অস্থির বাজারে সব পণ্যের দামই বাড়তি

28

মনিরুল ইসলাম মুন্না

‘পাঁচদিন পর রোজা। জিনিসপত্রের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন ভাত-আলু আর সবজির দুইটা পাতা দিয়ে রান্না করে কোনোমতে চলে। শেষ কবে মাছ-মাংস খেয়েছি, ভুলে গেছি। সারা বছর হয়তো একপেট-আধাপেট খেয়ে থাকা যায়, কিন্তু রোজার মাসে তো একটু-আধটু ভালো খেতে চাই। অথচ আমাদের মত গরিবের জন্য রোজার মাসেও কোনো উন্নতি নেই। তবে বাজারে কোন কিছুর কমতি আছে, তা কিন্তু নয়। সব পণ্যই আগের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দামটা ধরাছোঁয়ার বাইরে।’
দুঃখের সাথে এসব কথা বলেন মো. তৌহিদুল ইসলাম। তিনি জীবিকার উদ্দেশ্যে গত বছর নগরীতে আসেন। কাজ করেন টেরিবাজারের একটি দোকানে। গত বছর রমজানের আগেও তার বাজার করতে কোন সমস্যা হয়নি। পণ্য কম থাকলেও দাম ছিল তুলনামূলক হাতের নাগালে। কিন্তু চলতি বছর রমজানের আগে বাজারে পণ্যে সয়লাব থাকলেও কিনতে পারছেন না তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের যত কষ্ট, একবেলা খাবার জোগাড় করতে জীবন শেষ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দেখি সরকারি ট্রাকে চাল-ডাল বিক্রি হয় কম দামে। তবে এত লম্বা লাইন পড়ে যে, পাঁচ কেজি চাল কিনতে গেলে পুরো দিনই কাজ বন্ধ রাখতে হয়।’
শুধু তৌহিদুল নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় কর্মসংস্থানও বাড়েনি। অনেক স্থানে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। অনেকের বেতন-ভাতা অনিয়মিত হয়েছে। করোনার পর থেকে প্রায় তিন বছরে বেতন বাড়েনি অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর। অনেকেই আগের বেতনেই কাজ করছেন। ওই সময়ে পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি বাদ দিলে প্রায় সবারই আয় কমেছে। এর মধ্যে খন্ডকালীন ও মৌসুমি কাজের মানুষের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় ধরে রাখা যায়নি। বৈশ্বিক নানা কারণে ১০ শতাংশ দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা লাভের জন্য ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ ক্রেতা সাধারণের।
গতকাল নগরীর খাতুনগঞ্জ আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, পবিত্র রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে পণ্য তুলে রেখেছেন আড়তদাররা। রোজা ঘনিয়ে আসলেও এখনও বেশিরভাগ আড়ত পণ্যে ভর্তি। এছাড়াও কিছু কিছু আমদানিকারকের পণ্য এখনও আসছে। তবে পাইকারি ক্রেতার সংখ্যা অনেকটা কম দেখা যায়।

রমজানি পণ্যের দাম বাড়তি
রমজান মাসে ইফতারে ছোলা খাওয়া হয় বেশি। ব্যবসায়ীরাও মূলত রোজার আগে ছোলা-ডাল আমদানি করে থাকেন। খুচরা বাজারে এখন ভালো মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০ টাকায়। আর দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গতকাল ছোলা বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৮০ টাকায়। এ পাইকারি বাজারে গত বছর (২০২২ সালে) ছোলা ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে। মটর ডাল গত বছর ছিল ৪৮ টাকা বর্তমানে তা ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খেসারি ডাল গত বছর ভারত থেকে আমদানি কম হওয়ায় দাম ছিল বেশি, তবে এ বছর দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা কমে পাইকারিতে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং খুচরায় ৮৫ টাকা। মুগডাল গত বছর বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকায়, বর্তমানে পাইকারিতে ৮১ টাকা এবং খুচরায় ১২৫ টাকা। মসুর ডাল (মোটা) গত বছর বিক্রি হয়েছে ৯৫ টাকায়, বর্তমানে পাইকারিতে ৮৮ টাকা এবং খুচরায় ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে পেঁয়াজ পাইকারিতে ২৫ থেকে ২৮ টাকা ও খুচরায় ৩৫ টাকা, চিড়া পাইকারিতে ৫০ টাকা ও খুচরায় ৫৫ টাকা, আলু বোখরা পাইকারিতে কেজি ৪২০ টাকা ও খুচরায় ৫০০ টাকা, কিসমিস পাইকারিতে ৩৯০ টাকা ও খুচরায় ৪৫০ টাকা, জিরা পাইকারিতে ৫৯০ টাকা ও খুচরায় ৬৩০ টাকা, লবঙ্গ পাইকারিতে ১৩৪০ টাকা ও খুচরায় ১৪২০ টাকা, দারচিনি পাইকারিতে ৪১০ টাকা ও খুচরায় ৪৫০ টাকা, এলাচি পাইকারিতে ১৩৮০ টাকা ও খুচরায় ১৬০০ টাকা, চিনি পাইকারিতে ১০৯ টাকা ও খুচরায় ১১২ টাকা, মিয়ানমারের আদা পাইকারিতে ৭৫ টাকা ও খুচরায় ৯০ টাকা, রসুন পাইকারিতে ১১০ টাকা ও খুচরায় ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্যের দাম ১০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে আমদানিকারকরা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সারাবিশ্বে। এর কারণ হিসেবে বিদেশে যেসব পণ্যের বুকিং রেট বেড়েছে সেগুলোর দাম শুধু বাংলাদেশে নয় পুরো বিশ্বে বেড়ে যায়। এছাড়াও আমদানিকৃত পণ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় শিপমেন্ট খরচ, কন্টেইনার খরচ এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় পুরো বাজারে প্রভাব পড়েছে।
খাতুনগঞ্জ ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণপত্র সংকটে খাদ্যপণ্য আমদানি কয়েক মাস ধরে কমছিল। এ পরিস্থিতিতে জানুয়ারি মাসে রোজার পণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র খোলায় নির্দেশনা দেয় সরকার। এ নির্দেশনায় কাজ হয়। ঋণপত্র খুলতে পারেন ব্যবসায়ীরা। তাতে ফেব্রুয়ারি থেকে আমদানি কিছুটা বাড়তে থাকে। কমতে থাকে ঘাটতিও।
ব্যবসায়ী ও কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, বাজারে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দামই বাড়তি। জীবনযাপনের খরচও বেড়ে গেছে। তাতে বাড়তি ব্যয়ের চাপে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রোজাকে কেন্দ্র করে আগে শবে বরাতের পর থেকে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হতো। এবার বাজারে এখন পর্যন্ত সেই চাপ নেই। আবার মাসের শেষ দিকে রোজা শুরু হওয়ায় কেনাকাটার চাপ কম থাকতে পারে বলেও কেউ কেউ ধারণা করছেন।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত পণ্য রয়েছে। কিন্তু বিপরীতে ক্রেতা কমেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ক্রেতার সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমলো।’

পাইকারিতে কমছে ভোজ্যতেলের দাম
রমজানে ভাজা-পোড়ার চাহিদা বেশি থাকায় ভোজ্যতেলের চাহিদাও রয়েছে বেশ। তবে গত বছরের তুলনায় এবছর পাইকারি পর্যায়ে কমেছে ভোজ্যতেলের দাম। খাতুনগঞ্জ বাজারে প্রতিমণ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৪০০ টাকায় (কেজিতে ১৭১ টাকা), যা গতবছর বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকায় (কেজিতে ১৮২ টাকা)। বর্তমানে তা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৭২ থেকে ১৭৫ টাকায়। পাম তেল বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৪ হাজার ৮২০ টাকা (কেজিতে ১২৯.১৫ টাকা) যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল প্রতিমণ ৫ হাজার ৬০০ টাকা (কেজিতে ১৫০ টাকা), বর্তমানে তা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। সুপার পাম বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৯৬০ টাকা (কেজিতে ১৩৩ টাকা), যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল প্রতিমন ৬ হাজার টাকা (কেজিতে ১৬০ টাকা), বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জ পিএন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারি এমদাদুল হক রায়হান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমায় দেশিয় বাজারেও কমে এসেছে। এছাড়া ডলারের দাম কমলে আরও কমে আসবে।

মাছ-মাংসের বাজারের পরিস্থিতি
মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মধ্যবিত্তরাও মাছ-মাংস কিনতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ছেন। মুরগির বাজার দেড় মাস ধরেই অস্থির। দফায় দফায় বেড়ে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হয়েছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা এবং সোনালি জাতের মুরগি ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের বাজার ডজনে ৫ টাকা কমে ১২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। রমজানের আগে থেকেই সকল ধরনের মাছের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। গতকাল রিয়াজউদ্দিন বাজার ও বহদ্দারহাট বাজারে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। মানভেদে রুই-কাতলার কেজি বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। চিংড়ি আর ইলিশ কেনা এখন বিলাসিতা। আকারভেদে চিংড়ি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা এবং ইলিশ ৭০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
সবজির বাজারে দেখা যায়, বছরের অন্য সময়ের চেয়ে রমজানে বেগুনের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ জন্য রমজানের আগেই আগুন লেগেছে বেগুনে। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। তবে লম্বা বেগুন কিছুটা কমে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শসার টান তেমন নেই। তবু দাম তুলনামূলক বেশি। মানভেদে ৫০ থেকে ৭০ টাকা দরে শসা বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচের দামও কিছুটা চড়া। মাঝে কয়দিন কমে আবার বেড়েছে দাম। খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি মরিচ বিক্রি হচ্ছে কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে। দাম বেড়ে হালিপ্রতি লেবু আকারভেদে বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। তবে বড় বাজারগুলোতে কিছুটা কম দামে মিলছে লেবু।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, জেলা প্রশাসন ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের মতবিনিময় সভায় একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছিল রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের দাম তারা বাড়াবে না। ব্যবসায়ীদের সেই আশ্বাস শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ। কাজে কিংবা বাস্তবে তা মিলছে না।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজের হোসাইন বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি। তারও কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। তবে অযৌক্তিক কারণও আছে। তার মধ্যে আছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার প্রবণতা। রোজা এলেই বাজারে তারা অস্থিরতা তৈরি করে। রোজা শুরুর দুই মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়ায়। এবারও সেটা করেছে। ক্রেতাকে জিম্মি করে তারা অতি মুনাফা লুটতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, এবার রোজায় পণ্যমূল্যে বাড়তি দর ক্রেতাকে অতিষ্ঠ করে তুলবে।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ব্যবসায়ীরা আমাদের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন যে তারা মূল্যতালিকা, ক্রয়-বিক্রয় বিল ভাউচার রাখবে কিন্তু তা রাখছে না। তারা যদি তাদের স্বচ্ছতার জায়গা থেকে নিজেদের সংশোধন না করে তাহলে তো আইন প্রয়োগ করে সবকিছু হয় না। অধিদফতরের আইন অনুযায়ী বাজারে তদারকি চলছে। রমজানে আরো জোরদার করা হবে।
‘রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াবে না বলে প্রশাসনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ব্যবসায়ীরা রাখছে না’ ভোক্তা অধিকারের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক অহিদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন পূর্বদেশকে বলেন, ব্যবসায়ীরা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা করছে। আমরা চাই যে কোন অবস্থায় যেন নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ে। যদি সরকারের নির্ধারিত মূল্যের বাইরে কোন ব্যবসায়ী চড়া দামে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়, সরকারি বিধিমালা লঙ্গন করে তাহলে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।