ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এবার পৌণে ছয় লাখ টন

24

তুষার দেব

দেশে চলতি অর্থবছরে পৌণে ছয় লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) ইলিশ আহরণের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। সেই হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৪২ হাজার মেট্রিক টন। সাগরে সুরক্ষিত অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ এবং জাটকা সংরক্ষণে সাগরে মৎস্য আহরণে বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করায় ইলিশের উৎপাদন বেড়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করছে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর। সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও দেশের খ্যাতনামা ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান চলতি বছরে পৌনে ছয় লাখ মেট্রিক ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের তথ্য জানিয়ে পূর্বদেশকে বলেন, গত অর্থবছর দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। বৈশ্বিক অতিমারি করোনাকালে যে পদ্ধতি অবলম্বন করে জাটকা সংরক্ষণ ও প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে, তাতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া প্রত্যাশিত ব্যাপার। গতবছরের অক্টোবর মাসে ৫১ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃৃদ্ধিতে এটা একটা নতুনমাত্রা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে টানা বিগত পাঁচ বছর ধরে মৎস্য বিভাগের গবেষকরা বেশ দক্ষতার সাথেই ইলিশ-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইলিশ মাছ উপক‚ল কিংবা স্বাদু পানির এলাকা থেকে বেরিয়ে সাগরের লোনাপানিতে প্রবেশ করে। মাঝখানের ওই ৬৫ দিন স্বাদু পানিতেই জাটকা বড় হতে থাকে। এছাড়া ছয়টি পৃথক অভয়াশ্রম গড়ে তোলার মাধ্যমে সাগর-নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রগুলো সুরক্ষিত রাখার প্রচেষ্টাও ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিবাচক অবদান রাখছে। আর এসব পদক্ষেপের সুফল হিসেবে গত এক দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৪ শতাংশ। ইলিশ আহরণের পরিমাণ ও আকার দু’টোই বেড়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ৯০ লাখ টন। আর এক দশক পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের জাতীয় মাছটির উৎপাদন বেড়ে পাঁচ দশমিক ৩৩ লাখ টনে উন্নীত হয়। সর্বশেষ গত বছর দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি মৌসুমে ইলিশের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পৌনে ছয় লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। সামুদ্রিক ও মিঠা পানি মিলিয়ে দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২ দশমিক ১৫ শতাংশই আসে কেবল সুস্বাদু রূপালী ইলিশ থেকে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান এক শতাংশের বেশি।
নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত টানা ৬৫ দিন মৎস্য আহরণে সাগরে যেতে পারে নি জেলেরা। ওইদিন মধ্যরাত ১২ টায় নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হতেই জাল ও ফিশিং ট্রলারসহ নানা সরঞ্জামাদি নিয়ে মৎস্য আহরণে সাগর পানে যাত্রা শুরু করে তারা। তবে এরইমধ্যে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপের প্রভাবে বায়ুচাপের তারতম্যে আধিক্য বিরাজ করায় সমুদ্রবন্দরসমূহে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত জারির পাশাপাশি মাছ ধরার ট্রলারসমূহকে উপক‚লের কাছাকাছি সাবধানে চলাচলের নির্দেশনা দেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। অবশ্য গতকাল রবিবার লঘুচাপটি দুর্বল হয়ে পড়ার খবরও দিয়েছে সংস্থাটি। এতে ইলিশ আহরণে জেলেদের সমুদ্রযাত্রা সুগম হয়েছে।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুমন বড়ুয়া বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে আমরা চলতি অর্থবছরে পৌনে ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণ সম্ভব হবে বলে আশা করছি। বিগত এক দশক আগেও যেখানে দেশের শুধুমাত্র ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশের দেখা মিলত, সেখানে এখন একশ’ ২৫ থেকে ৩০টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। জলভাগে নদী-সাগর মিলিয়ে দেশে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। প্রজনন মৌসুমের পর প্রতিবছর পয়লা নভেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আট মাস জাটকা (৯ ইঞ্চির কম দৈর্ঘ্যরে ইলিশ) নিধনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকে। এরপর মে থেকে জুলাই পর্যন্ত সাগরে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় টানা ৬৫ দিন। সবমিলিয়ে বছরে অন্তত দশ মাস সাগরে মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকার কারণে বিভিন্ন মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায়।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সরকারিভাবে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপক‚লীয় অঞ্চলসহ সারাদেশে নিবন্ধিত দুই লাখ ৯৮ হাজার পাঁচশ ৯৫ জন জেলে রয়েছে। মৎস্য আহরণে সাগরে অনুমোদিত বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে ৩০টি। এছাড়া কাঠের তৈরি যান্ত্রিক নৌযান রয়েছে ৩২ হাজার। জেলেরা বলছেন, এবার পদ্মা ও মেঘনায় বড় আকারের ইলিশ ধরা পড়তে পারে। দীর্ঘদিন মাছ শিকার বন্ধ থাকায় মেঘনা ও পদ্মায় অভয়ারণ্যে মাছ বড় হওয়ার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। এ সময় নদীতে মৎস্য আহরণের সুযোগ থাকলেও মাছের দেখা মিলে খুবই কম।