অবহেলায় বিবর্ণ কিংবদন্তী সত্য সাহার গ্রামের বাড়ি

133

আবু তালেব, হাটহাজারী

বৃটিশ শাসনামলের ঐতিহাসিক নিদর্শন শ্রী লক্ষীচরণ সাহার জমিদার বাড়ি। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার সত্য সাহার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। সেই অতীত জৌলুস এখন আর নেই। ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি সংস্কারের অভাবে বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
হাটহাজারীর উত্তর ফতেয়াবাদ নন্দীরহাট গ্রাম ‘মন্দিরের গ্রাম’ হিসেবে খ্যাত। এই গ্রামে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বাড়িটি এখনও দেখতে আসেন পর্যটকরা।
জানা যায়, ১৮৯০ সালে প্রায় ৫ একর জায়গার ওপর দুই গম্বুজ বিশিষ্ট জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন তৎকালীন জমিদার লক্ষীচরণ সাহা। জমিদার লক্ষীচরণ সাহা, মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহা ওই অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে জমিদার ছিলেন। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জমিদারী দেখাশোনা করেন লক্ষীচরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন সাহা। ১৯৩৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সত্য সাহার জন্ম হয় এই জমিদার বংশে। ১৯৪৬-১৯৪৮ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৫১-১৯৫২ সালে কলকাতার একটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। সত্য সাহারা ছিলেন ১২ ভাই। ওই বাড়িতে ছিল প্রায় ১শ কর্মচারী।
জমিদারদের আমলে ওই বাড়িতে গড়ে তোলা হয় দ্বিতল-ত্রিতল দালানকোঠা ও বাগান বাড়ি। এখানকার সারিবদ্ধ দালান-কোঠা ও পূজামন্ডপ আজও মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। বাড়িটির চারদিকে রয়েছে ফসলি জমি, গাছ-গাছালি ও তিনটি পুকুর। এছাড়া আছে একটি দোতলা কাচারি ঘর, একটি বিগ্রহ মন্দির ও দুইটি বাসভবন। জমিদার ভবনের দেওয়াল ও কার্নিশে নানা কারুকাজ। কাঠের ছাদের বাড়িটির দুইপাশে আছে দুটি গম্বুজ।
ঐতিহাসিক এই বাড়িটিতে একসময় সিনেমার শুটিংও হয়েছে। ১৯৫৫ সালে সত্য সাহা প্রথম সিনেমা ‘সুতরাং’ দিয়ে সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে যাত্রা শুরু করেন। ১৮ দিন ধরে সিনেমাটি এই জমিদার বাড়িতে চিত্রায়িত হয়েছিলো। সত্য সাহার প্রযোজনায় ১৯৭৫ সালে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার দৃশ্যধারণও হয় এই বাড়িতে।
১৯৯৯ সালের ২৭ জানুয়ারি সত্য সাহা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলে সুমন সাহা এবং ছোট ছেলে ইমন সাহা সঙ্গীত শিল্পী। জমিদার বাড়িটি বর্তমান দেখভাল করছেন জমিদার বাড়ি বংশধর সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা ননী গোপাল সাহা ও রাঙামাটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বপন কুমার সাহা। তাঁরা জানান এই বাড়ির ইতিহাস- ঐতিহ্যের কথা।
স্থানীয় বাসিন্দা সংবাদকর্মী সুমন গোস্বামী পূর্বদেশকে বলেন, হাটহাজারীর নাজিরহাট, ধলই, গুমানমর্দ্দন, চারিয়া, জোবরা, আলীপুর, ফতেয়াবাদসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল তাদের জমিদারী। এসব অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার কৃষক প্রতিবছর খাজনা দিতে আসতো এই বাড়িতে। নিয়মিত রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো। জমিদার প্রসন্ন কুমার সাহার দুটি ঘোড়ার গাড়ি ছিল। তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আদালত ভবনে যেতেন। দুইজন নেপালী দারোয়ান সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকতো। জমিদার বাড়ির পাশে গো-শালায় ছিল নয় জোড়া হালের গরু। ছিল গোলাভরা ধান আর পুুকুর ভরা মাছ। একেক বেলায় রান্না হতো প্রায় দুই-তিনশ লোকের। সবকিছুই এখন ইতিহাস।
তিনি আরও জানান, ১৯৫০ সালের দিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ওই বাড়িটি পূর্বের জৌলুস হারায়। সেইসব দিনের ইতিহাস, ঐতিহ্য বহনকারী জমিদার বাড়িটি অবহেলায় পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে হয়তো বাড়িটি হারিয়ে যাবে একদিন।
নন্দীরহাট বাজারের মূল সড়কের পূর্বপাশে শ্রীশ্রী নিস্তারিণী কালী মন্দির। পাশে জমিদার বাড়ির পুকুরের পাড়ে পারিবারিক শ্মশান। এখানেই সত্য সাহার সমাধিস্থল। ‘নীল আকাশের নিচে আমি’, ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’, ‘দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক’, ‘চিঠি দিও প্রতিদিন’, ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘তুমি কি দেখেছো কভু’, ‘ঐ দূর দূরান্তে’, ‘তোমারই পরশে জীবন আমার’, ‘মাগো মা ওগো মা’- এমন অনেক কালজয়ী গানের বরেণ্য সুরকার ও সংগীত পরিচালক সত্য সাহা।
২৭ জানুয়ারি ছিল ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজও তাঁর সুরারোপিত গানগুলো দেশিয় সংগীতাঙ্গনে আলাদা মাত্রা ধরে রেখেছে। দীর্ঘ সংগীত জীবনে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন সত্য সাহা। তিনি বেঁচে আছেন কালজয়ী গানগুলোর সুরে, বেঁচে আছেন জমিদার বাড়ির প্রিয়জনদের হৃদয়ে, বেঁচে আছেন ভক্ত-অনুরক্তদের ভালোবাসায়।