শিক্ষক লাঞ্ছনা আর কতদিন? অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে

19

দেশে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বেশ কয়েকজন শিক্ষক লাঞ্ছনা ও খুনের ঘটনায় শিক্ষক সমাজের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়েছে। দেশব্যাপী চলছে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। রাজধানীর নৈকট্যে থাকা সাভারের আশুলিয়ায় স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে (৩৫) জীবন দিতে হয়েছে একই স্কুলের বখাটে ছাত্রের হাতে। ঘটনাটি শুধু মর্মান্তিক নয়, উদ্বেগজনকও। জানা গেছে, নিহত উৎপল কুমার সরকার আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজি ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। প্রতিষ্ঠানটির দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতুর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ। গত শনিবার দুপুরে স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে ওই শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে জিতু। দুইদিন পর সোমবার ভোরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান। শিক্ষক উৎপল স্কুলের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এ সুবাদে তিনি ছাত্রদের বিভিন্ন সময় আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিং করতেন। মেয়েদের প্রতি ইভটিজিংসহ নানা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে শিক্ষার্থীদের শাসন করতেন উৎপল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল, পূর্ব ক্ষোভ থেকেই এ ঘটনা ঘটতে পারে। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর দুস্কৃতকারী শিক্ষার্থী জিতুর দেয়া তথ্য মতে র‌্যাব কর্তৃপক্ষ গণমাদ্যমকে জানান, ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই স্কুলের এক ছাত্রীর সাথে আসামি জিতুর অযাচিতভাবে ঘুরাফেরা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে জিতুকে শিক্ষক উৎপল কুমার নির্দেশ দেন। এই ঘটনায় সে তার শিক্ষকের প্রতি ক্ষুব্দ হয়ে এবং ওই ছাত্রীর কাছে তার ‘হিরোইজম’ দেখাতে গিয়ে শিক্ষকের উপর হামলা করে জিতু। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইদানীং বখাটে ছেলেদের বেপরোয়াপনা লক্ষ করা যাচ্ছে সর্বত্র। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোয় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে কিশোর অপরাধী-সন্ত্রাসীর সংখ্যা। এসব অপরাধী মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ইভটিজিং নামের সামাজিক ব্যাধিতে সমাজে অন্ধকারের বিস্তার ঘটছে। এ মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্তরা কতটা নির্মমতার শিকার ও বখাটেরা কতটা নিষ্ঠুর ও নৃশংস হতে পারে, আশুলিয়ার ঘটনাটি সেটাই পুনর্বার স্পষ্ট করে দিয়েছে। অতীতে বখাটেদের উৎপাত থেকে পরিত্রাণ পেতে সিমি, তিথি, রুমা, তৃষা, পিংকিসহ আরো অনেকে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। বখাটেদের উৎপাতে ইতোমধ্যে অনেক পরিবারই হারিয়েছে তাদের স্বজনকে। বখাটেরা শুধু মেয়েদের উত্ত্যক্তই করছে না, এরা তাদের মা-বাবা-ভাই, এমনকি শিক্ষককে পর্যন্ত হত্যা করে পৈশাচিক উল্লাস করার নজিরও আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ইতোমধ্যে দ্রæত বিচার আইনে ইভটিজিংয়ের অপরাধে কিছু অপরাধী দÐিতও হয়েছে। কিন্তু তারপরও বখাটেদের দৌরাত্ম্য থামছে না। বখাটেপনার এই দৌরাত্ম্য দূর করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের বিকল্প নেই। পুলিশ আইনের ৭৬ ধারা অনুযায়ী বখাটেপনার শাস্তি এক বছরের কারাদÐ ও দুই হাজার টাকা জরিমানা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ নম্বর ধারায় যৌন নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানির শাস্তি ১০ বছরের কারাদÐ। কিন্তু এসব আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বখাটেরা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস অনেকে পান না। আবার অভিযোগ করলেও হুমকি কিংবা প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে অভিভাবকরা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যান। এই সামাজিক অপরাধ ও অনাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। একইসাথে শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধেও বর্তমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানের ৩১ ও ৩২ ধারায় মানুষের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, নিয়ম শুধু অন্যের জন্য, আমি নিয়মের ব্যতিক্রম; বরং এমন ধারণা সঙ্ঘবদ্ধ সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। অথচ সংবিধানের এ ধারা অপব্যবহার করে আজ জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করছে একদল হায়েনা। তাদের জন্য কখনোই আইন কার্যকর হয় না। তারই জ্বলন্ত উদাহরণ ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যার ঘটনা। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতাও শৃঙ্খলা ফেরাতে গিয়ে প্রশাসন কর্তৃক যেমনি শিক্ষক লাঞ্ছনা বাড়ছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং ছাত্রদের হাতে হামেশাই লাঞ্ছিত হচ্ছেন এ দেশের শিক্ষকরা। পত্রপত্রিকা খুললে প্রায়ই দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান সভাপতি, শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ছাত্র অথবা অভিভাবকের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা শিক্ষক।
শিক্ষকের লাঞ্ছনা দূর করতে, ছাত্র, প্রশাসন, পুলিশ ও ম্যানেজিং কমিটির হাতে শিক্ষক নিপীড়ন বন্ধ করতে, শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করতে, শিক্ষকদের পেশার সম্মান ফিরিয়ে আনতে, অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা দূর করতে এখনই অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটি আজ সময়ের দাবি। একই সাথে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শিক্ষকদের ওপর শাস্তি, হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও শিক্ষক লাঞ্ছনা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে সরকার দ্রæত উদ্যোগ নেবে-এমন প্রত্যাশা আমাদের।