নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকা রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজ

195

নারী শিক্ষার এক আলোকবর্তিকা রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজ। এমনিতেই গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়ার দৌঁড় মাধ্যমিকের বেশী গড়াতে পারে না। আজন্মকালের পুরুষশাষিত সমাজে মেয়েরা এখনো সংসার সামলানোর যন্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দেশের অগ্রগতিতে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এখন পুরুষদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী এগিয়ে গেছে, সেই প্রভাব এখনো গ্রামে আছড়ে পড়েনি। যে কারণে গ্রামের শতকড়া ৭০ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই। শতকরা ৫০ ভাগ নারীর মৃত্যু হয় মাতৃত্বকালীন ঝুঁকি আর জটিলতায়। এখনো গ্রাম পর্যায়ে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার প্রাথমিকে শতকরা ৫০ ভাগ আর মাধ্যমিকে শতকরা ৭০ ভাগ। শতকরা মাত্র ১০ ভাগ মেয়ে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার পথে হাঁটতে পারে। নারীদের এই অবস্থার জন্যে পরিবারের অভাবকে দায়ী করা যায় মাত্র শতকরা ১০ ভাগ। আর শতকরা ৯০ ভাগই দায়ী নারীদের প্রতি সমাজের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি আর ধর্মীয় গোড়ামী। ঠিক একই কারণে রাঙ্গুনিয়ার শতকরা ৮০ ভাগ নারী এখনো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আওতায়। এই অনগ্রসর নারীগোষ্ঠীর জীবনে শিক্ষার আলো জ্বালাতে ১৯৯৫ সালে এলাকার ১১ জন কৃতিমান আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে আবির্ভূত হন। ছাদেকুন নূর সিকদার, শফিকুল ইসলাম সিকদার, সত্য নারায়ন দাশ, স্বজন কুমার তালুকদার, সিরাজুল ইসলাম বাদল, আবদুস সবুর, নজরুল ইসলাম, ইফতেখার হোসেন, মোহাম্মদ ইসকান্দর, নাজিম উদ্দিন ও শাহজাহান সিকদার রাঙ্গুনিয়ায় একটি স্বতন্ত্র মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেখানে শুধুমাত্র মেয়েরাই লেখাপড়া করবে। তাহলে অভিভাবকরা আর অন্যান্য কলেজের মতো ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশার অজুহাতে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ১৯৯৫ সালের ১ জুন। রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজের কার্যক্রম শুরু হয় গ্রাম উন্নয়ন পরিষদ ভবনে। কিছুদিন পরেই এ উদ্যোগের সহযাত্রী হয়ে দানবীর আবদুল জলিল কলেজের জন্যে জমি দান করেন এবং অপর দানবীর অক্ষয় রাম মহাজন নির্মাণ করে দেন একটি ভবন। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সুদৃঢ় আর নিশ্চিত করতেই রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রাণকেন্দ্র রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার অনতিদূরে সৈয়দবাড়ি গ্রামে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ২০০০ সালে দারোগা মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস তার শ্বাশুড়ি মমতাজ বেগমের স্মরণে ‘মমতাজ ভবন’ নামে আরো একটি ভবন নির্মাণ করে দেন। গত বছর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ চারতলা ভবন নির্মাণ করে দেন বর্তমান শিক্ষাবান্ধব শেখ হাসিনার সরকার। যা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। কলেজের সামনে ৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার। শুরুতে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। পরিচালনা পরিষদ আর শিক্ষকগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিক্ষার্থীদের কলেজমুখী করতে দিনরাত পরিশ্রম করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজ বিগত ১৬ বছর ধরে একনাগাড়ে উপজেলায় ফলাফলে শীর্ষস্থান অক্ষুন্ন রেখেছে। পেয়েছে পর পর ৩ বার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি। শুরুতে যে কলেজে শিক্ষার্থী পেতে বাড়ি বাড়ি যেতে হয়েছিল সে কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সহস্রাধিক। প্রতি বছর ৯৫ ভাগ থেকে শতভাগ পাস করা এ কলেজটি গত দুই বছর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের মহানগর ছাড়া চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলার কলেজগুলোর মধ্যে ২য় স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করে। কলেজের অধ্যক্ষ সরোয়ার সালেক সিকদার জানান, কলেজ প্রতিষ্ঠার পর গত দুই যুগ ধরে রাঙ্গুনিয়ার ২০ সহস্রাধিক নারী এই কলেজ থেকে পাস করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে। এই কলেজের অনেক ছাত্রী বর্তমানে চুয়েট, বুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন করছে। বহু ছাত্রী রাষ্ট্রীয় সরকারি ও বেসরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কাজ করছে। কলেজের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দক্ষ পরিচালনা কমিটি আর অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলীর আন্তরিক প্রচেষ্টা। কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে আমরা শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদারকি করতাম। এমনকি মেধায় দুর্বল শিক্ষার্থীদের কলেজে স্পেশাল দৃষ্টি দেয়ার পাশাপাশি বাড়িতে গিয়েও পাঠদান করতাম। কয়েকজন শিক্ষককে কলেজ থেকে সাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। কোন শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত না হলে তার ব্যাপারে সন্ধ্যায় কিংবা রাতে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেয়া হতো। এক কথায় কলেজটিকে দাঁড় করাতে আমরা জানবাজী রেখে কাজ করেছিলাম। সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। এখনো কোন শিক্ষার্থী কলেজে না এলে কিংবা ক্লাস পরীক্ষায় খারাপ করলে তার ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়াও গরীব, এতিম ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়ানো হয়। দেয়া হয় শিক্ষা উপকরণও। রয়েছে শিক্ষা, সাহিত্য ও খেলাধুলার সর্বোচ্চ সুবিধা। এ বছর উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় ১৪ ইভেন্টের ১২টিতে এ কলেজের শিক্ষার্থীরা ১ম হয়েছে। কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগ চালু রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মেধা চর্চার জন্য সমৃদ্ধ পাঠাগার ছাড়াও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানাগার। নারী শিক্ষায় এ কলেজ অনন্য ভূমিকা রাখছে। পরিচালনা কমিটির সভাপতি পৌরসভা মেয়র আলহাজ শাহজাহান সিকদার বলেন, ছোটবেলা থেকে পড়ে এসেছি নেপোলিয়ান বলেছিলেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি দিব। কিন্তু শিক্ষিত মা দেওয়ার জন্য রাঙ্গুনিয়ার কোথাও একটি স্বতন্ত্র মহিলা কলেজ ছিল না।
১৯৯৫ সালের ১ জুন এলাকার ১২ কৃতিপুরুষ শিক্ষিত মা তৈরির এই কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ২ যুগ পরে এসে দেখি সত্যিই এটি একটি শিক্ষিত মা তৈরির কারখানা। এখান থেকে প্রতিবছর একঝাঁক মেধাবী ও দক্ষ মা বের হয়ে সমাজ ও দেশের অগ্রযাত্রায় অকল্পনীয় ভূমিকা রাখছে। যা তাদের অভিভাবকরাও একদিন কল্পনা করতে পারে নি। সুস্থ ও সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণের এসব কারিগরদের সহায়তায় পরিচালনা কমিটির পাশাপাশি শিক্ষকমন্ডলীদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর আন্তরিকতার ফলশ্রুতিতে আজ রাঙ্গুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছে এই কলেজ। সেই সাথে এলাকাবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাই যারা শুরু থেকে অদ্যাবধি এই কলেজের জন্যে সহযোগিতার হাত প্রসারিত রেখেছেন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ নয়, বিশ্বকে আজ শাসন করছে নারী। এই নারীকে বাদ দিয়ে কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে আজ পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান সবচেয়ে বেশী। দেশে স্বতন্ত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যত গড়ে উঠবে ততই দেশ ও সমাজের কল্যাণে নারীদের অংশ গ্রহণ বাড়বে। রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজ এলাকায় অনন্য নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের একটি অবস্থান তৈরি করেছে। সেই সাথে নারীদেরও একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। সমাজ ও সংসারের এক অমূল্য সম্পদ এখন নারী। এই সম্পদ তৈরিতে বর্তমান সরকারও কাজ করছেন।