রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ঐতিহাসিক রায়, স্ত্রী মিন্নি-সহ ৬ আসামিকে ফাঁসির সাজা!

44

বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় স্থানীয় একটি আদালত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জন আসামির মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। বাকি ১৪ জনের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। দেশের চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম রিফাত হত্যাকান্ডের এ রায়কে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারীই বলা যায়। দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত দ্রুত বিচারের ক্ষেত্রেও এ রায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয় ছিল রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি’র সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়টি। কারণ মিন্নি নিজের স্বামী হত্যা পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে দেশের সর্বত্র মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছিল। মিন্নিকে মামলায় প্রথমে সাক্ষী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পরবর্তীতে তাকে প্রধান আসামি হিসাবে এজহারভুক্ত করা হয় এবং একসময় গ্রেফতারও হন মিন্নি। নানা আলোচনার মধ্যে একসময় হাইকোর্ট থেকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন পান মিন্নি। পরে চূড়ান্ত বিচারে মিন্নিই তার স্বামীর হন্তক হিসাবে সর্বোচ্চ শাস্তি পান। চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যাকান্ডের ঐতিহাসিক এ রায় বুধবার দুপুরে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান ঘোষণা করেন। সূত্র জানায়, হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করেছিলেন মোট ২৪ জন আসামি। এর মধ্যে ১০ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হয়েছে। যারা প্রাপ্তবয়স্ক। বাকি ১৪ জন আসামি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় শিশু আদালতে তাদের বিচার চলছে। প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে অভিযুক্ত দশজনের মধ্যে নয় জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। একজন আসামি পলাতক রয়েছেন বলে জানা যায়।
সরকার পক্ষের আইনজীবী ভূবন চন্দ্র হাওলাদার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে হতাশ মিন্নির আইনজীবী মাহবুব বারী আসলাম। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তারা। এমনটাই জানানো হয়েছে। মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরও বলেছেন তারা রায়ে সন্তুষ্ট নন এবং উচ্চ আদালতে যাবেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনার কলেজ রোডে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে? ওই ঘটনার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ওই বছরের ২ জুলাই হত্যাকান্ডের প্রধান সন্দেহভাজন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা যায়। এদিকে রায় ঘোষণা করে আদালত বলেছে, মিন্নি যে তার স্বামীকে হত্যার ‘ষড়যন্ত্রে’ যুক্ত ছিলেন, সরকারপক্ষ তা ‘প্রমাণ করতে পেরেছে’। প্রথমেই বলা হয়েছে. এ মামলায় কৌতূহল মিন্নিকে নিয়ে। মিন্নি দোষী কিংবা নির্দোষ তার প্রমাণ হবে রায়ের মধ্য দিয়ে। জানা যায়, গত বছর ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে নয়ন বন্ড ও তার বন্ধুরা রিফাত শরীফকে ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ২৭ জুন বরগুনা থানায় নয়ন বন্ডকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। পরে ওই বাদী ৬ জুলাই মিন্নিকে আসামি করার জন্য বরগুনা থানায় একটি আবেদন করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. হুমায়ূন কবির ১৬ জুলাই আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার করেন। ১৯ জুলাই মিন্নি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। মিন্নিকে বরগুনা জেলা জজ ৩০ জুলাই জামিন নামঞ্জুর করলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে হাইকোর্ট ২৯ আগস্ট জামিন দেন। রাষ্ট্রপক্ষ মিন্নির জামিন বাতিল চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেন। চেম্বার জজ ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। সূত্র জানায়, ২ মাস ৬ দিন তদন্ত করে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর দুই খন্ডে ২৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বরগুনা সদর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামি। ১৬ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক উক্ত ১০ আসামির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক, যুক্তিতর্ক খন্ডন ও উচ্চ আদালতের আইন আদালতে উপস্থাপন শেষ হওয়ার পর এ রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারক। আদালত সূত্রে জানা গেছে, রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৭৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা মনে করি এ রায় একাধারে যুগান্তকারী ও মাইলফলক। বিচার না পাওয়া বা বিচার না হওয়ার যে সংস্কৃতির কথা নানা পক্ষ অভিযোগ আকারে উপস্থাপন করে আসছেন, এ রায় তাদের জন্য একটি মুখ্য জবাবও বটে। আমরা কয়েকদিন আগে প্রতারক সাহেদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুগান্তকারী রায় দেখেছি। এ দুটি রায় বর্তমান ঘুনেধরা সমাজের জন্য কঠোর সতর্ক বার্তা হিসাবে বিবেচনাযোগ্য। আমরা আশা করি, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়; এ রায় তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা আশা করি রায় কার্যকরে আইনি প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।