালী। সে দুর্নীতির পোনা লালন পালন করে। আমরা এই অবস্থার শিকার। ১৭৫৭ সালে আমরা ইংরেজের পদানত হয়েছি। এখনো আমরা ইংরেজ-মার্কিনীদের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দাসত্বে আছি। উগ্রপুঁজিবাদ-পরিবেশবাদীদেরকে সহ্য করতে পারে না। দুর্নীতি বিরোধিতাকে তারা অপরাধ হিসাবে দেখাতে চায়। পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভকেও অপরাধ বলে পুঁজিবাদীরা মনে করে। তাদের মতে এক টাকার মাল বাজারে দশ টাকা বিক্রি করা জায়েজ। দুর্নীতিবাজরা গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে অস্থির, দুর্নীতি-প্রবণ সমাজকে ভাঙতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজের গলা টিপে ধরতে হবে। এই কাজ করার সাহস ও শক্তি আওয়ামী লীগের আছে। আপনারা আওয়ামী লীগকে সাহস যোগান। দলের দুর্নীতিবাজকে ঠেকাতে বলেন।
বেলেন ফার্নান্দেজ একজন মার্কিন লেখক, তিনি তার এক প্রবন্ধে তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, বেশ কয়েক বছর আমি ও আমার এক বন্ধু ভেনেজুয়েলায় ছিলাম। সেখানে হুগো চ্যাভেজের প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকগুলিতে আমরা বিনামূল্যে যে চিকিৎসাসেবা নিয়েছি, তা ভুলবার নয়। (চ্যাভেজকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চির শত্রু বলে- আমেরিকান মিডিয়া প্রচারণা চালায়।) আমি বেলেন ফার্নান্দেজ এর আর্টিকেল এইটুকু পড়ার পর আমার মনে হল, কিউবা, ভেনেজুয়েলায় এত মানবতাবাদী কার্যক্রম আছে- তা তো দুর্নীতিবাজ মার্কিনী প্রচার প্রক্রিয়ার বদৌলতে আমাদের কানেই আসতো না ? দুর্নীতিহীন সমাজ কি দুনিয়াতে থাকতে পারে না ? এসব খবর তো বিশ্ব মিডিয়াতে বø্যাক আউট হয়ে থাকে ? পুঁজিবাদের ধ্বজাধারী আমেরিকা কি করে ? সে কর্পোরেট স্ক্যান্ডাল নির্মোহভাবে হ্যান্ডেল করে না। পানামা পেপারস বা এ ধরনে ইনভেস্টিগেশন আমাদেরকে কর্পোরেট দুর্নীতির এক অবিশ্বাস্য আগ্রাসনের কথা বলে। বিশ্বের অনেক সরকার প্রধান দুর্নীতিবাজ। যার বেশি আছে, সেই সব খেতে চাচ্ছে। দুর্নীতি এক দৈত্য। সে হাংগরের মতো হা করে থাকে। তার তলাবিহীন উদরে সব ঢুকে যাচ্ছে। আমেরিকা যুদ্ধ বাঁধানো এবং কর্পোরেট মুনাফা অর্জনের পেছনে এত বেশি সময় দেয় যে, মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে মাথা ঘামানো এবং সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন করার ব্যাপারে সে সময় পায় না।
বেলেন ফার্নান্দেজ লিখেছেন, ভেনেজুয়েলার একটি ক্লিনিকের একজন নারী চিকিৎসক আমাকে বলেছিলেন, বিশ্বের যেখানে যুদ্ধ- দেখবেন সেখানে মার্কিন সৈন্য এবং তাদের সেনাবাহিনী। সেখানে মার্কিন গোয়েন্দাদের দেখা পাওয়া যাবে। আর সেসব যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গায় কিউবার লোকও থাকে। তবে তারা সেনা নন, তারা চিকিৎসক। (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ৮/১/১৯)।
সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যে চীন শীর্ষ হলেও, এখন চীনেও দুর্নীতি হয়। গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে নেতৃস্থানীয় হলেও ভারতেও দুর্নীতি হয়। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং কে চীনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সি চীনের প্রেসিডেন্ট পুনঃ নির্বাচিত হন। তখন তার মূল সেøাগান ছিল, দুর্নীতি হঠাও। চীনের ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টির কয়েক হাজার কর্মীকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চীনের নতুন পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারাকে এখন বলা হচ্ছে ‘ক্রোনী ক্যাপিটেলইজম’। বাংলায় বলা যায়, ‘স্বজনতোষী পুঁজিবাদ।’ মিন ঝিন পি- মার্কিন প্রবাসী চীনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। মিন এই ব্যবস্থার বিষয়ে উনার মতামত দিয়েছেন। এই ক্রোনী ক্যাপিটেলইজমের আওতায় কি হয়? কি করে কিছু মুখ চেনা মানুষ কোটিপতি, বিলিওনিয়র হয় ? এখানে রাষ্ট্রের কর্মচারী দালাল, রাজনৈতিক নেতারা সবাই মিলে মিশে দুর্নীতির পর দুর্নীতি করে। এই দুর্নীতি হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। সবাই কম বেশি এর ভাগ পায়। আগে ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘুষ খাওয়ার যুগ। তখন অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়াও সরকারি কার্যালয়ে কাজ করানো যেত। এখন সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এখন সিন্ডিকেটের দ্বারস্থ হতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ার এটি একটি কারণ। সাধারণ মানুষের ব্যয়ও বেড়ে গেছে। (প্রতীক বর্ধন দৈনিক প্রথম আলো ৮/১/১৯)।
এ ধরনের যোগসাজশ মূলক দুর্নীতি- ব্যক্তিগত দুর্নীতির চাইতেও ধ্বংসাত্মক। এতে রাষ্ট্রের সাংগঠনিক ও নিয়মতান্ত্রিক রূপ ধ্বংস হয়ে যায়। এই ধরনের দুর্নীতি চিহ্নিত করা কঠিন হয়। এতে ঘুষখোরদের লাভ বেশি। অনেকে ধরে নেয় সরকারি কার্যালয়ে কাজ করলে অফিস খরচ দেওয়া লাগে। ঘুষ এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। এই মনোভাব ভাল নয়।
‘চায়নাস ক্রোনী ক্যাপিটেলইজম’ বইটির উপর প্রতীক বর্ধনের একটি নিবন্ধ দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম ‘ক্রোনী ক্যাপিটেইজম‘ এবং ‘পুঁজি লুণ্ঠন’ বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক আজাদীতে প্রবন্ধ লিখেছেন। এসব পড়ে দুর্নীতির গভীরতার একটা ধারনা নেয়া যায়। মিনঝিন পি’র ‘চায়নাস ক্রোনী ক্যাপিটেইজমের’ ‘ইন দি বেড উইথ দ্যা মাফিয়া’ চ্যাপ্টারে লেখা হয়েছে, ওই সংঘবদ্ধ অপরাধ, তার যেমন স্থানীয় সরকারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব আছে, তেমনি সংগঠিত অপরাধীচক্র ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের মধ্যেও যোগসাজশ থাকতে পারে। মিন লিখেছেন, এর কারণে চীনা রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলাজনিত ও প্রশাসনিক সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
অনেকে বলেন, স্বল্প মাত্রার দুর্নীতি প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হতে পারে। কিন্তু মাত্রা ছাড়ালে তা আর প্রবৃদ্ধির সহায়ক থাকেনা। আমি এই প্রচারণার বিরোধী। দুর্নীতি যে কোন মাত্রায় হোক তা থামাতে হবে। অনেকে বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। যদি নতুন সরকার বাংলাদেশে যেকোন স্তরের দুর্নীতি মোকাবেলা করার পদক্ষেপ নেয়- তাহলে জনগণ নির্বাচন নিয়ে প্রচারণার ফাঁদে পা দিবে না। জনগণ চায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ। এই নতুন সরকার যদি তা দিতে পারে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে লাভ হবে না। দুর্নীতি কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয় আমেরিকা, চীনেরও সমস্যা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দুর্নীতিবাজদের দমন করবেন বলে আশা রাখি। তরুণরা বলুন, আপনারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন ?

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
ঊ-সধরষ: ভধুষঁষযড়য়ঁবথ৭@ুধযড়ড়.পড়স