শিক্ষক সুরক্ষা আইন সময়ের দাবি

13

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিনটিতে সকল শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা পোষণ করে শিক্ষক সমাজের জন্য একটা নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ আজ সময়ের দাবি। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল শিক্ষক যেন একটা সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে শিক্ষা দান করতে পারেন এই বিষয়টি এখন প্রশাসনের নজরে আনার সময় এসেছে। বর্তমান অবস্থান পর্যালোচনা করে দেখা যায় শিক্ষকরা নানান ভাবে অবহেলিত, বঞ্চিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত। তাই শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষক সমাজকে মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশে এগিয়ে নিতে হবে। আমরা জানি ; শিক্ষা জাতির মেরুদÐ। এই মেরুদÐকে সোজা রাখার জন্য শিক্ষক সমাজ সময় কাল সীমানা অতিক্রম করে শ্রম ও মেধা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। একটি শিশু মায়ের কোলে থেকে শেখা শুরু করে। আস্তে আস্তে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকেও শিখতে শুরু করে। এভাবেই একজন মানুষের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পরিবার ও পরিবেশ থেকে শুরু করে আপন পর সবার থেকে কিছু কিছু শিখতে শুরু করে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করে কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই একজন মানুষের শিক্ষা জীবনকে প্রভাবিত করে। আর এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা অপরিহার্য। একেবারে শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজ শিক্ষার্থীদের নানান ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করে আসেন। অর্থাৎ শিক্ষাকে পঠন ও পাঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি শিক্ষক সমাজ করে থাকেন। এখানে উল্লেখ ; মা-বাবার পরে একমাত্র শিক্ষক সমাজই তার শিক্ষার্থীর উত্তর উত্তর সাফল্য কামনা করেন। মা বাবার মত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিক্ষক সমাজ শিক্ষার্থীদের সাফল্য কামনা করে প্রার্থনা করে। সাফল্যের উচ্চ আসনে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা উল্লেখযোগ্য ।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন সভা সেমিনারে শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ;আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ নানান ভাবে অবহেলিত। বিশেষ করে এমপিও ভুক্ত শিক্ষক সমাজ অনেক অনেক পিছিয়ে আছে। সরকারি ও এমপিও ভুক্ত শিক্ষক সমাজের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। শুধু মাত্র ঘর ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার দিকে তাকালেই এই চরম বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। প্রমোশনের ক্ষেত্রেও এম পিও ভুক্ত শিক্ষক সমাজ বঞ্চিত ও অবহেলিত। বছরের পর বছর অপেক্ষা করে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নতি করেন। এই সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে আর কোন প্রমোশন নেই। যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্তে¡ও সহযোগী অধ্যাপক পদে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। স্কুল কলেজের বিভিন্ন ধাপে নানান নিয়ম নীতির নামে শিক্ষক সমাজকে অবহেলা করে আসছে। অথচ যারা এই ধরনের নিয়ম নীতি তৈরি করেন অথবা এই বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেন তারাও এক সময় শিক্ষক সমাজের হাত ধরে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় ; আর্থসামাজিক ভাবে বাংলাদেশ এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মসূচি চলছে সেখানে আমাদের শিক্ষক সমাজকে উন্নয়নের গতিধারায় এক হতে দিচ্ছে না। এখানে আরও উল্লেখ ; বছরে আমাদের দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে পরিমাণ পাচার কৃত টাকা আছে তার কোন সুনির্দিষ্ট হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। বর্তমানে সরকারের পক্ষে সেই হিসাব বের করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এভাবেই প্রতিদিন টাকা লুটপাট হচ্ছে। অথচ শিক্ষক সমাজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও তাদের মানোন্নয়নের জন্য আন্দোলনের প্রক্রিয়া বেছে নেয়। রাস্তায় রাস্তায় মানববন্ধন করে। দিনের পর দিন অনকু কর্মসূচি পালন করেন। পুলিশের লাঠি পেটা খায়। ধরপাকরের নামে শিক্ষকদের গ্রেফতার করা হয়। নানান ভাবে হেনচতা করা হয়। দেশের প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ এম পি ও ভুক্ত শিক্ষক সমাজের অবদান কখনো অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এম পি ও ভুক্ত শিক্ষক সমাজ শ্রম ও মেধার মাধ্যমে এদেশের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করে আসছে। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের এই এম পি ও ভুক্ত শিক্ষক সমাজের ভূমিকা অপরিসীম।
বর্তমান সময়ে কিছু কিছু ঘটনা শিক্ষক সমাজকে অনেক অনেক বেশি বিচলিত করেছে । আমাদের দেশের এম পি ও ভুক্ত কলেজ গুলো রাজনৈতিক ছত্রচায়ায় গঠিত পরিচালনা পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হয়। সাধারণত বিভিন্ন বড় বড় নেতা নেত্রীরা নিজেদের পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার জন্য মা বাবার নামে অথবা নিজের নামে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে। সেই পরিচালনা পরিষদের সদস্য বৃন্দ শিক্ষকদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভংগী ও মতামতকে প্রভাবিত করে থাকে। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনায় আনার ক্ষেত্রে পরিচালনা পরিষদের ব্যক্তিগত মতামত প্রাধান্য পায়। সা¤প্রতিক সময়ে কয়েকটি স্কুল কলেজে বেতন ও অন্যান্য ভাতা নিয়ে পরিচালনা পরিষদ অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ করে শিক্ষকসমাজকে বঞ্চিত করেছে। বিভিন্ন পত্রিকায় এই বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষক সমাজ নানান সভা সেমিনারে প্রতিবাদ করে এর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার দাবি জানিয়েছেন। সা¤প্রতিক কালে কয়েকটি ঘটনা শিক্ষক সমাজের মর্যাদায় চরম আঘাত হানে। শিক্ষককে পিটানোর ঘটনাও নানান মাধ্যমে প্রচার হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তির দ্বারা কান ধরে উঠা বসার পাশাপাশি জুতার মালা পর্যন্ত পরিয়ে শিক্ষককে অপমানিত করা হয়েছে । এই অপমান শুধু সেই শিক্ষকের ব্যক্তিগত অপমান নয় এই অপমান পুরো জাতির কলংক। তাছাড়া আজকাল ছাত্রছাত্রীদের শাসন করার ক্ষেত্রেও শিক্ষক সমাজকে নানান হুমকির মুখে পড়তে হয়। যেখানে শাসন থাকে না সেখানে আদর্শ নিঃসন্দেহে বেমানান। শাসন করার ফলে রাস্তা ঘাটে মাঝে মাঝে শিক্ষকদের অপমানিত হতে হয়। একজন শিক্ষক আদর স্নেহ শাসন দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করেন। একজন শিক্ষক অর্জিত সকল বিদ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। পাঠদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সহকারী শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যান। এখানে আরো উল্লেখ করতে হয় ; শিক্ষকদের মধ্যে কতিপয় শিক্ষক অন্যায় মনোভাব পোষণ করে থাকে। বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের কে নানান ভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায়। কোচিং ও প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীদের নাম্বার কম দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত কাজে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার অভিযোগও আছে। গুটিকয়েক ঘটনা পুরো শিক্ষক সমাজ তথা জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শিক্ষক সমাজ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। শিক্ষাদানকে একমাত্র লক্ষ্য বিবেচনা করে এদেশের উন্নয়ন কর্মসূচিতে ভূমিকা রাখবেন। শিক্ষক সমাজের মর্যাদা লড়াইয়ে শিক্ষকদের পাশাপাশি সকল স্তরের পেশাজীবীদের এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। মহান শিক্ষকদের হাত ধরেই সকলের এগিয়ে যাওয়া। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষকদের মানোন্নয়নে সরকারের আরো বেশি ইতিবাচক ভূমিকা কাম্য। শিক্ষক সমাজ ভালো থাকুক। নিরাপদে দিন কাটুক। শিক্ষার্থীরা আনন্দময় পরিবেশে জীবন গড়ুক। দেশ ও জাতি এগিয়ে চলুক।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, কলামিস্ট