‘লোক প্রশাসনে বৌদ্ধ অনুধ্যায় : পাঠকের অভিমত’

25

সৈকত দে

দুই হাজার পাঁচশো বছর অথবা তারও কিছু আগে প্রাচীন ভারতবর্ষের কোশল রাজ্যেও কপিলাবস্তুর ছোটো প্রদেশে শাক্যদের ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম নেন এক পরম, পুণ্য মানুষ-সিদ্ধার্থ বা গৌতম। ঐতিহাসিক কোশাম্বী মনে করেন: ‘The life of Buddha is well worth a brief sketch, not only to reach the original nucleus buried beneath a mass of later legend but also because of the social picture of his time’ সংক্ষেপে, গৌতম বুদ্ধকে তাঁর জীবন ও কাজের সাপেক্ষে বিবেচনা না করলে ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক পরম্পরা খন্ডিত হবার সম্ভাবনা অনিবার্য। ইতিহাস পাঠক মাত্রই জানেন, বামপন্থী চিন্তক কথিত ‘কমিউন’-এর সূত্রপাত কিন্তু বুদ্ধ প্রবর্তিত ভিক্ষুসঙ্ঘে। মানুষ নিজের চেষ্টায় মহৎ, প্রজ্ঞাবান, দয়াশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং সকল প্রাণের প্রতি যে সংবেদন ধারণ করে আরো উন্নততর, অধিকতর পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারে তার ঐতিহাসিক নিদর্শন গৌতম বুদ্ধ, কুরু, কোসাম্বী, শ্রাবস্তি, মথুরা, ঋষিপতন, গয়া, রাজগীর, বৈশালী, দক্ষিণগিরি, কপিলাবস্তু, কুশীনারা, সঙ্কস্ব ইত্যাাদি প্রাচীন ভারতবর্ষের উত্তর- দক্ষিণের বিভিন্ন স্থান পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেছেন অসংখ্য মানুষকে মুক্তির সন্ধান দিতে। মুক্তির সন্ধান দিয়েছেন বলেই তিনি ‘সাস্তা’ বা ‘শিক্ষক’।
সম্প্রতি একটি বই হাতে এসেছে। বইটি লিখেছেন পন্ডিত, পরিশ্রমী লেখক গবেষক অমল বড়ুয়া। অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনার গ্রন্থটির নাম: ‘লোকপ্রশাসনে বৌদ্ধ অনুধ্যায়’। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ইতিহাস, দর্শন সংক্রান্ত একাধিক প্রকাশনায় তিনি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে পরিচিত মুখ।
লোকপ্রশাসন তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বিষয় হওয়ায় এবং বৌদ্ধ পরিমন্ডলের জাতক হওয়ার কারণে এই বইটি, লোক প্রশাসনে বৌদ্ধ অনুধ্যায় রচনায় তিনি শ্রমের পাশাপাশি প্রাণের স্পর্শ রাখতে পেরেছেন এবং পাঠকসমাজের কাছেও প্রাণের উৎসারণ সঞ্চারিত করতে পেরেছেন ও পারবেন বলেই বইটির মনোযোগী পাঠান্তে আমার বিশ্বাস।
লোকপ্রশাসনের কাঠামোবদ্ধ জ্ঞানের বিদ্যাশিক্ষাকালীন অনুশীলন বইটিকে পাঠ্য করেছে। তিনশো ছত্রিশ পৃষ্ঠার সুদৃশ্য বইটির সূচিতে নজর দিলে আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত সুপরিকল্পিত একটি বই আমরা দেখবো। প্রথম অধ্যায়ে বুদ্ধের সমকালীন ভারতবর্ষ নিয়ে আলোচনা করেছেন বিশদে। বুদ্ধের সমকালের ষোলোটি মহাজনপদের সীমানাবিস্তার ও আর্থসামাজিক অবস্থার বিবরণ আছে। সংঘে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভোট প্রথা এখনকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটগ্রহণের বহু আগেই সৃষ্ট, এ তথ্য আমরা এ অধ্যায় পাঠে পাই।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনামেই গ্রন্থনাম। সম্রাট অশোক ২৬০ খ্রিস্টপূর্বে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম অনুসরণ করেছিলেন তা এ অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য। বুদ্ধের পঞ্চশীল দেশনার কথা মেনে চললে উন্নত নৈতিক চরিত্র অর্জন সম্ভব। যেমন: ‘অঙ্গুত্তর নিকায়ে বুদ্ধ উল্লেখ করেছেন- যখন রাষ্ট্রের শাসক সৎ ও ন্যায়পরায়ন হয়, তখন মন্ত্রীরাও সৎ ও ন্যায়পরায়ন হয়। যখন মন্ত্রীরা সৎ ও ন্যায়পরায়ন হয়, তখন সরকারি নির্বাহীরাও সৎ ন্যায়পরায়ন হয়। যখন নির্বাহীরা সৎ ও ন্যায়পরায়ন হয় তখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সৎ ও ন্যায়পরায়ন হয়। যখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সৎ ও ন্যায়পরায়ন হয় তখন জনগণও সৎ ও ন্যায়পরায়ন হয়।
অতএব, ব্যক্তির সততা ও ন্যায়পরায়নতাই সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত ও জনকল্যানমূলক প্রশাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে’ (পৃ. ৬১)। বুদ্ধ বলেছেন, ‘আসক্তির সমান অগ্নি নেই, দ্বেষ সমান গ্রহ (গ্রাসকারী) নেই, মোহের সমান জাল নেই ও তৃষ্ণার সমান নদী নেই।’
তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই আমরা পড়ছি: ‘প্রাচীনকালে রাজপদ বংশগত ছিল না; লোকে যাকে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত মনে করত, সমাজ রক্ষার জন্য তাকে নিজেদের ‘বিশ্পতি’ বা ‘বিশাস্পাতি’ রূপে নির্বাচিত করত। পৃথিবীর আদি রাজা ‘মহাসম্মত’ অর্থাৎ যাকে সর্বসাধারণ বরণ করেছিল। উত্তর কালে রাজপদ বংশগত হয়েছিল।’
এ অধ্যায়ে নেতা বা রাজা সম্পর্কে বুদ্ধের মতবাদ আলোচিত হয়েছে। রাজার থাকে দশ গুণ, যেমন: দানশীল, পরিত্যাগ, অক্রোধ, অবিহিংসা, ক্ষান্তি, আর্জব (সততা), মার্দ্দব (দয়া) তপ: এবং অবিরোধ। প্রজারঞ্জনের জন্য রাজাকে যে চারটি উপায় অবলম্বন করতে হয় পালিতে তাকে বলা হয় ‘সংগ্রহবত্তু’ এ বিষয়গুলো এই অধ্যায়ে নানা উদাহরণ, অন্যান্য শাস্ত্র অবলম্বনে আলোচিত হয়েছে।
‘সংঘ বা গণ নামক সংগঠন’ চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচ্য, বাকি অধ্যায়গুলোতে বুদ্ধের ধর্ম নগরের প্রশাসন, বৌদ্ধ লোকপ্রশাসনের প্রকৃতি ও ব্যবস্থাপনা, নব লোকপ্রশাসনের সাথে বৌদ্ধ দর্শনের আন্তঃসম্পর্ক, ন্যায়বিচার বৌদ্ধধর্মের বিবেচনায় কেমন হওয়া উচিত তথা মঙ্গলজনক- এসব অনুপুঙ্খে লিখিত হয়েছে। তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়ে, ভিন্ন ভিন্ন আকর গ্রন্থ থেকে গৃহীত তথ্য সুসম্বন্বিত প্রয়োজনে জ্ঞানের পরিধি অতিক্রম করে প্রজ্ঞার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন পাঠক হিসেবে বলা যায়, অন্যান্য জ্ঞানকান্ডের শিক্ষার্থীরা এ গ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠের আনন্দ পাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, একজন মহৎ মানুষের জীবন ও দর্শনের পাশাপাশি আধুনিক রাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচালন কৌশল লোকপ্রশাসন সম্পর্কে বুদ্ধের আদর্শের আলোকে আহরিত জ্ঞানের সুধায় সিঞ্চিত হবে। আমি ‘লোকপ্রশাসনে বৌদ্ধ অনুধ্যায়’ গ্রন্থের লেখক অমল বড়ুয়াকে এই চমৎকার শ্রমশীল কাজের জন্য অভিবাদন জানাই। প্রকাশক অক্ষরবৃত্তকে-ও এমন একটি অবাণিজ্যিক অথচ জরুরি গ্রন্থ প্রকাশের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যালোচক