ভাষাচিন্তক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

136

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

[সারসংক্ষেপ: বিশ শতকের প্রথমার্ধ্বে চট্টগ্রামের প্রচলিত ভাষা নিয়ে অভিভাষণ-প্রবন্ধ রচনার আদি বাঙালি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৯৪Ñ১৯৫১)। বাঙালির ঐতিহ্য-অন্বেষারও অন্যতম প্রধান পুরুষ তিনি। নবনূর (১৯০৩) প্রকাশকালেই তিনি অবলোকন করেন: ‘বাঙ্গালার ভিন্ন ভিন্ন অংশে বিভিন্ন ভাষা মুসলমান সমাজে চলিয়া আসিতেছে’। তাঁর অব্যর্থ অনুধাবন: ‘এই একতার অভাবই বাঙালির জাতীয় শক্তি বিকাশের একটা প্রধান অন্তরায়’। মধ্যযুগের পুঁথি আবিষ্কার ও বিচার-বিশ্লেষণে তিনি প্রমাণ করেছেন: বাংলা ভাষা হিন্দু-মুসলিম উভয়ের ভাষা; উভয়ের অবদানে বেড়ে ওঠা। আবার আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণ সূত্র অন্বেষণে প্রমাণ করেছেন-এদেশের লোকভাষা, পুথির ভাষা, এমনকি কথ্য ভাষাও বাংলা ভাষা। ভাষা-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ গঠনে ভাষাচিন্তক সাহিত্যবিশারদের অবদান আলোচনাÑদেশে ইতিহাস বিনির্মাণে ও পুনর্গঠনে সহায়তা করবেÑআগামীর ভাষাগবেষকদের প্রেরণা জোগাবে।]
সূচক-শব্দ: বাংলাভাষা, জাতীয় ভাষা, মাতৃভাষা, জাতীয়তা, ব্যাকরণ।
বিশ শতকের শুরুতে বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন অঞ্চলের মুসলমানদের বাঙালি পরিচয়ে পুনর্জাগরণে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন পুঁথি সংগ্রাহক ও গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩)। বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শতবছর আগে জন্মনিয়ে এই ক্ষণজন্মা মনীষী বাংলার হিন্দু-মুসলমানকে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করতে অসাধারণ নিষ্ঠা, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। মধ্যযুগের মুসলিম সাহিত্যিকগণের বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সংগ্রহ করে একদিকে তিনি যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির ভাষা রূপে পরিচিত করে তোলেন; অন্যদিকে বঙ্গজনপদে বেড়ে ওঠা মুসলিম মানসে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ ও মমত্ববোধ জাগাতে অনন্য ভ‚মিকা পালন করেন। পাকিস্তানের ভাষা-বিতর্কে বাংলা ভাষার পক্ষে মত প্রকাশে তিনি প্রবন্ধ লিখেÑবক্তৃতা করে জনমত গঠন করেছেন। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নে এর আঞ্চলিক ভাষা বিশ্লেষণেও অগ্রসর হয়েছেন। সীমিত সুযোগের মধ্যেও প্রমাণ করতে প্রয়াস চালিয়েছেন যে, ‘চট্টগ্রামের ভাষাও বাঙ্গালা ভাষা এবং তাহা একেবারেই নিয়ম পরিশূন্য নহে’ (করিম, ২০১০: ৫৭)। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন,
‘বাংলা ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এর গদ্য কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হয়েছে। মুখের ভাষা থেকে সে উঠে আসেনি, মুখের ভাষার কাছাকাছিও যেতে চায়নি। মার্টিন লুথার গেছেন কৃষকের ভাষার কাছে, রামমোহন রায় দ্বারস্থ হয়েছেন সংস্কৃতের। বাংলা মান ভাষাটা ভদ্রলোকের ভাষা। এই ভদ্রলোকেরা শ্রম থেকে দূরে থাকাটাকে আভিজাত্য বলে মনে করেন; আভিজাত্যের সেই বোধ ভাষা চর্চায় প্রতিফলিত। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দ ভাষা থেকে ক্রমাগত বিতাড়িত হয়েছে; এর চলমানতা বেড়েছে কিন্তু ভেতরের প্রাণসম্পদ বাড়েনি, বাংলা ভাষার মূল দুর্বলতা এর ক্রিয়াপদ। সেটা রয়েই গেছে (সিরাজুল, ২০২১)।
এই দুর্বলতা দূরীকরণে প্রমিত বাংলাকে তার বৈচিত্র্যময় আঞ্চলিক বাংলাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করতে হবে; বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে মান ভাষায় ঠাঁই দিতে হবে। এ কথা আজ থেকে শতবছর আগেই আবদুল করিম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি চট্টগ্রামের প্রচলিত ভাষার ব্যাকরণ-সূত্র সংকলনে ব্রতী হন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর অভিভাষণ প্রসঙ্গে বলা যায়: চাটগাঁ ভাষা অন্বেষার আদি বাঙালি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। এই ভাষণের সম্প্রসারিত রূপ ইসলামাবাদ (১৯৬৪) গ্রন্থটি চাটগাঁ ভাষা চর্চায় এক অনবদ্য সংযোজন। পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানী না হয়েও এ গ্রন্থ রচনাকালে তিনি যেরূপ ব্যাকরণ-সচেতনতার পরিচয় দেন তা প্রশংসার দাবিদার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং এর আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের চিন্তা তাই আজও প্রাসঙ্গিক এবং এর অনুশীলন-অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।
ভাষাচিন্তক আবদুল করিমের অবদান অনুধাবনের লক্ষ্যে উনিশ শতক থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালির ভাষাচিন্তার অবস্থা কেমন তা দেখা যাক। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের শুরু থেকে ১৮৩৬ খি. অবধি এদেশের রাজকার্য মুসলিম শাসনামলের ন্যায় ফারসি ভাষাতেই চলছিল। মক্তব-মাদ্রাসায় আরবি-ফারসি, টোলে সংস্কৃত আর পাঠশালায় সীমিত পারিসরে গণিত ও মাতৃভাষা শেখার সুযোগ ছিল। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাঙালি হিন্দুদের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে বাংলা বিভাগ চালু হলেও সেখানে শুধু ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখানো হতো। ভারতীয় কোনো শিক্ষার্থী সেখানে ছিল না। এখান থেকে প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ মুদ্রণের/প্রকাশের ইতিহাস সৃষ্টি হলেও ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে বাংলা বই প্রকাশ হতে আর দেখা যায়নি। ইতোমধ্যে রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) হাত ধরে ‘আনঅ্যাকাডেমিক’ বাংলাগদ্যচর্চা চালু হয়ে যায়: তাঁর ‘বেদান্তগ্রন্থ’ (১৮১৫), ‘বেদান্তসার’ (১৮১৫), ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭) ইত্যাদি বংলা বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয়দের ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার। পরের বছর (১৮২৪) ঘোষণা করা হয়: এবার থেকে শুধু পাশ্চাত্য শিক্ষায় সরকারি বরদ্দকৃত অর্থ ব্যয় হবে। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কাজকর্মে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি চালু হলে-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সমাজে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি শেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ইংরেজি শিক্ষাকে পাকাপোক্ত করতে সিপাহিবিদ্রোহের বছরেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭)। এভাবে রাজভাষা ফারসির বদলে ইংরেজি প্রচলন ও স্থানীয় ভাষায় পাঠশালা শিক্ষা চলমান থাকলেও বাংলার মুসলমান সমাজ গোটা উনিশ শতক ধরে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে থাকেন। এমনকি বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাদের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় ১৮৮২ খিস্টাব্দে ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের নিকট নবাব আবদুল লতিফ (১৮২৬-১৮৯৩) প্রদত্ত বিবৃতিতে। হান্টার কমিশনকে আবদুল লতিফ জানান যে, বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা হবে উর্দু। শুধুমাত্র নিম্নবিত্ত শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা বাংলা; তবে সেই ভাষাকে আরবি-ফারসি শব্দের বহুল প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামীকরণ করতে হবে। উনিশ শতকের হিন্দুরা পাঠশালায় বাংলা পড়লেও আগ্রহী হননি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছেড়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানোতে। বাংলা ভাষার প্রতি বাংলাভাষীদের এই উদাসীনতার সুযোগে ব্রিটিশ বিভাজন-নীতিতে আসাম রাজ্যে অসমিয়া ও উড়িষ্যা রাজ্যে ওড়িয়া আজ পৃথক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। অথচ আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করবেন যে, ‘বাংলা ভাষার সহিত আসামি ও উড়িষ্যার যে-প্রভেদ সে-প্রভেদসূত্রে পরস্পর ভিন্ন হইবার কোনো কারণ দেখা যায় না। উক্ত দুই ভাষা চট্টগ্রামের ভাষা অপেক্ষা বাংলা হইতে স্বতন্ত্র নহে’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৮৯৮: ৪৭)। আশার কথা চট্টগ্রামের বাঙালিকে বৃটিশ বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবেই সর্বজন স্বীকৃতিসহ আজও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি নিয়ে বহমান।
বিশ শতকের শুরুতেই তাই বাংলাভাষি হিন্দু-মুসলমান সমাজে অনৈক্য সৃষ্টি করবার লক্ষ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তি ভেদনীতি অবলম্বন করে বাংলার উত্তর-পূর্ব-মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলের চারটি কথ্য উপভাষায় প্রাথমিকের পাঠ্যবই প্রণয়নের অপপ্রয়াস চালায়। প্রায় সমকালেই (১৯০৩) ব্রিটিশ পন্ডিত জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের (১৮৫১Ñ১৯৪১) ভারতীয় ভাষাতাত্তি¡ক সমীক্ষাপত্র ‘দ্যা লিংগুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের ৫ম খন্ডে বাংলা ও অসমিয়া ভাষার তথ্য প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি বাংলার উপভাষাকে সাতটি শ্রেণিতে বিশ্লেষণ করেন; অন্যভাবে বলা যায় তাঁর শ্রেণিকরণ ব্রিটিশরা রাজনৈতিক স্বার্থে বিভাজনের কৌশলরূপে ব্যবহার করেন। এর প্রতিবাদে ১১ মার্চ ১৯০৪-এ জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘যে উপলক্ষ্যেই হৌক, দেশের উপভাষার অনৈক্যকে প্রণালীবদ্ধভাবে ক্রমশ পাকা করিয়া তুলিলে তাহাতে যে দেশের সাধারণ মঙ্গলের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়।’ বাংলার উপভাষাকে পৃথকীকরণের বিরোধিতা করলেও বাঙালি কোনো কালেই উপভাষা-বিকাশের বা বাংলার আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্যের বিরোধী নয়। তাইতো পরের বছরই (১৯০৫) রবীন্দ্রনাথ লিখেন:
‘আমরা ভাষাতত্ত¡ মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় উচ্চস্থান অধিকার করি; কিন্তু আমাদের নিজের মাতৃভাষা কালে কালে প্রদেশে প্রদেশে কেমন করিয়া যে নানা রূপান্তরের মধ্যে নিজের ইতিহাস প্রত্যক্ষ নিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে তাহা তেমন করিয়া দেখি না বলিয়াই ভাষারহস্য আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠে না। … বাংলা ভাষার একখানি ব্যাকরণ রচনা সাহিত্যপরিষদের একটি প্রধান কাজ। কিন্তু কাজটি সহজ নহে। এই ব্যাকরণের উপকরণ-সংগ্রহ একটি দুরূহ ব্যাপার। বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে যতগুলি উপভাষা প্রচলিত আছে তাহারই তুলনাগত ব্যাকরণই যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ। আমাদের ছাত্রগণ সমবেতভাবে কাজ করিতে থাকিলে এই বিচিত্র উপভাষার উপকরণগুলি সংগ্রহ করা কঠিন হইবে না’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৯০৫: ৫৪৭Ñ৫৪৯)।
আমাদের আবদুল করিম তখন চট্টগ্রামের আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক (১৮৯৯Ñ১৯০৬) পদে নিযুক্ত থাকার পাশাপাশি পুঁথি সংগ্রহ ও সংগৃহীত পুঁথির পরিচয়-সম্পাদনায় সোৎসাহে সংগ্রামরত। এসময়েই (১৯০৩) তিনি বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের বিশেষ সদস্য নির্বাচিত হন। অনুমান করা যায় এসময় থেকেই তিনি এই ‘দুরূহ ব্যাপারে’ আত্মনিয়োগ করেনÑতাঁর স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি প্রেমের টানে। কেননা এসময়েই বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ গঠনের ফলে বাঙালির চিত্তে স্বদেশপ্রেম এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ সূচিত হয়। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দেলন-সূত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্দীপিত হয়েই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৪-১৯৯৪) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিযুক্ত হয়ে (১৯০৬-১৯১৪) স্কুল-কলেজে বাংলা পত্র চালু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা (১৯১৮) করেন এবং পরের বার ভিসি হয়ে (১৯২১-৯২৩) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ক্লাস প্রবর্তন করেন (শামসুজ্জামান, ২০১১: ১০৩)। বলা বাহল্য, এই দেশপ্রেম ও বাঙালি-জাতীয়তাবাদ আধুনিক ইউরোপীয় পেট্রিয়টিজম ও ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের অনুরূপ। আজ থেকে প্রায় ছিয়াত্তর বছর আগে চুয়াত্তর বছর বয়সে আবদুল করিম তাঁর জয়ন্তী অনুষ্ঠানে (১৯৪৫) সংবর্ধনার জবাবে বলেন, ‘ঘটনার স্রোতের আবর্তনে আমার জীবনে একটা পরিবর্তন আসিয়া পড়ে। আমি আনোয়ারায় গিয়া পড়ি। সেখানেই আমার জীবনের যধষপুড়হ ফধুং অতিবাহিত হয়। সুযোগ পাইয়া চতুর্দিক হইতে প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করিতে করিতে বুঝিতে পারি যে, হিন্দুর মত মুসলমানেরও একটা বিরাট সুগঠিত ও উন্নত প্রাচীন সাহিত্য আছে (করিম, ২০১০: ১০৯)। বাউল শাহ আবদুল করিমের দেশে জন্মনিয়ে বেড়ে ওঠা বর্তমান লেখকও আনোয়ারায় তার ভাষাগবেষণা-জীবনের একুশ বছর এযাবৎ আনন্দে অতিবাহিত করে আসছেন বিধায় ভাষাচিন্তক আবদুল করিমের প্রতি এক অদৃশ্য আত্মিক আকর্ষণ অনুভব করেন। আশ্চর্যজনক মনে হয়: ভাষাবিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান ব্যতীত অন্য কারো আলোচনায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ‘চট্টগ্রামের কথ্য ভাষা’ বিষয়ক কাজের ওপর আলোকপাত আমরা পাইনি। ইসলামাবাদ (১৯৬৪) গ্রন্থের ‘প্রসঙ্গ কথা’-এ সৈয়দ আলী আহসানও স্বীকার করেছেন যে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা সম্পর্কে তাঁর আলোচনা ভাষাতত্ত¡বিদদের দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য। আপাতত সে-আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যাক।
চট্টগ্রামে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ‘চট্টগ্রামের প্রচলিত ভাষা’-র ব্যাকরণ-সূত্র নিয়ে কথা বলেন। তাঁর ভাষায়:
‘চট্টগ্রামের কথ্য ভাষা বড়ই অদ্ভুত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। লিখিত ভাষার সহিত উহার বৈষম্য খুবই বেশি-এত বেশী যে চেষ্টা করিলে আসামীদের মত আমরাও একটা পৃথক ভাষা সৃষ্টি করিতে পারিতাম। … ইতিপূর্বে কেহ কখন ইহার ব্যাকরণ-সূত্র সঙ্কলন করেন নাই। আমি উহার কয়েকটা সূত্র ও নিয়ম লিপিবদ্ধ করিয়া দিলাম’ (করিম, ২০১০: ৫৭)।
এরপর আবদুল করিম ‘চট্টগ্রামের ভাষার ব্যাকরণ বিধি’ উপশিরোনামে কুড়িটি বিধি উদাহরণসহ বর্ণনা করেছেন। ‘উচ্চারণ বিধি’ উপশিরোনামে আরও বারোটি বিধি উদাহরণসহ উল্লেখ করে তিনি তাঁর উপলব্ধি ব্যক্ত করেন অনেকটা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সুরে: ‘এদেশের প্রচলিত শব্দগুলি সংগ্রহ করিয়া প্রকাশ করিতে পারিলে অনেকগুলিই ভাষার সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক এবং ভাষাতত্ত¡ সমালোচকের বিশেষ আদরের বস্তু হইবে,’(আবদুল করিম, ২০১০: ৫৯)। এখানে স্পষ্ট আবদুল করিম অনুভব করতে পেরেছেন যে, চাইলে ‘আসামীদের মত’ চট্টগ্রামের ভাষাকেও আলাদা ভাষা ভাবা যেতো হয়তো; তবু সে-ভাবনা বাঙালি থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভাবনা। ভাষাচিন্তক আবদুল করিম সে-চিন্তাকে সমর্থন না করে বরং এই উপভাষার সম্পদ সংগ্রহ করে বাংলাভাষার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। পরের বছর থেকে (১৯১৯ খ্রি.) আবদুল করিমের অভিভাষণটি আরও বিস্তৃতরূপে প্রামাণ্যচিত্রসহ ‘ইসলামাবাদ’ শিরোনামে সওগাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে (মাঘ ১৩২৫-কার্তিক ১৩২৭) প্রকাশিত হয়। সম্মিলনী ১৩২৭ বঙ্গাব্দ (১৯২০খ্রি.) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘চট্টগ্রামের কথ্যভাষা’ প্রবন্ধ (শরীফ, ১৯৮৭: ৫৮)। সওগাত-এ প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো সৈয়দ মুর্তজা আলী কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে বাংলা একাডেমি থেকে ইসলামাবাদ (১৯৬৪) গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়। আমাদের হাতে ইসলামাবাদ-র বাতিঘর সংস্করণ (২০১৭); এতে চট্টগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে ২৮-৭৮ পৃষ্ঠা নতুনভাবে লেখা যা অভিভাষণে নেই। একইভাবে ৭৯-৯৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ‘চট্টগ্রামের ভাষা’ শীর্ষক আলোচনা নতুনভাবে লেখা, অর্থাৎ অভিভাষণের পরের। ৯৭ পৃষ্ঠা থেকে অভিভাষণের ‘চট্টগ্রামের প্রচলিত ভাষা’ অংশকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে ‘চট্টগ্রামের কথ্য (প্রচলিত) ভাষা’ শিরোনামে আলোচনায় অগ্রসর হয়েছেন, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ থেকে বিস্তর সাহায্য গ্রহণ করবার জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। তবে তাঁর এবারকার বক্তব্যের বিস্তর পার্থক্য লক্ষণীয়:
‘চট্টগ্রামের ভাষাও খাঁটি বাঙ্গালা ভাষা এবং তাহার উচ্চারণ ও গঠন-প্রণালীও একেবারে নিয়ম পরিশূন্য নহে। আমার পূর্বে কেহ কখন ইহার ব্যাকরণ-সূত্র সঙ্কলন করেন নাই। সম্প্রতি বসন্ত বাবু যাহা লিখিয়াছেন, তাহাও সম্পূর্ণ নহে। … আমরা এস্থলে চট্টগ্রামের কথ্য-ভাষার একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ সংকলন করিয়া দিলাম’ (করিম, ২০১৭: ১০০)।
অভিভাষণে সাড়ে তিন পৃষ্ঠার (৫৬Ñ৫৯) আলোচনা এবার একাশি পৃষ্ঠার (৭৯-১৫৯) আলোচনায় পরিবর্ধিত হয়েছে। বাঙ্গালা ভাষার আগে ‘খাঁটি’ বিশেষণ যুক্ত হয়েছে, ‘ইতিপূর্বে’ স্থলে প্রতিস্থপিত হয়েছে ‘আমার পূর্বে’ এবং আগে কয়েকটা সূত্র-সংকলন ছিল এবার তা সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ বলে চিহ্নিত করেছেন লেখক। এবার বসন্তকুমার প্রসঙ্গও আলোচনায় এসেছে যা পূর্বের আলোচনায় ছিল না। এতে প্রমাণিত হয়: আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অভিভাষণই (১৯১৮) চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে প্রথম কোনো বাঙালির আলোচনা এবং তা বসন্তকুমারেরও আগের। তবু বাংলা উপভাষাচর্চার ইতিহাস পাঠে পড়তে হয়: ‘চট্টগ্রামী উপভাষা নিয়ে বাংলাভাষায় বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদ পত্রিকাতেই প্রথম আলোচনা দেখা যায় (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই মনীষী সেই কৃতিত্বের অধিকারী (মনিরুজ্জামান, ১৯৯৪: ৩১৪)। অবশ্য এর কারণও আমাদের কাছে অজ্ঞাত নয়-উদ্ধৃত বাক্যদ্বয় সংযুক্ত প্রবন্ধ প্রকাশ কালে (দ্র. নিসর্গ/৩: ভাষাতত্ত¡ সংখ্যা, ১৯৯৩) সাহিত্যবিশারদ-রচনাবলী (১৯৯৭) কিংবা অভিভাষণ সমগ্র (২০১০) কোনোটাই প্রকাশিত হয়নি। অন্যদিকে মাসিক সাহিত্যপত্র সাধনা (১৯১৯) সম্পাদনাসূত্রে সাহিত্যবিশারদের সহকর্মী আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত¡ (১৯৩৫) পুস্তিকায় সাহিত্যবিশারদের প্রসঙ্গ অনুপস্থিতির চেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা মনে হয় এনামুল হকের চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য-ভেদ (১৯৩৫)। এনামুল হক তাঁর বইটি উৎসর্গ করলেন সাহিত্যবিশারদকে; ১৩টি সহায়ক পুস্তক-প্রবন্ধের তালিকায় সাহিত্যবিশারদের ৬টি প্রবন্ধ-নাম নিলেও ‘ইসলামাবাদ’ কিংবা ‘চট্টগ্রামের কথ্যভাষা’ প্রবন্ধ কেন যে নিলেন না-সে এক বিষ্ময়। যদিও কথ্যভাষা-সম্পর্কিত তাঁর বিশ্লেষণধর্মী ও উদাহরণসহযোগে আলোচনা আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীকেও বিস্মিত করে (আহসান, ২০১৩: চার)। তবু বিষ্ময় কাটিয়ে বিমুগ্ধতা নিয়ে পাঠকরি ভাষাবিজ্ঞানীর বক্তব্য:
‘তবে চট্টগ্রামের উপভাষা বিষয়ে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের আগে কেউ বিস্তৃত আলোচনা করেননি, … পরবর্তীকালে আবদুর রশিদ সিদ্দিকী এবং মুহম্মদ এনামুল হক-এর আলোচনাসমূহ সাহিত্যবিশারদের বিপুল শ্রমে আহৃত তথ্য ও তার যথাশৃঙ্খল ব্যাখ্যাকে ম্লান করতে পারেনি। শুধুমাত্র স্বজ্ঞা দ্বারাই তিনি মাতৃভাষার অর্ন্তশৃঙ্খলা অবলোকনের প্রয়াস পেয়েছিলেন, তার জন্য তাঁকে সুনীতিকুমার কিংবা তাঁর শিষ্য মুহম্মদ এনামুল হকের ন্যায় ভাষাতত্ত্বে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়নি’ (মনিরুজ্জামান, ১৯৯৪: ৩১৮)।
তবু প্রশ্ন থেকেই যায়: আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেননি বলেই কি আবদুল করিমের ভাষাচিন্তা অবহেলিত? বিশেষত বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান-এ তাঁর পরিচয় কেবল ‘সংগ্রাহক ও লেখক’। আবার, তাঁর সন্তানতুল্য-স্নেহে লালিত ভ্রাতুষ্পুত্র লিখিত জীবনীতে: ‘আবদুল করিম কেবল মধ্যযুগে রচিত পুথির সংগ্রাহক, সংরক্ষক, পরিচায়ক, গবেষক ছিলেন না, তিনি নবনূর ও কোহিনূর পত্রিকার রসিক পুস্তক সমালোচক তথা রসগ্রাহী সাহিত্যালোচকও ছিলেন অনেককাল’ (শরীফ, ১৯৮৭: ৫৫)। এখানেও তাঁর আঞ্চলিক ভাষা আলোচনা ও ভাষাচিন্তার কথা অনালোচিত। ইসলামাবাদ গ্রন্থের পরিচিতিতেও তিনি লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের সচিত্র ইতিহাস’ (শরীফ, ১৯৮৭: ৫৫)। অথচ আমরা জানি সওগাত-এ সচিত্র ‘ইসলামাবাদ’ প্রকাশিত হলেও গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় চিত্র পরিত্যাক্ত হয়েছে এবং ১৬০ পৃষ্ঠার গ্রন্থে চুয়াত্তর (৫-৭৮) পৃষ্ঠা মাত্র ইতিহাস এবং বাকি একাশি (৭৯-১৫৯) পৃষ্ঠা ব্যাপী ভাষা-আলোচনা। আলোচনাটিতে তিনি পালি-মঘী-রাঢ়ীয়-আরবি-ফারসি ও পর্তুগিজ ভাষার মিশ্রণে ও প্রত্যক্ষ প্রভাবে চট্টগ্রামের ভাষা কীরকম বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে তার পরিচয় বিশ্লেষণ করেছেন অনেকটা ভাষাতাত্তি¡কের মতো দক্ষতা দেখিয়ে। ইসলামাবাদ গ্রন্থের ৭৯-১৪৩ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘চট্টগ্রামের ভাষা’ এবং ১৪৪Ñ১৫৯ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘দেশভেদে বঙ্গভাষার বিভিন্নতা’ নিয়ে আবদুল করিম সাবলীল আলোচনা-বিশ্লেষণ করেছেন। অবশ্য সাহিত্যবিশারদ স্বীকার করে নিয়েছেন: ‘বঙ্গদেশের নানা স্থানের ভাষার নমুনা ও তৎসম্বন্ধে অনেক কথা পন্ডিতপ্রবর ডক্টর গ্রীয়ার্সন সাহেবের দ্যা লিংগুইস্টিক সার্ভে ওব ইন্ডিয়া নামক গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়াছে’ (করিম, ২০১৭: ১৫৯)। তবু ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক লিখেন, ‘আলোচনার মধ্যে নানাস্থানে গ্রীয়ার্সনের প্রসঙ্গ এনে তিনি বক্তব্য স্পষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু তৎসত্তে¡ তিনি কোথাও গ্রীয়ার্সনের জরিপ পদ্ধতির ওপর পূর্ণত নির্ভর করেননি’ (মনিরুজ্জামান, ১৯৯৪: ৩১৮)। সাহিত্যবিশারদ তাঁর ‘চট্টগ্রামী ভাষা কী ?’ (১৯৪৬) প্রবন্ধে সাধারণের অবগতির নিমিত্ত চট্টগ্রামী ভাষার একটু নমুনা দেন এভাবে-
‘বাঁঅনর পোয়া ভাত খাই আচাইত যাই চায় যে, খালত্তুন সেয়ান গরি উডি তার হৌর ষাঁডত্ হন্ধ্যা গরের। তে তার হৌররে দেই পুছ কৈল্ল যে-অবা, এই খাল কাট্টিল যে মাডিইন কি হৈল্? এই কথা হুনি তার হৌর আর গোস্সায় থাইত্ন পারি কয় যে-ন জানস ঔডা? আধাগ্গিন্ মাডি আঞিই খাই, আধাগ্গিন্ মাডি তোর বাএ খাইয়ে; নয় ক্যা তোরে আঞি মাইয়া বিয়া দিইই!’ (করিম, ১৯৯৭: ৫৯১)।
উদাহরণে ব্যবহৃত একটি বোকা জামাতার গল্পের অংশবিশেষ তাঁর আগে গ্রিয়ার্সন এবং এনামুল হক ব্যবহার করেছেন। সম্প্রতি রবীন্দ্র কুমার দত্ত (২০১২) তাঁর গবেষণা-গ্রন্থের পরিশিষ্টেও এ-গল্প ব্যবহার করেছেন। তবে লক্ষণীয় যে, আবদুল করিম ‘দুরুচ্চার্য’ আঞ্চলিক ভাষাকে বাংলা ভাষার লিপি দিয়ে সাবলীলভাবে প্রকাশের পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন এবং বাংলা ভাষার-ক, খ, গ, হ ইত্যাদি সব ধ্বনির অবস্থান-অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। অথচ বর্তমানে অনেক কবি-সাহিত্যিকÑহন্ডে (কোথায়), গরি (করি), হয় যে (কয় যে), হন হন (কন কন/ কে কে) ইত্যাদি লিখে বাংলা ভাষা থেকে পৃথকতা প্রমাণের প্রয়াস পান। সাহিত্যবিশারদের সমর্থন সেখানে নেই। তাঁর নিষ্ঠার নিদর্শন: গ্রাম্য শব্দ-সংগ্রহ এবং তার অর্থনির্দেশ ও ব্যুৎপত্তি-নির্ণয়। গত শতকের গোড়ায় যখন দেশে শিক্ষার মান তলানিতে তখন আবদুল করিম বলছেন বাংলা ভাষায় শিক্ষা দানের কথা এবং চট্টগ্রামের লোকভাষা বা আঞ্চলিক বুলিকে বাংলার ‘প্রাদেশিক ভাষা’ অভিধা দিয়ে বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবে বর্ণনা-বিশ্লেষণ করেছেন। বর্তমানে শিক্ষার প্রসার ঘটলেও আমরা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে হীনম্মন্যতা কাটাতে পারিনি; আবার অনেকে আঞ্চলিক ভাষাকে পৃথক ভাষা অভিধা দিতে আবেগাপ্লুত। আনিসুজ্জামানের ভাষায়:
‘আমাদের দেশে অনেক উপভাষা আছেÑতার মধ্যে সিলেটি ও চট্টগ্রামির মতো উপভাষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিচারে একধরনের প্রবলতার অধিকারী। অনেককে বলতে শুনি এই উপভাষা তাদের প্রথম ভাষা, প্রমিত বাংলা তাঁদের পক্ষে দ্বিতীয় ভাষা। একথা যাঁরা বলেন তাঁরা ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য বুঝতে চান না। কোনো উপভাষা যে কালক্রমে স্বতন্ত্র ভাষার রূপ পরিগ্রহ করতে পারে না তা নয়। তবে বাংলার কোনো উপভাষার পক্ষে এখনও সে সময় আসেনি।’ (আনিসুজ্জামান, ২০১৩: ২৮)।
বর্তমান বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে বোধগম্যতার দিক থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী উপভাষা হচ্ছে সিলেট-নোয়াখালী-চট্টগ্রামের উপভাষা। এগুলোকে একত্রে ‘প্রান্তবঙ্গীয়’ উপভাষা শ্রেণিকরণে চিহ্নিত করা যায় (শ্যামল, ২০১৮: ৮৯)। কোনোভাবেই পৃথক ভাষা নয় এবং পৃথক ভাষা ভাবা কাক্সিক্ষতও নয়Ñসে-কথা শতবছর আগে আবদুল করিম ইসলামাবাদ-এ জানিয়ে দেন এভাবে, ‘অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করিলে অনুসন্ধানী মাত্রেই বুঝিতে পারিবেন যে আমাদের ভাষার মূল প্রকৃতি বাঙ্গালা ভাষার নিয়ম বহিভর্‚ত নহে’ (করিম, ২০১৭: ৯৮ )। আমরা তাঁর আঞ্চলিক ভাষা আলোচনা-চিন্তাকে চ‚ড়ান্ত বলছি না। বস্তুত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কোনো আলোচনা-গবেষণাই চূড়ান্ত নয়; তবে পূর্ববর্তী গবেষণার পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা থেকেই নতুন গবেষণার পথ বেরিয়ে আসে। পূর্ববর্তী জ্ঞান অসমাপ্ত হলেও অবহেলার নয়-একথা মনে রেখে আবদুল করিমের আলোচনা তাঁর ভাষাচিন্তাকে অধ্যয়ন-পর্যালোচনা প্রয়োজন।
বিশ শতকের গোড়া থেকে বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন পর্যন্ত বাংলার মুসলমানকে জাতীয়তা-সংকট ও মাতৃভাষা-বিতর্ক থেকে মুক্ত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করতে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। যে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। অনেকে মুসলিম জাগরণের প্রান্ত ধরেন নবনূর (১৯০৩) থেকে, কারো কারো কাছে তা অবশ্য বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মুখপত্র শিখা (১৯২৬) থেকে। নবনূর প্রথম বর্ষ আষাঢ় ১৩১০ সংখ্যাতেই আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল করিম লিখলেন, ‘দেশ প্রচলিত ভাষাই কোন জাতির মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা হওয়া উচিত এবং স্বাভাবিক। … বাঙ্গালা ভাষা ত্যাগ করিলে বঙ্গীয় মুসলমানের কোনো মঙ্গল আছে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস নাই’ (করিম, ২০১০: ১৪-১৫)। বলাবাহুল্য বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন-জাত জাতীয়তাবোধ জন্মানোর আগেই সাহিত্যবিশারদের এমন স্বচ্ছ চিন্তা আজকের দিনের অনেক সুশীলের কাছেও অচিন্তনীয়। কলকাতায় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত সপ্তম বর্ষ বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে অভিভাষণে সাহিত্য বিশারদ আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কেন বাংলা এবং কেন তা অপরিবর্তনীয়। তাঁর ভাষায়:
‘মাতার মুখনিঃসৃত ভাষাই মাতৃভাষা। … মাতৃদুগ্ধ যেমন শিশুর স্বাভাবিক খাদ্য, মাতৃভাষাও তেমনই তাহার প্রকৃতি-দত্ত ভাষা। … বঙ্গদেশে হিন্দু সমাজ হউক আর মুসলমান সমাজ হউক, সর্বত্র সে ভাষা এই বাঙ্গালা ভাষা (করিম, ২০১০: ১৮)।
চট্টগ্রামে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে আবদুল করিম ইসলামাবাদের ইতিহাস ও চট্টগ্রামের ভাষাবৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে স্পষ্ট ভাষায় তাঁর সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন: মাতৃভাষার সহায়তা ভিন্ন জাতীয় উন্নতি কেবল সুদূর পরাহত নয়, সম্পূর্ণ অসম্ভব। এজন্য আমাদের শিক্ষার বাহন (সবফরঁস) মাতৃভাষা বাঙ্গালাই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি (করিম, ২০১০: ৭০)। ডেনমার্কের উদাহরণ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমও তিনি বাংলা হবার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এই মতবাদ থেকেই গড়ে ওঠে ভাষা-আন্দোলন; অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা। অথচ শতবছর পেরিয়েও সাহিত্যবিশারদের স্বপ্ন থেকে আমরা যোজন দূরে বাস করছি।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও প্রান্তবঙ্গীয় দু’জন আঞ্চলিক ভাষা-গবেষক ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে বাঙালিকে প্রাণিত করেন। একজন সৈয়দ মুজতবা আলী ৩০ নভেম্বর ১৯৪৭ সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার সপক্ষে অকাট্য যুক্তি তুলে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেন: ‘অসম্ভব কর্ম সমাধান করার চেষ্টা করে মূর্খ, বলদকে দোয়াবার চেষ্টা সে-ই করে যার বুদ্ধি বলদের ন্যায়’ (মুজতবা, ২০১২: ১১৪)। সেই ভাষণটি ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়। আরেকজন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ‘দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান’ পত্রিকায় ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে প্রবন্ধ লিখে বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গঠন করেন। ১৯৪৭-র নভেম্বরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরদানকারী লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সাহিত্যবিশারদ প্রথম স্বাক্ষরকারী (আহসান, ২০১৩: পাঁচ)। সুচরিত চৌধুরী ও মাহবুব উল আলম চৌধুরী সম্পাদিত পূর্ব-পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রথম প্রগতিশীল মাসিক সাময়িকপত্র সীমান্ত (১৯৪৭-১৯৫২)। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলমানদের অধিকার-ঐতিহ্য অন্বেষণ করে সাহিত্যবিশারদ সীমান্ত-র প্রথম বর্ষ ২য় সংখ্যায় লিখেন: ‘মানবজীবনের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী প্রেম-রূপ গুণটিকে কেন্দ্র করিয়া কাব্য-রচনা করিবার কল্পনা কেবল মুসলমান কবিগণই বাঙ্গালা ভাষাকে সর্ব প্রথম দান করিয়া গিয়াছেন’ (করিম, ২০১০: ১৪৮)। এভাবে মানবীয় প্রেমের মাহাত্ম্য কীর্তন করে একদিকে আবদুল করিম ধর্মান্ধ হিন্দু-মুসলমানকে আধুনিক মনের উদারতার ছায়ায় ডেকেছেন। আবার, বাংলা সাহিত্যে মুসলমান-অবদান আবিষ্কার করে তিনি বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট মোছন করেছেন। বাংলা ভাষা সম্পর্কে মুসলমানের হীনম্মন্যতা যেমন দূর করেছেন তেমনি তিনি হিন্দুদের বাংলা ভাষার প্রতি একক আধিপত্যের দর্পচূর্ণ করেছেন। একই সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি অসাম্প্রদায়িক রূপ দাঁড় করানোর সমাজভাষাতাত্ত্বিক দায়িত্ব পালন করেছেন অসীম আন্তরিকতার সাথে।
ভাষাচিন্তক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বিরোধী ভাষাচিন্তার লোকও ছিল বাংলাদেশে এবং এখনও আছে বৈকি। অপ্রিয় হলেও সত্য তাঁর স্বপ্ন-মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় শিক্ষাদান-আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আবার অনেক ভাষাচিন্তা আলোর মুখ দেখেছে তাঁর সমকালে; আন্দোলন গড়ে ওঠেছে, জাতীয়তাবাদী চেতনা জেগেছে। কিন্তু সে-চেতনার জোয়ার আমরা ধরে রাখতে পারিনি। হয়তো প্রকৃতির নিয়মে চেতনা-স্রোতেও জোয়ার-ভাটা আছে। আবার হতে পারে আবদুল করিমের অগ্রসর ভাষাচিন্তা ধারণে আমরা আজও প্রস্তুত নই। অনুমান করা যায় একারণেই হয়তো আজহারউদ্দিন খান তাঁর লিখিত ‘সাহিত্যবিশারদ জীবনী’র নাম রেখেছেন ‘মাঘ নিশিথের কোকিল’। মাঘ-নিশিথে আমরা তাঁর ভাষাচিন্তা পাঠ করি আর ভাবি অচিরেই বসন্ত আসবে। শিমুল-পলাশ ফুটবে আর বাংলা ভাষা সসম্মানে সর্বস্তরে প্রচলিত হবে-বাংলার জয় হবে। মুখে জয় বাংলা স্লোগান দিলেও আজ আমরা লোকভাষাকে ভাবি সাধারণের-আমজনতার, আঞ্চলিক ভাষাকে ভাবি গেঁয়ো, বাংলা ভাষাকে বলি দেশি ভাষা। আর ‘অসাধারণ’ আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে ইংরেজি শিখিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক রূপে গড়তে সর্বস্ব বিনিয়োগ করে ওদের শিকড় বিহীন করতে ব্যস্ত। আরেক দল পরকালের পরিতৃপ্তির লোভে প্রজন্মকে ধর্মীয় ভাষা শেখানোর অপপ্রয়াসে অধীর আগ্রহী। এমন বাস্তবতায় ভাষাচিন্তক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আমাদের অনন্য আশ্রয়। তাঁর ভাষাচিন্তার উৎস-দেশপ্রেম থেকে জাত বাঙালি জাতীয়তাবাদ-ই আমাদের বিশল্যকরণীর ভূমিকা পালন করতে পারবে। সর্বোপরি, জাতীয় জীবনের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশের ধারায় সাহিত্যবিশারদের ভাষা-ভাবনা ও জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক জীবনদর্শন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষিত হয়ে সংযোজিত হতে পারবে।

সহায়কপঞ্জি
আনিসুজ্জামান (২০১৩)। সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিসাধক। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লি. ঢাকা।
আবদুররসিদ ছিদ্দিকী (১৯৩৫)। চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত¡। চকরিয়া, চট্টগ্রাম।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯৯৭)। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচনাবলী (১ম খন্ড)। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (২০১০)। অভিভাষণ সমগ্র (ইসরাইল খান সম্পাদিত)। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (২০১৭)। ইসলামাবাদ। বাতিঘর, চট্টগ্রাম।
আবুল আহসান চৌধুরী (২০১৩)। ‘ভ‚মিকা’, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচনাবলী (৩য় খন্ড)। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
আহমদ শরীফ (১৯৮৭)। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (জীবনী)। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯১৯)। ‘চট্টগ্রামে প্রচলিত বঙ্গভাষা’, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা। ২৬ বর্ষ ২য় সংখ্যা, কলিকাতা।
মনিরুজ্জামান (১৯৯৪)। উপভাষা চর্চার ভ‚মিকা। বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
মুহম্মদ এনামুল হক (১৯৩৫)। চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য-ভেদ। কোহিনূর লাইব্রেরি, চট্টগ্রাম।
রবীন্দ্র কুমার দত্ত (২০১২)। নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ। প্রগ্রেসিভ পাবলিসার্স, কলকাতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৯৮)। ‘ভাষাবিচ্ছেদ’, শব্দতত্ত¡। বিশ্বভারতী, কলকাতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০৫)। ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’, রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খন্ড)। পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা।
শামসুজ্জামান খান ও অন্যান্য (২০১১)। চরিতাভিধান। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
শ্যামল কান্তি দত্ত (২০১৮)। সিলেটের উপভাষা: ব্যাকরণ ও অভিধান। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (২০২১)। ‘সাক্ষাৎকার’। সালেক নাছির উদ্দিন, ভোরের কাগজ (২৩ জুন, ২০২১), ঢাকা।
সৈয়দ মুজতবা আলী (২০১২)। শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (আবদুশ শাকুর সম্পাদিত)। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।

লেখক পরিচিতি: ভাষাবিজ্ঞানী ও কবি, সহকারী অধ্যাপক, সিইউএফ কলেজ, সিইউএফএল, আনোয়ারা, চট্টগ্রামÑ৪০০০
মুঠোফোন: ০১৭১২-১৩০৭৪৭।