মানসম্মত উচ্চশিক্ষার অভাব ঘুচাতে হবে

14

গত কয়দিন আগে উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয়েছে। আগামী ১০ মার্চ শুরু হতে যাওয়া মেডিক্যাল কলেজসমূহে ভর্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়নের যাত্রা শুরু হবে। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া একে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিযুদ্ধ চলবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এইচএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের উপর ভিত্তি করে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষার পরপর ভালো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। তবে ফল প্রকাশের পর তাদের বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়, আদৌ তারা মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে কিনা। এর কারণ হলো, ভালো ফলধারী মেধাবী শিক্ষার্থীর তুলনায় মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেগুলোর আসন সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন দেশে উচ্চ শিক্ষার আসন পর্যাপ্ত রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আসন সমস্যা হবে না। মন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক কারণে এক তথ্যে দেখা গেছে দেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার মতো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে আসন রয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ। কিন্তু দেশের ১লাখ, ৭৬ হাজার, ২৮২ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের পছন্দের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল, বুয়েট, চুয়েট, মেডিকেল, নামকরা বড় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ। যাদের সম্মিলিতভাবে আসন রয়েছে সাকুল্যে ৯০ হাজারের মতো। উপরোক্ত সিপিএ-৫ প্রাপ্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা ৯০ হাজার আসনের জন্যই লড়বে। এ হিসাবে গড়ে প্রতি আসনের জন্য অন্তত ৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। অন্যদিকে জিপিএ-৫-এর নিচে কিন্তু ৩.৫-এর উপরে শিক্ষার্থী আছেন ৬ লাখ ৬০ হাজার ২১০ জন। এদের মধ্যে অধিকাংশরই স্বপ্ন থাকবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যায় কিংবা ভালো মানের কলেজে ভর্তি হওয়ার। এ অবস্থায় কঠিন ভর্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই তাদের কাক্সিক্ষত আসনটি অর্জন করতে হবে, যা বলাই বাহুল্য। এ কথা ঠিক, বিশ্বের প্রত্যেক দেশেই উচ্চশিক্ষায় ভর্তির আসন নির্দিষ্ট রয়েছে, এ নির্দিষ্ট আসনই যারা যোগ্য তারা ভর্তি হতে পারবে। এ জন্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ যে নিয়ম চালু করেছে, তাই যোগ্যতার মাপকাঠি হবে।
তবে একথাও সঠিক যে, উচ্চশিক্ষা সবার জন্যও নয়। যৌক্তিক কারণেই সমাজে সব ধরনের পেশার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা মনে করি, এসব বাস্তবতা মাথায় রেখেই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের শিক্ষা কারিকুলামে শিক্ষার্থীর মেধার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন বিভাগে পড়ার সুযোগ করে দেয়। সেই অনুযায়ী শিক্ষার্থী যে ডিসিপ্লেন থেকেই উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়ে বের হবে, তার জন্য সেই ডিসিপ্লেনে কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা এখনও গড়ে উঠেনি। আমরা লক্ষ করছি, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার বা মানবিক কিংবা বিজ্ঞানের যেকোন বিষয়ে গ্রাজুয়েশন নিয়ে ব্যাংকের অফিসার হচ্ছেন অথবা বড় কোন কোম্পানির নির্বাহী হচ্ছেন! এটিই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল পার্থক্যের সৃষ্টি করছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তি সংকটের কথাটি সাধারণভাবে মেনে নিলেও এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই-দেশে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এমনকি দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও বুয়েট, চুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ মাত্র দুএকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মান নিশ্চিত করতে পারছে না। এ অবস্থায় যদি বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রামের স্বীকৃতির (অ্যাক্রেডিটেশন) ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তাও অনেকটাই লাঘব হবে।
এ অবস্থায় দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি ভালো ও মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব ও ভর্তি সংকটের সুযোগে বেসরকারি ও বিদেশি নামধারী বিশ্ববিদ্যালগুলোর তথাকথিত শাখা বা ক্যাম্পাস গড়ে উঠতে দেখা যায়। প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং সেন্টার ইত্যাদির পর শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বাণিজ্যধারায় সর্বশেষ যুক্ত হওয়া দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা মূল্যায়ন ও সার্টিফিকেট নিয়েও অভিযোগ পাওয়া যায়। এ অবস্থায় মানসম্মত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি অভিন্ন পদ্ধতিতে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে উচ্চ শিক্ষায় জীবন ও জীবিকা ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা পদ্ধতি ও নৈতিক শিক্ষা নিয়েও ভাবতে হবে।