মানসাঙ্ক

107

ছেলেটি আমাদের বাড়িতে রোজ আসে। ভদ্র চেহারার বিনয়ী ছেলে। আমার মায়ের আদর আপ্যায়ন তার থেকেও বেশি অমায়িক। কোনো মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সৌজন্যবোধ দিয়ে আপন করে নেওয়ার কৌশল তিনি ভালো ভাবেই রপ্ত করেছেন। ছেলেটিকে কতোটা বশে আনতে পেরেছেন মা-ই বলতে পারবেন। তার এসব কাজে আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। ছেলেটির প্রতি যেমন অনাগ্রহ, মায়ের কার্যকলাপ আরো বেশি ঘৃণিত। ছেলেটির বাবা মা কেউ নেই। দূরসম্পর্কের কোনো এক মামার কাছে থাকতো। মামার সাথে বনিবনা হয়নি, এরপর নিজের জমানো টাকা দিয়ে ফুলের দোকান নেয়। মাত্র কয়েক বছরেই প্রসিদ্ধ লাভ করে। বিয়ে বাড়ির সমস্ত ফুলের জোগান দেয় সে। বিয়ের গাড়ি সাজানো থেকে শুরু করে যে কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ফুল নিয়ে কারবার করতে হয়। সবার কাছেই এখন তার বেশ নাম ডাক। ধীরে ধীরে নাম ডাকের সাথে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। আমার মা একবার গিয়েছিল ফুল কিনতে, সেই থেকেই ছেলেটার সঙ্গে পরিচয়। কথার আদান-প্রদান, ফোন নাম্বার বিনিময়, বাসায় আসার আমন্ত্রণ। এভাবেই ছেলেটির যাতায়াত আমাদের বাড়িতে। এখন তো সে রোজ দু বেলা আমাদের বাড়িতে খায়। শুধু রাতে থাকে নিজের ফুলের দোকান-ঘরে। মা সেদিন প্রস্তাব করেছিল। আমাদের ড্রাইভারের ঘরটা খালি পড়ে থাকে। এখানেই সে উঠে আসতে পারে। রোজ ঘুমানোর জন্য রাত করে দোকানে না গিয়ে এখানেই যে থাকার সুন্দর বন্দোবস্ত হয়ে যাচ্ছিল, শুধু আমার কারণে সম্ভব হলো না। আমি মায়ের এসব কার্যকলাপে পক্ষপাতিত্ব নই। মা যা করে বেড়াচ্ছেন এসবের ফল কখনই শুভ নয়। আজ সকালেই মায়ের সঙ্গে আমার একচোট লেগে গেল। সেই পুরানো কথাই মা বলে যেতে লাগলেন- ‘যা করছি ভালোর জন্যই। তোর এরকম একটা মেয়ে থাকলে তুইও করতিস। নিজের মেয়ের ভালো আমাকে আগে দেখতে হয়। তোর জন্য চিন্তা নেই। কিন্তু মুনিরার কথাটা একবার ভাব। আমি মরে গেলে ওর ভালো কে দেখবে?’
কীসে যে ভালো আর কীসের মধ্যে যে নিজের মেয়ের অমঙ্গল মা কোনোদিনই টের পান না। আমরা তিনবোন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি সবার ছোট। মুনিরা আমার দুই বছরের বড়। জন্ম থেকেই মানসিকভাবে সে প্রতিবন্ধী। বয়স যত বাড়ছে তার আচরণ ততই শিশুদের মতো হচ্ছে। ছোট থেকেই তার চিকিৎসার কমতি রাখেনি। সে কোনদিনই সুস্থ হয়ে উঠবে না সেকথা মা চিরকালই জেনেছেন। এমন অসুস্থ মেয়েকে কোনো সুস্থ ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার কল্পনা করা আমার মায়ের সবথেকে বড় ভুল। নিজের অসুস্থ মেয়েটার জীবন সে নষ্ট করতে যাচ্ছে। তারচেয়ে বড় কথা, মা যেই ছেলের কাছে নিজের প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আছেন, আসল ব্যাপার মা জানেনই না। ছেলেটি আসে শুধু এই বাড়ির সুস্থ মেয়েটির আশায়। তার অসুস্থ, মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য না। সেই কথা মাকে আমি বোঝাতে পারি না।
দুপুর বেলা। আমি আর মুনিরা ভাত খেতে বসেছি। মা গোসলে রয়েছেন। মুনিরাকে খুব নিচু গলায় বললাম, রায়হানকে তোর কেমন লাগে মুনিরা?
আমার প্রশ্ন শুনে সে খুব ভাবনায় পড়ে গেল। তাকে চিন্তামুক্ত করতে সাহায্য করলাম। বললাম, ওই তো রায়হান, মার্কেটে যার বিশাল ফুলের দোকান আছে? প্রতিদিন আমাদের বাড়ি আসে। আরেকটু পরই তো খেতে আসবে।
মনে পড়ার আনন্দে মুনিরার মুখ থেকে ভাত পড়তে লাগল প্লেটে। বলল, চিনি আমি। আমাদের বাড়িতে আসে।
সে আরো কী কী বলল, মুখে ভাত রেখে কথা পরিস্কার না। শুধু বোঝা গেল- মাঝে মাঝে তাকে চকলেট এনে দেয়। সেই চকলেট সে একটাও খায় না। খোঁজ করবে কোথায় পিঁপড়া আছে, পিঁপড়াকে চকলেট খেতে দেবে। তার ধারণা যেসব পিঁপড়া তার দেওয়া চকলেট খায়, সেই পিঁপড়াগুলো তাকে কামড়াবে না।
আমি বললাম, আচ্ছা মুনিরা তুই রায়হানকে বিয়ে করবি?
এই কথা বলাতে আগের থেকে আরও আনন্দ পাওয়া ভঙ্গিতে মাথাকে দু পাশেই সে একবার করে কাত করল। এবং লজ্জা মেশানো গলায় বলল, করবো বিয়ে।
আমার দুই বছরের বড় বোন। এপ্রিল মাসের সাতাশ তারিখে যার তেইশ বছর পূর্ণ হয়েছে। কত অবলীলায় বিয়ের আনন্দ প্রকাশ করার ভঙ্গিতে মুখ বিকৃত করে ফেলেছে। সে বোঝেই না বিয়ে কী, একজন পুরুষ নিয়ে সংসার কী, এসব করার মতো যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। সৃষ্টিকর্তা সব পূর্ণতা তাকে দান করেন নি।
খেতে বসে আমার চোখ ভিজে উঠল। চোখের পানি গাল বেয়ে প্লেটে পরার আগেই মুছে নিয়ে বললাম, তুই কোনোদিন বিয়ে করিস না মুনিরা। আমি সারাজীবন তোর পাশে থাকব।
মুনিরা বিচলিত ভঙ্গিতে বলে উঠল, তুই রাতে আমার সাথে থাকিস না। তোকে লাল লাল পিঁপড়া কামড়াবে।
সন্ধ্যা হতে না হতেই বাবা আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলেন। রাত আটটার আগে বাবা বাসায় ফেরেন না। আজ তাড়াতাড়ি এসেছেন মাকে নিয়ে বড় ফুপুকে দেখতে যাবেন। তারা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি মুনিরাকে নিয়ে আমার ঘরে বসি। রোজকার রাতের রুটিন অনুযায়ী তাকে সূরা মূলক শেখাই। তাকে বলি, এই সূরা আল্লাহর হুকুমে কবরের আজাব থেকে নিরাপদ রাখবে। কবরের ভয় ভীতি থেকে রক্ষা করবে। পাখির মতো ডানা বিছিয়ে দেবে এই সূরা। মুর্দা পর্যন্ত আজাব পৌঁছাতে পারবে না। মুনিরা হাই তোলে। তার ঘুম পাচ্ছে। তাকে আমি জান্নাতের কথা বলি- জান্নাতের লোভ সামলানো কষ্টকর। চিরকাল থাকার জায়গা জান্নাত। কোনোদিন মৃত্যু আসবে না। জীবন নিঃশেষ হবে না। বার্ধক্য আসবে না। জান্নাত ও জান্নাতীদের জীবন কোনোদিন ফুরাবে না। যদি জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত শর্ষে দানা দিয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়, আর প্রতি একহাজার বছর পর একটি পাখি এসে একটি করে দানা নিয়ে নেয় তবু তো একদিন এই শর্ষে দানা ফুরিয়ে যাবেই। কিন্তু জান্নাত ও জান্নাতীদের জীবন কোনোদিন শেষ হবে না। জান্নাতের গাছ চিরসবুজ, কখনই তা শুকিয়ে যাবে না। তার পাতা কখনই ঝরে পড়বে না এবং ফল কোনো সময়ই নিঃশেষ হবে না। জান্নাতের বিছানায় কোনো পিঁপড়া বা ছারপোকা থাকবে না।
মুনিরা ঘুমচোখে বলল, তাহলে তো জান্নাতেই থাকা ভালো রে মারিয়া।
আমি ডাকলাম, মুনিরা উঠ বোন। না খেয়ে ঘুমাবি না।
মুনিরার সাঁড়া শব্দ নেই। একবার ঘুমিয়ে গেলে তাকে আর ডেকে তোলা যাবে না। রাত দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। বাবা মা এখনো আসছে না। দশটা বেজে যাওয়ার আগেই রায়হান খেতে আসে। সে-ও এলো না। তাকে আমার প্রয়োজন ছিল। কথা বলতে হবে। মায়ের কারণে সুযোগ হয় না। আজ বাড়ি ফাঁকা। বাবা মা কেউ নেই। তাকে যদি বুঝিয়ে বলা যায়, ‘আপনি এই বাড়িতে কোনোদিন আর আসবেন না।’
রাত এগারোটা পয়ত্রিশ মিনিটে তারা এলেন। সাথে কাকে একজন এনেছেন। বাবা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে ফ্যানের নিচে বসলেন সোফায়। শুধু মা আহŸলাদে আটখানা হয়ে বললেন, শোন মারিয়া, খাবার টাবার যা আছে জলদি টেবিলে লাগিয়ে দে। ছেলেটা অনেক্ষণ হলো কিছু খায়নি। দাঁড়িয়ে থাকিস না যা।
আমি প্রশ্ন করবো কোনো সুযোগ পেলাম না। মা ঠেলে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। খাবার পরিবেশন করছি, কিন্তু দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আগন্তুক একজনের দিকে। গ্রামের পরিবেশে বেড়ে ওঠা হাবাগোবা প্রকৃতির এমন সুদর্শন চেহারার যুবকের গল্প বইতে অনেক পড়েছি। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। মাকে বলতে শুনলাম, নিজের বাড়ি মনে করো। লজ্জা পাচ্ছো কেন?
তারপর মা আমার কাছে এসে বললেন, ওর নাম ইলিয়াছ। তোর ফুফুদের গ্রামের বাড়ির ছেলে। খুব ভালো ছেলে। রায়হানের মতো বদমায়েশ না। তোকে বলা হয়নি। রায়হান ফুলের দোকান ফেলে রেখে কোনো এক বড়লোকের মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। মানুষ দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষে, আমি বদমায়েশ পুষেছিলাম। হা করে তাকিয়ে কী দেখছিস? জলদি খাবার দে, ছেলেটা দুপুর থেকে না-খেয়ে রয়েছে।
এসো বাবা, হাত ধোও। এই তো এখানে, এই এখানেই আছে বেসিন। এসো বসো।
ছেলেটি টেবিলে বসে খাচ্ছে। মা বসেছেন পাশের চেয়ারে। তিনি মুগ্ধ আর পরম মমতায় গলে গিয়ে গ্রাম থেকে আসা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আর মনে মনে অঙ্ক করছেন। কী সেই অঙ্ক আমি জানি।