আগুনঝরা মার্চ

33

নিজস্ব প্রতিবেদক
রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম/ মুক্তি ছাড়া তুচ্ছ মোদের এই জীবনের দাম/ সংকটে আর সংঘাতে/ আমরা চলি সব একসাথে/ জীবন-মরণ পণ করে সব লড়ছি অবিরাম/ রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম/ রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেব/ রক্তের প্রতিশোধ মোরা নেবই নেব/ ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়েছি বাংলার সন্তান/ সইবনা মোরা, সইবনা আর জীবনের অপমান/ জীবন জয়ের গৌরবে/ নতুন দিনের সৌরভে/
মুক্ত স্বাধীন জীবন গড়া মোদের মনস্কাম…
বাঙালি জাতির সহস্র বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গৌরবগাঁথা হলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আমাদের অজর কবিতা ‘অবিনাশী গান’। অত্যন্ত চড়া দামে কিনতে হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। তাই স্বাধীনতা আমাদের কাছে এত প্রিয়, এত সাধনার। আর প্রিয়তম এই স্বাধীনতা এসেছে মার্চ মাসে। তাই মার্চ মাস আমাদের এত প্রিয়। একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলো এখনো আমাদের শিহরিত করে, আতঙ্কিত করে, আবার সাহসীও করে। মার্চে সেই ভয়াল কালরাত্রি এসেছিল। আবার তা ভোরও হয়েছিলো নতুন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে। তাই মার্চ স্বাধীনতার মাস। সর্বোত্তম অর্জনের মাস।
বাঙালির জাতীয় জীবনের সকল অর্জনের প্রতীক।
একাত্তরের মার্চের বারুদগন্ধি দিনগুলোতে চট্টগ্রামে কী ঘটেছিল? ইতিহাস বলছে, আগের দিন বিহারী-বাঙালি শান্তি কমিটি গঠন হবার পরও একাত্তরের ৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিহারীরা ও পাকিবন্ধু কিছু বাঙালি হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠন করে। লুন্ঠনের সময় স্থানীয় হিন্দু ও পুরোহিতদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এই ঘটনা বিহারী-বাঙালি সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালে। রেলওয়ে কলোনি, হালিশহর, আগ্রাবাদ ও নিউমার্কেট এলাকায় বাঙালি-বিহারীর সংঘর্ষ হয়। আন্দরকিল্লা, ফিরিঙ্গীবাজার, আছদগঞ্জ ও চকবাজারে সাধারণ বাঙালি ও হিন্দুদের সাথে বিহারী-জামায়াতে ইসলামী-ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠনের সাথে জড়িত বাঙালিরা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য বলে জানান আওয়ামী লীগ নেতারা। এম এ মান্নান বাঙালিদের জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান।
কি ছিলো আমাদের মার্চের মহান অঙ্গীকার? বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলাম। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রæর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ লড়াই- সংগ্রাম করেছি। মুক্তির সংগ্রামে অবিচল থেকে স্বাধীনতাও ছিনিয়ে এনেছি। কিন্তু ঈপ্সিত মুক্তি অর্জন কি হয়েছে? কেনো হয়নি? এখনতো আর আমাদের কোনও ঔপনিবেশিক শক্তি শাসন করছে না। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের সকল পরীক্ষায় তো আমরা উত্তীর্ণ হয়েছি। তাহলে এখন আমরা কার অধীন? যদি অধীন নাই হই, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে সুশাসনের যোগ্যতা কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে না? ভূ-খন্ডের স্বাধীন হলেও আমরা শাসনব্যবস্থার দিক থেকে এখনও পরাধীনই রয়ে গেছি। আমরা স্বাধীন শুধু ভূখন্ড, পতাকায়, আর সঙ্গীতে। এখনও একাত্তরের পরাজিত শক্তি ছড়ি ঘোরাতে চায় আমাদের মাথার ওপর। এখনো ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের অর্থনীতি। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পশ্চিমের মোড়লেরা। সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রকদের হাতে। এই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধীনতা কি এক ধরনের পরাধীনতা নয়? আমাদের এই পরাধীন অবস্থা আরো প্রকট হয় জাতীয় ইস্যুগুলোতে আমাদের মতানৈক্যের কারণে। এই প্রবল মতানৈক্যই এখন আমাদের রাজনীতির প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। রাজনৈতিক ঘোর ও বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক একটি ধর্মরাষ্ট্রের কবল থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা। তখন যারা তা চায়নি, অর্থাৎ যারা ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার ধূয়া তুলে মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আখ্যা দিয়ে প্রতিহত করার নামে বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের অবতারণা করেছিল, তাদের উত্তরাধিকার এখনও নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা আজও বাংলাদেশের বিকাশের গতিপথকে উল্টোদিকে ঘোরাতে চায়।