বান্দরবানে দু’দিনে তিন ব্যাংক লুট সন্ত্রাসীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে

7

পার্বত্যজেলা বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় পৃথক ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার দুপুরে পৃথক পৃথক সময়ে এই ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটে। কৃষি ও সোনালী ব্যাংকে এ লুটের ঘটনা ঘটে। সূত্র জানায়, ব্যাংক দুটি থেকে টাকার পাশাপাশি লুট করা হয়েছে ১৪টি অস্ত্রও। মঙ্গলবার সোনালি ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে অপহরণ করা হয়েছে। গত দু’দিনে তিন ব্যাংক লুটের ঘটনায় দেশজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষকরে, ব্যাংক পাড়াগুলোতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে তিন ব্যাংকের লুটের ঘটনায় জড়িতদের কাউকেই পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। অপরদিকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে উদ্ধারে যৌথবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। স্বাধীনতার পর দেশের ইতিহাসে প্রকাশ্যে ব্যাংক লুটের ঘটনা এটিই প্রথম বলে ধারণা। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া অপরাধ প্রবণতা এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারার খেসারত দিতে হচ্ছে রুমা ও থানচির সাধারণ মানুষকে। এ এলাকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ আতঙ্কিত ও শঙ্কিত।
এদিকে সোনালী ব্যাংকের এজিএম ওসমান গনির সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকাল থেকে বান্দরবানের ছয়টি উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এজিএম ওসমান গণি গণমাধ্যমকে জানান, থানচি ও রুমায় ব্যাংক ডাকাতি হওয়ার পর নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সব ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। টানা দুদিনের ব্যাংকে হামলায় বান্দরবানজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বিভিন্ন উপজেলায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশের টহল বৃদ্ধি করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা শাখা নিশ্চিত করেছে, এ ঘটনার সাথে বান্দরবানের রুমায় সৃষ্ট নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) জড়িত। সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে বান্দরবানের রুমায় নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা ও ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে তুলে নিয়ে যায়। তবে ব্যাংকের ভল্টে সুরক্ষিত টাকা অক্ষত রয়েছে বলে সিআইডি সূত্রে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে কেএনএফের ৭০ থেকে ৮০ জন সশস্ত্র সদস্য রুমা উপজেলা পরিষদ এলাকা ঘেরাও করে। তারা সোনালী ব্যাংকে গিয়ে পাহারারত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং মারধর করতে থাকে। ব্যাংকে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। শুধু তাই নয়, তারা ব্যাংকের পার্শ্ববর্তী মসজিদের ডুকে মুসল্লিদেরও মারধর করে তাঁদের মুঠোফোনও নিয়ে গেছে। অপরদিকে বুধবার দিনেদুপুরে থানচি উপজেলা শহরের সোনালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি হয়েছে। থানচি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অং প্রু ম্রো বলেন, বেলা একটার দিকে থানচি সদরের শাহজাহানপুরের দিক থেকে তিনটি চাঁদের গাড়িতে করে সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাজার এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর থানচি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে নগদ টাকা যা পেয়েছে তা নিয়ে চলে যায়। এরপর তারা আবার ওই তিন গাড়িতে করে শাহজাহানপুরের দিকে চলে। থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন জানান, সোনালী ও কৃষি ব্যাংক লুট হয়েছে। তবে টাকার পরিমাণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফাঁকা গুলিবর্ষণ ও বাজারের লোকজনের কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
সূত্র জানায়, ঘটনার ১৪ ঘন্টা পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করেছে। তবে এই ঘটনায় বুধবার (৩ এপ্রিল) সকালে জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এবং পৃথক ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা যায়। রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম বলেন, সোনালী ব্যাংকের থানচি শাখায় হামলার খবর পেয়েছি। পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গেছে। তারা কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, এর আগে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে বান্দরবানের রুমায় নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা ও ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে বলে খবর পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, বান্দরবানে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটান। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিপূর্বে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেলপাড়ায়। বৈঠকে কেএনএফ আর সন্ত্রাসী তৎপরতা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ওই বৈঠকের পরও রুমা উপজেলা সদরসংলগ্ন বম জনগোষ্ঠীর বেথেলপাড়া, মুনলাইপাড়া, এডেনপাড়াসহ বিভিন্ন পাড়ায় কেএনএফের সদস্যরা আশ্রয় নিয়ে ছিল। কিন্তু ব্যাংক লুটের ঘটনায় তাদের তৎপরতা কমেনি বলে ধারণা করা যায়। আমরা মনে করি, ব্যাংক লুটের মত ঘটনার পর জড়িত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা অতীব জরুরি। অন্যথায় পাহাড়ি এলাকা আবারো অশান্তি বৃদ্ধিপাবে।