ছাদবাগানে অপার সম্ভাবনা

16

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

সুরজিৎ দাস শুনু। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। পিতা শহিদ রমনী মোহন দাশ। মাতা স্বর্গীয় জ্যোৎস্নাময়ী দাস স্নিদ্ধা। বর্তমান ঠিকানা, ১১৪/এ, শহিদ দ্বীজেন কুটির, দেওয়ানজী পুকুর পাড়, চট্টগ্রাম। তিনি শহিদ পরিবারের সন্তান। নিজেও বীর মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রামের চেরাগীর আড্ডারুরা তাঁকে ‘মামা’ সম্বোধন করেন। অর্থাৎ শুনু মামাকে চিনেন না এমন লোক মেলাবার। মুখজুড়ে দাঁড়ি। শরীরে মাংস বলতে নেই, হাড্ডিসার শুকনো। ধনুকের মত বেঁকে গেছেন। কিন্তু হাটা-চলায় যুবককেও হার মানায়। অনেকবার স্ব-শরীরে হেঁটে দেখেছি পেরে ওঠেনি; খুবই প্রাণবন্ত- চমৎকার লোক। বিয়ে করেননি, সংসারও নেই। দেশে খুব বেশী আত্মীয়-স্বজন আছে বলে মনে হয় না। তবুও দেশ ছাড়েন নি অনেকের মত। ওপার বাংলায় থাকেন বড়বোন স্বর্গীয় রেণুকতা দত্তের মেয়ে-ভাগ্নী জবা দত্ত মন্ডল। চট্টগ্রামস্থ দেওয়ানজী পুকুর পাড়ের বাসাটি তাদের পৈতৃক। যে বাসায় শুনু মামা থেকে আসছেন। ভাগনীও একজন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। স্বামী ড. বিশ্বজিৎ মন্ডল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রামা ও মিউজিকের প্রফেসর। শুনু মামা এদিক-সেদিক খোশগল্পে মেতে থাকেন দিনভর। আয় রোজগার বলতে নিজের ও শহিদ পরিবারের ভাতা। কিন্তু ওই ভাতার কানাকড়িও নিজের ভরণপোষণে ব্যয় করেন নি কোনদিন, বিলিয়ে দেন অসহায়, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের মাঝে। বিশেষ করে মেধাবী ছাত্রদের লেখাপড়া ব্যয় নির্বাহে তা করে আসছেন। এখনো একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগে, ৩ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছেন। তিনি এ কাজটি নিরবে-নিভৃতে করে আসছেন।
করোনাকালিনও দেওয়ানজী পুকুর পাড়সহ চট্টগ্রামে ২০০ পরিবারকে ৭ কেজি করে চাউল সহায়তা করেন।তিন মাস পূর্বেও একটি শিশু সংগঠনের মাধ্যমে দেড় শতাধিক হতদরিদ্রের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। পাশাপাশি ছাদবাগান তীব্র আগ্রহ রয়েছে। দুই বছর পূর্বে একবার মামার ছাদবাগানটি দেখতে যাওয়া হয়। কয়েকটি ডালিম গাছ, কাজী পেয়ারা, সফেদা , বারোমাস্যা আম, লেবু, বেল, আমড়াগোড়া, মেহেদী গাছ ও গোলাপের চারা দেখতে পাই। সবকয়টিতে ফুল-ফল ঝুলছিল। একটি ডালিম ছিঁড়ে মামা ভেঙে দিলেন খেতে। গাছপাকা টসটসে রসেভরা। এমন ফল খাওয়ার স্বাদই আলেদা। এখনো যেন মুখে লেগে আছে। আকারে ছোট হলেও যার তুলনাই হয় না। আবারও বাগান দেখতে যেতে যা-না পিঠাপিঠি; বলেছেন, আরো নতুন নতুন জাতের চারা লাগিয়েছেন। আশ্বস্ত করেছি যাবো বলে। এখন তাঁর প্রত্যহকাজ হলো ছাদবাগানের পরিচর্যা করা। সকাল-রাতে পানি দেয়া। তারপর রোগবালাই দেখে ওষুধ প্রয়োগ করা। এভাবে দিনভর ব্যস্ত সময় কাটান তিনি। এর মধ্যে ১৯/৪/২০২৪ ইং চট্টগ্রামে শীরিষ তলায় বাগান মালিকদের অনুষ্ঠান। বিকাল ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনুষ্ঠান শেষ হয়। আমার আমন্ত্রণ ছিল কাকতালীয়ভাবে। তবে যাওয়াটা হয় বিলম্বে। অন্তত আধঘন্টা আগে পৌঁছলে অনুষ্ঠানের উপস্থিতি ও প্রদর্শনী দেখা যেত। কিন্তু রাস্তাঘাটের যে হাল অবস্থা, কোনো কিছুতেই নিশ্চিতা দেয়া যায় না। যথাসময়ে বাড়ি থেকে বের হই। হাতে তখনো ৩ ঘণ্টা সময় রয়েছে। দুটায় গাড়িতে ছড়ে বসি। এক ঘণ্টার মধ্যে একে খান পৌঁছে গাড়ি। সেখান থেকে সিটির ৪নং গাড়িতে উঠা। তারপর শুরু হলো বিড়ম্বনা; দেড় ঘণ্টায়ও যেতে পারেনি ২০ মিনিটের ওই পথ। ‘ড্রাইভার গাড়ি চাড়েন’ যাত্রীরা বারবার তা বলে যাচ্ছেন। কে কার কথা শুনে; শুরুতে আধঘণ্টা বিলম্বে একে খান থেকে গাড়িটি ছাড়ে। সেখান থেকে ইস্পানী মোড়ে ১০মিনিট স্থায়ী দাঁড়িয় থাকে। তারপর ফয়েজ লেকের সম্মুখে আবারও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমচ্ছিল ; এভাবে থেমে থেমে কোনোভাবে ওয়ারলেস পর্যন্ত পৌঁছে। সেখানে গিয়ে আবারও আধঘণ্টা বিলম্ব করে! গাড়িটির চালকের হাতির রাগ যেন যাত্রীদের ওপর ঝাড়ে। ঝাউতলা গিয়ে আবারও ঝিম খাটতে থাকে! তারপর খুলশি মহিলা কলেজ ও ওমরগনি কলেজ এবং জিইসি মোড়ে। অবশ্য জিইসি মোড়ে গিয়ে একটু নড়েচড়ে ওঠে। সম্ভবত প্রাণ ফিরে এসেছে; এবার পেনিনসুলার হোটেলের সম্মুখ থেকে দু-এক জায়গায় জোরে ব্রেক কষে লালখান বাজারে পৌঁছে। যাত্রীরা নড়েচড়ে ওঠে। হঠাৎ কেমন বেপোরোয়া তেড়ে ওঠে চালক। হুমড়ি খেয়ে পড়বে না পড়বে নাকি?
‘ড্রাইভার সাহেব, আস্তে চলান।’ না। তার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। এবার টাইগারপাসে গিয়ে কন্ট্রাক্টরের ইয়া চিৎকার। ‘নিউ মার্কেট, নিউ মার্কেট।’ ঠিকই পূর্বকার আচরণ, যেই লাউ সেই কদু… পরিবহনের এ সেক্টরটা একেবারে রসাতলে গেছর। যাত্রীরা ত্যাক্ত-বিত্যাক্ত এবং নিরুপায়। আগে বলেছি, বাগান মালিকদের সমাবেশে ও প্রদর্শনী দেখা হয়ে ওঠেনি, তবে উদ্যোক্তাদের কয়েকজনের সাথে কথা হয়। নারী উদ্যোক্তা সন্ধ্যা মজুমদার জানালেন, সংগঠনটি চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়। সংগঠনের প্রথম নারী উদ্যোক্তা ছিলেন নাসরীন এবি। তিনি এখন ঢাকায় থাকেন, স্বামীর চাকরি বদলিজনিতকারণে ঢাকায় চলে যেতে হয়। সন্ধ্যা মজুমদার তাঁর ছাদবাগান সম্পর্কে জানালেন। তিনি বাহারি ফুলের পাশাপাশি টমেটো, বেগুন, লঙ্কা, ঠাটাশাখ কোমড়া, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, আদা চাষ কনেছেন। মুলক ‘সবুজে বিস্তার’ নামে ফেইসবুকে তাদের এই একটিভিটি। এ পেইজে শুধু চট্টগ্রামে ৩৪ হাজার, ঢাকায় ৩ লাখ ফলোয়ার বা সদস্য আছে। তাদের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘সবুজে গড়ি, সবুজে সাজায়, বেশি বেশি গাছ লাগাই।’
এ পেইজের চট্টগ্রামের প্রধান এডমিন আব্দুর রহিম মজুমদার। মুলত তারা ৭জন এডমিন হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। তারা হলেন, আব্দুর রহিম মজুমদার, নাসরীন এবি, সবুজ রহিম, জামশেদ রুবেল, ফারহানা আজিম, ইমরুল আজিজ ও সোহেল। মডরেটরদের কয়েকজন, ফাহাদ, রহিম ও শ্রাবন্তি। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধো মোহাম্মদ আমিন, জাহিদ ও সন্ধ্যা মজুমদার প্রমুখ। প্রধান এডমিন আব্দুল মজুমদারের সাথে মোবাইলে কথা হয়। তাঁর বাসা কর্নেল হাট বিশ্ব কলোনিতে। একসময়ে বিদেশে ছিলেন জানান। দেশে এসে বাবার সাথে নিজেদের গোসারি দোকান দেখাশোনার পাশাপাশি একটি নগদ/বিকাশের দোকান দিয়েছেন।
তিনি জানান, ‘সবুজে বিস্তার’ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য হলো, নগরে কোথাও যেন একটুকরো জায়গা খালি না থাকে। মাঠে, আঙ্গিনায়, বেলকনি ও ছাদেবাগান করতে নগরবাসীকে উৎসাহ দেয়া। ৩ মার্চ ২০১৭ সালে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয়। ৩ মাস অন্তর অন্তর শীরিষ তলা সংক্ষিপ্তপরিসরে মিলিত হন তারা বাগান মালিক। তাদের ‘স্বপ্ন দেখি’ ইভেন্টেটি ইতিমধ্যে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সারা বছর কাটিং ও লতা নাম মূল্যে বিক্রয় করা হয়। ২ হাজার টাকা মূল্যের এসব মাত্র ২শ’ টাকা দিয়ে নেয়ার সুযোগ হয়। শুধুমাত্র একজন বাগান মালিক এ সুযোগ পেয়ে থাকেন। বাণিজ্যিক বা বেচা-বিক্রি করার সুযোগই নেই। এছাড়া আরো দুটি ইভেন্ট আয়োজন করা হয় শীরিষ তলায়। শীতকালীন সমাবেশটা সবচাইতে বড় হয়। ওই সমাবেশ ‘বুফে’ প্রদর্শনী করা হয়। ইচ্ছে মাফিক একজন বাগান মালিক বিনামূল্যে কাটিং-লতা নিতে পারেন। ঈদ পূর্ণমিলনী মাধ্যমেও বিনা পয়সায় কাটিং সহ অন্যান্য বিনিময় করা যায়। এসব অনুষ্ঠানের জন্য কোনোপ্রকার ফি নেয়া হয় না। এ জন্য বরাদ্দ বা বাজেট নেই তাদের। শুধু প্রধান এডমিনের উদ্যোগে ছোট্ট আকারে একটি ব্যানার করা হয়। অনুষ্ঠানে নিজেরাই সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় করেন। সর্বশেষ হাসতে হাসতে সন্ধ্যা মজুমদার ভেন্টি ব্যাগ থেকে দুটি চকলেট বের করে দিলেন খেতে। হাত বাড়িয়ে নিয়ে হেসেমেতে মুখে দিলাম। ছুঁস ছুঁস করে জিহব্বা দিয়ে তেড়েনেড়ে ছুঁসে খেতে দারুণ তো… বিশেষ করে যতক্ষণ না কথা হয়, ততক্ষণেই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা হয়… তবে ছাদবাগানের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের সংকটকালে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি বিকল্প হিসেবেও রাখা যায়। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা-অতিবৃষ্টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কৃষি ফসলাদি। যার ফলে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। সাথে অসাধু ব্যবসায়ীরাও রয়েছে সুযোগ সন্ধানী হয়ে। সিন্ডিকেটরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মজুদ করে রাখে। এতে সাধারণ লোকজনের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যায় পণ্য সামগ্রী। সামান্য কৃষি পণ্য পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের অস্থিরতায় কেঁপে ওঠে দেশ। একইসাথে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ন্ত্রণহীন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশের তো কোনো লাগামই নেই। ভোজ্য তেল গম, চাউল, চিনি, মসল্লা, জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ হরেকরকমের দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদা থাকে আকাশচুম্বী। এসব সময় মতো যোগান দিতে না পারলে রাজনীতির মাঠ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এতসব চিন্ত করে ছাদবাগানের এই বিকল্প উদ্যোগ। শুধু বেলকনিতে সব্জি চাষে একটি পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মিটানো সম্ভব। ২-৩টি বেগুন গাছ, ভেন্ডি, মরিচ, ঝিঙ্গা, বরবটি-সিম, ধুন্দুল লাগাতে পারলেই হয়। এখন গিরা গিরা মারফা ফলে। সঙ্গে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদও চাষ করা যেতে পারে। আরেকটি বড় পরিসরে ভাবা যায় কি-না; পরিকল্পনাটি নেয়া হলে শতভাগ ফলনের নিশ্চয়তা দেয়া যায়। ধরুন চট্টগ্রামে ৩৪ হাজার বাগানপরিবার রয়েছে। তাদের মধ্যে ১০০০ পরিবারকে এবার এর আওতায় এনে পরিক্ষামুলক উৎপাদনে যেতে পারে। অন্তত এ পরিবারগুলো অর্ধ বছরের চাহিদা মিটাতে নিজেদের উৎপাদিত ফলন দিয়ে। অবশ্য উদ্যোগটি নিতে হবে, নিজস্ব বিল্ডিং মালিকদের। কোনোভাবেই ফ্লাট বাড়ির মালিকদের-এ উদ্যোগ সম্ভব নাও হতে পারে। একজন ফ্লাটবাড়ির মালিকের যেই অংশ ছাদ থাকে ওইটুকু দিয়ে তা কোনোভাবেই সম্ভব না। যেটি বলছিলাম, ধান ও গম উৎপাদনে এগিয়ে আসলে চমক সৃষ্টি হবে। লক্ষ করুণ, বছরে অনায়াসে ৩ বার ফসল করা যায় এ ফসল। অতি বৃষ্টি, খরা ও তুফানেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অতি বৃষ্টি হলে ছাদ প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দিলে হয়। অতিমাত্রা রোদও নিয়ন্ত্রণ করা যায় প্লাস্টিকের চাউনি দিয়ে। যখন যে পরিমাণ পানি প্রযোজন, প্রত্যকের নিজস্ব মটর আছে, সেচও দিতে পারবে পর্যাপ্তপরিমাণ। ঝড়োহাওয়া থেকে রক্ষা করতে স্থায়ীভাবে সাড়ে ৩ ফুট ছাদ দেওয়ালের ঘেরা ওই শঙ্কা দুর হয়। ধান ও গম চাষে মাটি খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। ছাদে প্লাস্টিক বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর ৩ ইঞ্চি পরিমাণ দোয়াশ মাটি দিলেই হয়। ধান ও গমের শেকড় সরু এবং খুব বেশি গভীরে যায় না। এতে ছাদের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। ৩-৪ শতকের একটি ছোট্ট ছাদ থেকে যে উৎপাদন করা সম্ভব, তা দিয়ে একটি পরিবারের চাহিদা অনায়াসে মিটানো সম্ভব। খড় ও খোসা-কুড়া দিয়ে হাঁস-মুরগী ও গরু পালন করতে পারবে। যদিওবা উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ হবে না; দেশের মোট চাহিদার ১০ শতাংশ যোগান দিতে পারলে তাতে মন্দ হওয়ার কথা নয়।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কবি ও কলামিস্ট