বিদায় ২০২১

18

 

আজ লাখো মানুষের কৌতুহলকে সঙ্গীন করে গোধূলি সন্ধ্যায় পশ্চিমা আকাশে ২০২১ এর শেষ সূর্যটি অস্ত যাবে, এর সাথে বিদায় হবে একটি বছরের। বিদায় ২০২১। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, আপন গতিতে বহমান সময় কখন যে ফুরিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। ২০২১ও তেমনি। ৩৬৫ দিনের বছরটি চোখের পলকে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এ বিদায়ক্ষণের অবস্থা বর্ণনায় একজন লেখক বলেছেন, সময় পুরায়নি, বরং সময় এসেছে দেনা-পাওনার হিসেব চোকানোর। আর এই দেনা-পাওনার হিসেব হচ্ছে মানবীয় জীবনের। যে সঙ্কল্প নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম, এ বছর তা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি? কতটুকু অন্যের প্রতি মানবিক হতে পেরেছি? নিজ নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধ পালন করতে পেরেছি কতটুকু? আজকেই উপযুক্ত সময় একটু পেছনে ফিরে তাকানোর। আর সেই পেছনে ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের কিছু প্রশ্নের সাহায্য নিতে হবে। মনে রাখতে হবে পেছনে ফিরে তাকানো মানে এই নয় যে, পেছনে পড়ে থাকা। এই পেছনে ফিরে তাকানোর মাধ্যমে আগামীতে সামনের দিকে চলার জন্য গতি পেতে সাহায্য করে। ইংরেজিতে বলে Looking Back, looking Ahead. কম বেশি সবার কাছে দূরে থাকা, বিচ্ছিন্নতা, আতঙ্ক, মহামারির একটি বছর ছিল ২০২১। অনেকে জড়তা, ভয় ও শঙ্কাকে পাশে ঠেলে আবার জাগছে সব নতুন স্বাভাবিকতায়।
এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, গত বছর ২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশ্বের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছিল ‘ঝুঁকি’ শব্দটি। বৈশ্বিক ঝুঁকি আগেও ছিল। তবে করোনা নামের এক ভাইরাস যেন ঝুঁকি মোকাবেলা অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। কত যে জটিলতায় আক্রান্ত বিশ্ব এখন। প্রথমত, কতদিন স্থায়ী হবে এই করোনা, তা নির্ণয় করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির নেতৃত্বের পটপরিবর্তন, আফগানিস্তানে তালেবানের ফিরে আসা, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার হামলার মতো ঝুঁকি, রোহিঙ্গা সংকট। আমাদের দেশে করোনার ভ্যাকসিন চলে এলেও ইতোমধ্যে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ চোখ রাঙাচ্ছে। চলছে অস্থিরতার মাঝে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ধাপ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। এর সাথে চট্টগ্রাম মহানগরীতে নালা-ড্রেনে পড়ে মৃত্যু ঘটনা, জলাবদ্ধতার দুঃখও মুছা গেল না। করোনার মহামারির প্রতিঘাতে এখনও চলছে শ্রমবাজারের অস্থিরতা। অনেক শ্রমিকই স্থান পরিবর্তন করেছেন। প্রণোদনার সঠিক বণ্টনসহ নানা বিষয়ে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে, যেমন- জ্বালানির দাম বৃদ্ধি- এমন ঘটনাও দেখা গেছে। তবে ২০২০ সালের ন্যায় করোনার ফলে অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়নি ২০২১-এ। মানুষের চলাচল ব্যাহত হলেও কর্মীরা ছিল সক্রিয়। যদিও কাজের সুযোগ ও পরিধি অনেকটা সঙ্কুচিত হয়েছে। অনেক মানুষকে বেকারত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনেকে ঝরে পড়েছে। ইতোমধ্যে সমাজে এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
২১ মানে অপ্রতিরোধ্য, দুর্বার, ভেঙ্গে করে চুরমার। তারপরও করোনার ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি টগবগে ২০২১। তার মানে এই নয় যে, ২১ তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছিল। ২০২১-এ আমারা পালন করেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বিজয়ের ৫০ বছরে পালন করেছি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় আমাদের ডিজিপির হার তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক দিকে ধাবিত হয়েছে। আবার অস্থিরতার ঘটনাও কম নয়। রাজনীতির অঙ্গনে বিরোধী দলসমূহের বাকযুদ্ধ, বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বাজারে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিতে ভোক্তার দুর্ভোগ, ধারাবাহিকভাবে বাস দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রাণ সংহার- যার ঘা এখনও শুকায়নি। বছরশেষে সুগন্ধা নদীতে চলন্ত লঞ্চে অগ্নিকাÐে নির্মম হতাহতের ঘটনাটিও মর্মান্তিক। সবটা মিলিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২১ বেশ ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যমূলক একটি বছর ছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। নানা ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছিল, ঘটেছিল উত্থান-পতন। তারপরও এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এ একুশে বর্তমান সরকারে ভিশন ২০২১ এর পূর্ণতা পেয়েছে। আর এভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলার ফলে বিশ্বের কাছে ঈর্ষণীয় হতে পেরেছি আমরা।
ভালমন্দ, আনন্দ, বেদনার স্মৃতিগুলো আরও একবার রোমন্থন করা, একইভাবে জীবনের সব ধরনের নেতিবাচক বিষয়গুলোকে দূরে ঠেলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় নতুন করে পথ চলার প্রত্যয় ব্যক্ত করার সময় এখন বছরের দ্বারপ্রান্তে। আর মাত্র দু’চার দিন। তারপরই ২০২১ আমাদের জীবন থেকে শেষ। যার যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ভাবনায় বছরটি নানাভাবে মূল্যায়িত হতে পারে। তবে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে যাত্রা শুরু করেছে, তা অব্যাহত থাকবে নতুন বছরেও-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের। বিদায় ২০২১, স্বাগতম ২০২২।