অপরাধীর আত্মশুদ্ধি ও প্রবেশন সেবা

214


গত ৭ আগস্ট, ২০২০ খ্রি: ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম ছিল ‘নিজ বাড়িতে সাজা খেটে উপহার পেলেন গাছের চারা’। আপন গৃহ কিভাবে সাজার স্থান হয়! তাহলে থানার প্রয়োজনীয়তা কি ? কেন কারাগার ? এ প্রশ্ন অনেকের মনে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা মো. নুর উদ্দিন ওরফে সেলিম একজন মাদক মামলার আসামি। সুনামগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শুভদীপ পাল ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে’ নুর উদ্দিনকে ১ (এক) বছর বিনাশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেন। কিন্তু তাকে কারাগারে পাঠানো হয়নি। বিচারক ‘দ্যা প্রবেশন এন্ড অফেন্ডর্স অর্ডিন্যান্স’ এর আওতায় তাঁকে সংশোধনের জন্য জেলা প্রবেশন অফিসার মো: শফিউর রহমানের তত্ত¡াবধানে নিজ বাড়িতে সাজা ভোগের আদেশ দেন। এ আদেশে আদালতের শর্ত ছিল : অপরাধী জেলার বাইরে যেত পারবে না; নতুন কোন অপরাধে জড়াতে পারবে না; প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে থাকবে এবং নিয়মিত প্রবেশন অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করবে। এ প্রবেশন সেবাকর্মের মাধ্যমে লঘু অপরাধীদের আত্নশুদ্ধি ও সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা হয়।
অপরাধ কি ? সমাজে অপরাধ বাড়ছে কেন ? এসব বিষয়ে সুশীল সমাজ চিন্তিত। সৃষ্টি জগতের শুরু থেকেই প্রত্যেক সমাজে অপরাধের অস্থিত্ব বিরাজমান। অপরাধ একটি সামাজিক ব্যাধি। সমাজের দৃষ্টিতে অপরাধ হচ্ছে-সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ, রীতি-নীতি, ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ পরিপন্থী কাজ। রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণে অপরাধের অর্থ ভিন্ন। এক্ষেত্রে অপরাধ হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গমূলক কাজ । সমাজ ও রাষ্ট্র বিরেধী তৎপরতা। যেসব অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান আছে। কালের পরিক্রমায় অপরাধ প্রবণতার ধরণ ও প্রকৃতি ক্রমবদল হচ্ছে। আমাদের দেশে অপরাধের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। যেমন: খুন, হত্যা, নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, ইভ-টিজিং, চুরি, ডাকাতি, মানব পাচার, মাদক পাচার, কাজের লোকের উপর নির্যাতন, ছিনতাই, অপহরণ, প্রতারণা, পর্ণগ্রাফি, সাইবার ক্রাইম, ঘুষ , দূর্নীতি, খাদ্যে ভেজালসহ নানান অপরাধ। কেন এ অপরাধের চিত্র ? এ বিষয়ে নানান মতভেদ আছে। দেশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ত্রূটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, সমাজিক মূর‌্যবেধের অভাব, শ্রেণী বৈষম্য, সম্পদ ও সুযোগের অসম বন্টনসহ নানান কারণে অপরাধের সংখ্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অপরাধমূলক মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশের বিচারিক আদালতমসূহে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬,৮৪,৭২৮ টি। যা সভ্য সমাজের জন্য উদ্বেগজনক।
রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা হয় বিভিন্ন মানদন্ডে। শাস্তি আরোপের উদ্দেশ্য: শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অন্যদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখা, অপরাধীকে পুনরায় অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখা ও সংশোধনের মাধ্যমে অপরাধীকে দেশের আইনমান্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। সকল দেশে শাস্তি আরোপ পদ্ধতি এক নয়। দেশে দেশে শাস্তির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন: কারাদন্ড, নিঃসঙ্গ কারাবাস, অর্থদন্ড, মৃত্যুদন্ড, বেত্রাঘাত, অঙ্গচ্ছেদ, শিরচ্ছেদ, ফায়ারিং স্কোয়াড ইত্যাদি। এসব শাস্তি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কতটা কার্যকর, এ নিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানীদের মাঝেও বিতর্ক আছে। অপরাধ বিজ্ঞানীগণ শাস্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কিত মতবাদ ব্যক্ত করেছেন ৪ (চার) টি তত্ত্বে। যথা: ১. প্রতিশোধ তত্ত্ব ২. নিবৃত্তিমূলক তত্ত্ব ৩. নিবারণমূলক তত্ত¡ ৪. সংশোধন তত্ত¡। সকল শাস্তি তত্ত্বের আলোকে অপরাধীর সংশোধন ও সমাজে পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। প্রতিশোধমূলক, নিবারণমূলক ও নিবৃত্তমূলক শাস্তি তত্ত্বে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা যায় বটে। কিন্তু শাস্তি ভোগ করে অপরাধী আরো হিংস্র, বিপজ্জনক, সহিংস ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। এ ব্যবস্থায় অপরাধীকে সংশোধন বা পুনর্বাসনের কোন সুযোগ নাই।
সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস শাস্তিই অপরাধীর একমাত্র কাম্য। একজন অপরাধীকে কী সংশোধন করা যায় ? সংশোধনের উপায় কি ? এ বিষয়ে সাধারণের ধারণার অভাব। আধুনিক অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে অপরাধীরা হলো এক ধরনের সামাজিক অসুস্থ মানুষ। অপরাধ প্রবণতা সে সমাজ থেকে পেয়ে থাকে। সমাজে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থতার জন্য অপরাধী দেশের প্রচলিত আইনের বিপক্ষে অবস্থান নেন। জীবনের সঙ্গতি হারিয়ে তারা বিপদগামী হয়। কিন্তু শাস্তি আরোপের সংশোধনমূলক ব্যবস্থায় একজন অপরাধীকে পুনরায় সঙ্গত ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। অপরাধীর অপরাধ সংশোধনের আইনসম্মত ও স্বেচ্ছামূলক পদ্ধতি হচ্ছে ‘প্রবেশন’ ব্যবস্থা।
প্রবেশন (Probation) কি? এটি একটি অপরাধী সংশোধনমূলক সেবা। প্রবেশন শব্দের উদ্ভব ল্যাটিন শব্দ Probara’ থেকে। যার অর্থ পরীক্ষা, প্রমাণ করা অথবা চেষ্টা করা বুঝায়। এখানে পরীক্ষাকাল বলতে অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের সময়। প্রবেশন ব্যবস্থা প্রথম উৎপত্তি ১৮৪১ সালে আমেরিকার বোস্টন শহরে। John Augustus নামে একজন মানবতাবাদী মুচি স্বেচ্ছা উদ্যোগে এ কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি স্থানীয় আদালতসমূহ পরিদর্শনে দেখতে পান যে, অনেকেই অতিরিক্ত মদ্যপানের দায়ে অভিযুক্ত। আসামীরা আদালতের ধার্য্যকৃত জরিমানা পরিশোধ করতে পারছিলনা। John Augustus একজন মদ্যপায়ীকে নিজ জিম্মায় আদালত হতে মুক্ত করান। কিছু দিনের মধ্যেই ঐ আসামির চরিত্রিক পরিবর্তন আসে এবং মদ্যপান অভ্যাস ত্যাগ করেন। এ অবস্থায় বিচারক অপরাধীকে নামমাত্র জরিমানায় খালাস দেন। এ ধারাবাহিকতায় তিঁনি আদালত হতে অনেক আসামির জামিন মঞ্জুর করান। তিনি জামিনপ্রাপ্ত আসামীদের চারিত্রিক সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ কাজে তিনি কিছু সংখ্যক অনুসারী সংগ্রহ করেন। তারা অপরাধীর আচরণ সংশোধনের জন্য Probationary Work করতেন। John Augustus এর স্বেচ্ছামূলক অনুসারীরা সমাজে ‘Probationary Officer’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
অপরাধের সংশোধনমূলক কর্মসূচি হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশনের আবির্ভাব ঘটে Probation of Offenders Ordinance in 1960’ এর মাধ্যমে। এ প্রবেশন ব্যবস্থা সমাজসেবা অধিদফতরের একটি প্রাচীন সেবাকর্ম। ১৯৬২ সালে Probation of Offenders Project’ এবং `After Care Service Project’ নামে দুটি কর্মসূচি দেশের ১০টি স্থানে আলাদাভাবে চালু করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে এ কর্মসূচি দু’টিকে একীভূত করা হয়। তৎকালীন জেলা শহরসমূহে সমাজসেবা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ২১টি পবেশন ইউনিট চালু করা হয়। সমাজসেবা বিভাগের আওতায় দেশের ৬৪ জেলায় প্রবেশন সেবাকর্ম পরিচালিত হচ্ছে। প্রবেশন অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের একটি শিক্ষামূলক ও পুনর্বাসনমূলক পদ্ধতি। প্রবেশন ব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক হলো এখানে একজন লঘু অপরাধীকে শর্ত সাপেক্ষে তার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে রেখে কৃত অপরাধ সংশোধন এবং তাকে সামাজিকভাকে একিভূতকরণের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে অপরাধীর প্রতি পরিবার ও সমাজের বিরূপ মনোভাব দূর হয়। এবং তাদের প্রতি সমাজের সহানুভূতিশীল মনোভাব জাগ্রত হয়।
আধুনিক সমাজকর্মের মৌলিক দিক হচ্ছে, একজন সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যা দূর করা এবং সমাজে তার পূর্ণমাত্রায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। প্রবেশন সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে পরিচালিত অন্যতম সেবাকর্ম। অপরাধীকে প্রবেশনের সুযোগ প্রদান সম্পূর্ণ আদালতের উপর নির্ভরশীল। আদালত প্রবেশন মঞ্জুর করলে ‘প্রবেশন এন্ড আফটার কেয়ার সার্ভিস’ এর আওতায় প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে একজন লঘু অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ প্রচেষ্টায় একজন অপরাধী আইন সঙ্গতভাবে তার চরিত্র সংশোধনের সুযোগ পায়। প্রবেশন সেবা সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে একটি কার্যকর প্রচেষ্টা।
প্রবেশন ব্যবসা অপরাধীর পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। বরং আদালত কর্তৃক সংশোধনের লক্ষ্যে অপরাধীর শর্তাধীন মুক্তি। প্রত্যেক মানুষ সমাজে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। মর্যাদাপূর্ণ জীবন মানুষের অধিকার। প্রবেশন ব্যবস্থা একটি মহৎ সমাজকর্ম এবং অপরাধীর অপরাধ সংশোধনের অনন্য সুযোগ। সকল অপরাধীর আত্মশুদ্ধি হোক। অপরাধীরা ফিরে আসুক সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে। প্রসারিত হোক প্রবেশন সেবাকর্ম।

লেখক : সহকারী পরিচালক
সমাজসেবা অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম