আদালতপাড়ায় প্রতারণার ফাঁদ

51

এ যেন আসলের ছায়ায় নকলের ঘর-বসতি! আদালতপাড়ায় প্রতারণার ফাঁদ পেতে আছে সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র। এসব চক্র বিচারকের স্বাক্ষর ও সিলমোহর জাল করে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কিংবা জামিননামা থেকে শুরু করে মামলার কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কপিও সরবরাহ করছে। প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলে হয়রানি করতে একশ্রেণিীর মানুষ এসব প্রতারকচক্রের শরণাপন্ন হচ্ছে। আদালতের জারি করা প্রকৃত পরোয়ানা কিংবা আদেশের সাথে প্রতারকচক্রের তৈরি ভুয়া কাগজপত্রের প্রায় হুবহু মিল থাকায় কার্যকরের আগে তা থানা পুলিশেরও নজরে আসছে না।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা আদালতে ধরা পড়ার পর জড়িতদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও প্রতারকচক্রের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত জুন ও জুলাই মাসে একাধিক ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় নিরাপরাধ কয়েকজনের হাজতবাসের ঘটনা নজরে আসলে মূখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) তদন্ত করে এ কাজে জড়িত প্রতারকচক্রকে শনাক্তের জন্য নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, গত দু’মাসে মহানগর হাকিম আদালতে ভুয়া পরোয়ানায় নিরাপরাধ ব্যক্তির হাজতবাসের অন্তত নয়টি ঘটনা ধরা পড়ে। এরপর সিএমএম মোহাম্মদ ওসমান গণি গত ২৮ জুলাই ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তৈরির সাথে জড়িত প্রতারকচক্রকে শনাক্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারক আদেশে উল্লেখ করেন, কোনও মামলা না থাকলেও ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আদালতের স্বাক্ষর ও সিলমোহর জাল করে প্রতারকচক্র এটি করেছে। এতে নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। কোর্ট পুলিশ বলছে, প্রতারকচক্রকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আইয়ুব খান পূর্বদেশকে বলেন, যারা যেখানে বসে এ ধরনের অপকর্ম করুক না কেন, এতে হয়রানির শিকার হচ্ছে নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আদালতের ভাবমূর্তি। তাই বিচারালয়ের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা অটুট রাখতে প্রতারকচক্রকে শনাক্ত করা জরুরি। এক্ষেত্রে তদন্তে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি প্রতারণার সাথে জড়িত কিনা সেটাই হল বিবেচ্য। তিনি আদালতের ভেতরের নাকি বাইরের সেটা গৌণ বিষয়। তদন্তে সংশ্লিষ্টতার সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে যে কারও বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
কয়েকটি ভুয়া পরোয়ানার অনুলিপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্মারক নম্বর থেকে শুরু করে বিচারকের স্বাক্ষর ও সীলমোহরসহ প্রায় সবই আসলের মতই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, কোনোটিতে যে মামলা নম্বর দেয়া হয়েছে, ওই নম্বরে আসলে আদালতে কোনো মামলাই নেই। আবার কোনোটিতে যে আদালতের কথা বলা হয়েছে, সে আদালতের বাস্তবে কোনও অস্তিত্বই নেই। কিন্তু পরোয়ানামূলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করেছে। আদালতও ওই ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে ভুয়া পরোয়ানার বিষয়টি আদালতের নজরে আনার পর নিরাপরাধ ব্যক্তিকে মুক্তির আদেশও দিয়েছেন বিচারক।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আইনজীবী জানান, এ ধরনের প্রতারকচক্রের সহযোগী হিসেবে সন্দেহের তালিকায় কোনো কোনো আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারি কিংবা কোর্ট পুলিশের সদস্যও থাকতে পারে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করলে চক্রের প্রত্যেক সদস্যকে শনাক্ত করা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু শনাক্ত করে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে এমন প্রতারণা ঘটতেই থাকবে। আর তাতে নিরাপরাধ মানুষই হয়রানির শিকার হবে।
আদালতের সাথে প্রতারণা ঃ এর আগে চলতি বছরের গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ৬ মার্চ এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদালতে পরপর দুটি চাঞ্চল্যকর প্রতারণার ঘটনা ধরা পড়ে। এরপর গত ৭ মার্চ মূখ্য মহানগর হাকিম মো. ওসমান গণি জামিন শুনানিতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সত্যায়ন করা আসামির জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্টের অনুলিপি জমা দিতে নির্দেশ দিয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করেন। এতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি মামলায় আত্মসমর্পণের আসামির জামিন শুনানির ক্ষেত্রে মূল আসামির পরিবর্তে ভিন্ন ব্যক্তিকে উপস্থাপন করার বিষয়টি বিভিন্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটগণের নজরে এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে এক আসামির পরিবর্তে অন্য আসামির কারাভোগের ঘটনাও ঘটেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি মামলাও দায়ের হয়েছে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ও বিপজ্জনক প্রবণতা বন্ধে আত্মসমর্পণকৃত সকল আসামির জামিন শুনানির ক্ষেত্রে প্রকৃত আসামি নিশ্চিত করা আবশ্যক। এ কারণে আত্মসমর্পণকৃত আসামির জামিন শুনানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সত্যায়নকৃত আসামির জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পাসপোর্টের অনুলিপি দরখাস্তের সাথে গ্রহণ করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটগণকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। গত ১৮ মার্চ থেকে ওই অফিস আদেশ কার্যকর করা হয়।
চলতি বছরের গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চেক প্রতারণা মামলায় ছয় মাসের কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামি আনোয়ারার বাসিন্দা মোজাম্মেল হক নিজে আত্মসমর্পণ না করে মহানগর হাকিম আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে নিকটাত্মীয় দিদারুল আলমকে হাজির করান। নিজে আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিতেই সবকিছু ফাঁস হয়ে যায়। এই ঘটনায় আদালতের বেঞ্চ সহকারী বখতিয়ার উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। পরে মোজাম্মেল ও দিদার দুজনকেই আদালতের নির্দেশে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর গত ৬ মার্চ একই আদালতে একটি চেক প্রত্যাখ্যানের মামলার আসামি ওয়াহিদুল হক নিজে আত্মসমর্পণ না করে সৈয়দ করিম নামের এক ব্যক্তিকে হাজির করে আত্মসমর্পণ করান। বিচারকের সন্দেহ হলে তিনি আসামি হিসেবে হাজির করা ব্যক্তির কাছে অনবরত কয়েক দফায় নিজের নাম, পিতার নাম ও মায়ের নাম জানতে চান। এতে আসামি ঘাবড়ে যান। এরপর বিচারক তার স্বাক্ষর নিয়ে নথিতে থাকা চেকের স্বাক্ষরের সঙ্গে গরমিল দেখতে পান। অতঃপর সৈয়দ করিম নিজেই মূল আসামি ওয়াহিদুল হকের পরিবর্তে নিজে হাজির হওয়ার কথা স্বীকার করেন। এই ঘটনায়ও থানায় মামলা করা হয়।