অগ্নিদুর্ঘটনার শেষ কোথায় ?

4

ড. মো. রফিকুল ইসলাম

আমাদের দেশে নানাবিধ কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিককালে অগ্নিদুর্ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। যা জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চকবাজার, এফ আর টাওয়ার, নিউমার্কেট, বঙ্গবাজার, বেইলী রোড ও চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের ট্রাজেডি ঘটেছে। এ সমস্ত অগ্নিকান্ডের ফলে দেশের সম্পদের ক্ষতিসাধনসহ জানমালের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাই অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ এর কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হতে পারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত।
যতদূর জানা যায় যে, ১৬১০ সালে ঢাকা শহরের অর্ধেক অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। আর এখন তো অগ্নিকান্ড যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ আগুন থেকে দেশের গার্মেন্টস কারখানা থেকে শুরু করে হাসপাতাল, বস্তি থেকে অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানী এবং কল-কারখানা থেকে পার্ক যেন কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিদুর্ঘটনায় হতাহতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার নানাবিধ চিত্র ওঠে এসেছে। এর অন্যতম কারণ হলো অগ্নিদুর্ঘটনার প্রতিরোধের বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষার ও আধুনিক প্রশিক্ষণের বড় অভাব। সে সাথে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ফলে আগুন সহজে ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও ভবন নির্মাণে আইন অমান্য করাসহ ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই অগ্নিকান্ডের ফলে মানুষ অতিমাত্রায় আতস্কিত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে হুড়াহুডি ও আতস্কের কারণে মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে আগুন যদি অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে। সেক্ষেত্রে আগুন মারাত্মক আকার ধারণ করে। এক্ষেত্রে অগ্নিকান্ডের কারণে বন্ধ স্থানে অর্থাৎ দুর্ঘটনা স্থানে বাতাসে কার্বণ-মনোক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর ফলে আবদ্ধ জায়গায় সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে না বিধায় কার্বণ-মনোক্সাইডের বিষক্রিয়া বেশি ঘটে। তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফলে এ বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বিশেষজ্ঞরা অগ্নিদুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে মানুষের অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই দায়ী করছে। বিশেষত বাসাবাড়িতে বেশিরভাগ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হওয়ার মূল কারণগুলো হলো ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও এসি কম্প্রেসার বা জ্বলন্ত সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে। ঢাকা তথা দেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রাম-গঞ্জে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজের কারণেই প্রতিনিয়ত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। যতদূর জানা যায়, দেশে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ৮০ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে সহজেই শর্টসার্কিটের ফলে আগুনের মতো ঘটনা ঘটছে। উল্লেখ্য যে, বিদ্যুতের তার উৎপাদন ও বাজারজাতের ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু একশ্রেণি কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন নামী-দামী প্রতিষ্ঠানের লোগো ও সিল ব্যবহার করে নি¤œমানের বিদ্যুতের তার উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। স্বাভাবিকভাবে বৈদ্যুতিক তারগুলো আসল কিংবা নকল তা বুঝার কোনো উপায় নেই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক তার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিএসটিআইয়ের নিয়মিত অভিযান আরও জোরদার করা দরকার। বিশেষ করে বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের তার ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে মালিকদের সচেতনতা জরুরি। আবার অধিকাংশ রেস্তোরাঁ ও শপিং কমপ্লেক্সে দুর্ঘটনাকালীন জরুরি বহির্গমন পথের কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে কোথাও কোনো অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে উদ্ধার কাজ বিঘ্ন ঘটছে। এর মূল কারণ ঢাকার অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত নির্মাণ, পর্যাপ্ত জায়গা ও প্রশস্ত রাস্তার অভাব, রাজউক কর্তৃক প্রণীত ভবন নির্মাণ নীতিমালা না মানার ফলে নানাবিধ দুর্ঘটনা ঘটছে। এ সমস্ত সমস্যার ফলে একদিকে যেমন দুর্ঘটনার আশস্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে একটি শহরে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কংক্রিট ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। আর সেখানে তথা ঢাকা শহরে প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে সবুজ বনায়ন কমে যাওয়ায় দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নগরে প্রায় ৯২ শতাংশ ভবন নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে নির্মাণ করছে। এসব ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা না রেখে নির্মাণের ফলে সেখানে এক ধরনের গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এতে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার মতো ঘটনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকায় অগ্নিকান্ডের পেছনে পরিবেশগত কিছু সমস্যা অবশ্যই রয়েছে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও পানিদূষণ বেড়েছে প্রতিমাত্রায়। তাই নগর সভ্যতা নির্মাণের জন্য যে সব আইন-কানুন মানা উচিত। তবে তার একটি আইনও কোথাও মানা হচ্ছে না। যতদুর জানা যায়, ঢাকা শহরে ৫২টি সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ সকল সংস্থার মধ্যে সমম্বয়ের বড় অভাব রয়েছে। এ সমম্বয়ের অভাবে দেশের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে।
বিষয়টি লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশ তথা ঢাকা শহরে এক সময়ে অনেক নদী-নালা ছিল। এতে অনেক ছোট-বড় নৌযান চলাচল করতো। বর্তমানে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ নদী-নালার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এখন যা রয়েছে তা একশ্রেণি অসাধু ব্যবসায়ীরা ভরাট করে বড় বড় অট্রালিকা নির্মাণ করেছে। আর দৃশ্যমান কোনো নালা থাকলেও এর মধ্যে বাসাবাড়িসহ শহরের ময়লা-আর্বজনার ভাগাড়ে পরিণত করছে। বিশেষত নদী-নালাগুলো যদি সচল করা সম্ভব হতো। সেক্ষেত্রে হয়তোবা কোটি কোটি টাকা খরচ করে শহরে ফায়ার হাইডেন্ট বসানোর কোনো প্রয়োজন হতো না। উল্লেখ্য যে, নদী-নালাগুলো সচল রাখতে চেষ্টা করলেও এর কোনো সুফল শহরবাসী পাচ্ছে না। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশ কর্তৃপক্ষ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে আগুন নেভানোর জন্য পানির প্রাপ্যতা সহজ করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ফায়ার হাইডেন্ট হলো পানি সংরক্ষণাগারের সঙ্গে সংযুক্ত বিশেষ পানিকল। যা সাধারণত রাস্তার পাশে ফায়ার হাইডেন্ট স্থাপন করে ওয়াসার লাইনের সাথে যুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে কোথাও কোনো অগ্নিকান্ড ঘটলে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ওয়াসার লাইনের সাথে ফায়ার হাইড্রেন্ট যুক্ত করে ওয়াসার পানি সরবরাহের মাধ্যমে আগুন নেভানোর কাজ করতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ তথা ঢাকা শহর অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের ফলে পুরো শহরজুড়ে স্ট্রিট হাইডেন্ট বসানো সমস্যা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, নদীবেষ্টিত ঢাকা শহরে পানির অভাবে আগুন নেভাতে না পারার মতো ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলছে। এর নতুন আইনের অধীনে যে সমস্ত ভবনগুলো বিদ্যমান রয়েছে। সে সকল ভবনগুলোতে ফায়ার সেফটি কী রকম হবে। সে সাথে নতুন নির্মাণাধীন ভবনগুলোর জন্য ফায়ার সেফটির অংশ হিসেবে পিলার হাইড্রেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক ভবন মালিকরা পিলার হাইডেন্টের বসানোর বিষয়ে উদাসীন। যার কারণে বিভিন্ন জায়গায় আগুনের মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা নেভাতে পানির সংকট দেখা দিবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংস্থার সমম্বয়ে তদারকি বিশেষ জরুরি। বিশেষ করে ভবন মালিকরা অর্থ বাঁচানোর জন্য অনেক সময় গড়িমসি করে পুরনো বৈদ্যুতিক তার ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে উন্নতমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করাই শ্রেয়। তাই একটু সচেতন হলেই দুর্ঘটনার হার বা ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব হতো। তাছাড়া ভবনগুলোতে উন্নতমানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং দক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান দ্বারা ওয়ারিং করতে হবে। এতে শর্টসার্কিট জনিত দুর্ঘটনার হার নিঃসন্দেহে হ্রাস পাবে। এর পাশাপাশি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোডের বিষয়ে কোনো ধরনের আপস না করার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। তবে আবাসিক এলাকায় কোনো ধরনের রাসায়নিক সামগ্রীর দোকান রাখা উচিত নয়। আর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন ভবনসমূহে সচল অগ্নি প্রতিরোধকমূলক সামগ্রী স্থাপনে বিষয়ে অধিক কঠোর হতে হবে। উল্লেখ্য যে, স্কুল ও কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অগ্নিকান্ডের বিষয়ে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা জরুরি। বিশেষত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নির্দেশ অনুযায়ী আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নীতিমালার আলোকে প্রতি তলায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ হাতের নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। প্রতিটি বাণিজ্যিক ভবনে জরুরি সিঁড়ি বা ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট থাকতে হবে। আর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সম্পর্কে মৌলিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং যে সকল ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিতকরণ করে ভবন মালিকদের নোটিশ দিতে হবে। এক্ষেত্রে মালিকদেরকে সতর্ক করে দিতে হবে। তবুও যদি কোনো ভবন মালিকগণ কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করে। সেক্ষেত্রে জরিমানা অথবা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে যদি এ আইনের কোনো ধরনের ফাঁকফোঁকর থাকে। সেক্ষেত্রে আইন সংশোধন করে নতুন আইন করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে সুশীল সমাজ মনে করে।
বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগে নতুন প্রযুক্তি লুফ-৬০ সংযোজন করা হয়েছে। এ অত্যাধুনিক যন্ত্রটি রিমোটের সাহায্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ করছে। এর সাহায্যে মিনিটে এক হাজার লিটার পানি ছেটানো সম্ভব। তবে অদূর ভবিষ্যতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগে আরও উন্নতমানের নিত্যনতুন প্রযুক্তি যোগ হবে। এক্ষেত্রে দেশবাসী উপকৃত হবে।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান-
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম