নিলাসংক্রান্তি

95

নৈরাশ্য ও অবসাদের ঘন কালো নৌকায় নিরন্তর ভাসতে ভাসতে জীবন সম্পর্কে কিশোরকাল থেকে অর্জিত ধারণাই পাল্টে গেছে নিলার। মনে হয়, মাথামুন্ডুহীন এই যাপিত জীবন। মানেবিনে সময়ের সোপান বেয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সম্মুখপানে পথ চলা। কোন দ্যোতনা নেই, ব্যঞ্জনা নেই, উচ্ছ¡াস নেই। পানসে ঠেকে সবকিছু। চলার পথের লালিত্য উবে গেছে সেই কবে। প্রচুর খানাখন্দযুক্ত বেসুরো জীবন ওকে নিয়ে গেছে হতাশার অতল গহŸরের পাড়ে। জীবনের এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যাপক শিলাঝড়ে নিলা বিধ্বস্তপ্রায়। শনির দশা পিছু ছাড়ছে না ওর, লেগেই আছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, ঝড়-ঝাপ্টা, রিটা সখিনা ফণি প্রবল বেগে বয়ে গেছে ওর উপর দিয়ে। গভীর ক্ষত রেখে গেছে মনের সুকোমল দেহে। সেই দগদগে ঘা নিয়ে আনন্দ বঞ্চিত হয়ে পাথরসময় যাপন করছে নিলা। পাচ্ছে না বেঁচে থাকার কোন মানে। উজ্জ্বল হাসির আলো মুছে গেছে শিশিরসিক্ত সবুজ ঘাসের মত একদা সতেজ ও প্রাণবন্ত পুষ্পমুখ থেকে। এখন প্রতিনিয়ত উদাসী হাওয়ায় নিলা বিভোর থাকে একা একা। আনন্দেরা ডানাও মেলে না, ওকে উড়িয়েও নিয়ে যেতে পারে না। নিঃসঙ্গতায় ডুব দিয়ে থাকে অহর্নিশি। আর কারো ঠাঁই হয় না সেখানে। নিলা সদয় হয় না। ভয় পায়। ভয় কেবলই তাড়িয়ে বেড়ায় ওকে।
শামুকের মত আপন খোলসে চুপটি মেরে গুটিয়ে থাকে নিলা। যখন প্রয়োজন হয় মাথা বের করে বাইরের জগতের দিকে চোখ মেলে তাকায়। কাজ শেষ তো আবার শামুক হয়ে যাওয়া। এই এভাবেই এখন সময় কাটছে ওর। এতেই যেন স্বস্তি। আর স্বস্তিতেই বোধ করি শান্তি।
একে ওকে ধরে গাঁটে কুড়ি কুড়ি কড়ি গুঁজে দিয়ে কোনরকমে একটা চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে নিলা। ছোট ছোট বাচ্চাদের পাঠদানের কাজ। সদ্য গড়ে উঠা স্থানীয় একটা স্কুলে টিচার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে ও। মাসিক সম্মানী যথেষ্ট নয় বটে। কিন্তু সময় বেশ কেটে যায়। মায়ে-ঝিয়ের সংসারে প্রশান্তির হাওয়া লাগে খানিকটা। নিলাও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
বাবা সারা হয়ে গেছেন আজ বছরখানেক হতে চলল। বেশ কিছুদিন ধরে রোগে-শোকে-বাতে কাত হয়ে ছিলেন তিনি। আপন কোন ভাই না থাকায় অষুধ ডাক্তার বৈদ্য হাসপাতাল সবকিছু করতে হয়েছে নিলাকেই। কষ্ট হলেও প্রয়োজনমত দৌড়ঝাঁপ দিতে কসুর করেনি ও। এ ডাক্তার ও ডাক্তার করেছে। হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে বাবাকে। রাত জেগে পাশে থেকেছে। সময়মত ওষুধ খাইয়েছে। সেবা করেছে মন-প্রাণ ঢেলে, দিল উজাড় করে। আপনার দিকে না তাকিয়ে আরাম ও ঘুমকে ধুম করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিনরাত খেয়াল রেখেছে বাবার। এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি অবশ্য। বাবা ফাঁকি দিয়ে নিরাকার সরণি বেয়ে চর্মচক্ষুতে দৃশ্যমান নয় এমন গাড়িতে চড়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। মরণের সমন জারি হওয়ার পূর্বে এক বিশাল প্রস্তরখন্ড উড়ে এসে সশব্দে আছড়ে পড়ে তাঁর বুকের মধ্যেখানে। তাতে কাঁচের টুকরোর মত ভেঙ্গে গুঁড়িগুঁড়ি হয়ে গেছে তাঁর মনবস্তুখানি। সাথে হাড়গোড়, পাঁজর সব। চোখের জলে দেখে গেছেন তাঁর অল্পবয়সী আদরের মেয়েটার বিধবার বেশ যে কিনা বছর দেড়েক সংসার করার পর অপয়া খেতাব পেয়ে অপমানের সাথে বিতাড়িত হয়েছে শ্বশুরালয় থেকে। তিনি ছিলেন সরকারী চাকুরে। তাঁর পেনশানের টাকাটা এখন মা তুলছেন। ওই টাকা ও নিলার স্কুল থেকে পাওয়া টাকায় দুজনের সংসারটা চলে যাচ্ছে কোনরকমে। স্বচ্ছলতা বলতে যা বোঝায় তা না থাকলেও অনটন নেই। কারো কাছে হাত পাততে হচ্ছে না অন্তত।
নিলা ভাবতে চায় না। ভাবনা তবু সরু তার বেয়ে এসে আততায়ীর মত হানা দিয়ে যায় মাঝে মাঝে। এত এত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার তাড়না কেন তার জীবনে? ওর দুঃখ-জলের নদী কোথায় গিয়ে শেষ হবে? এমন কোন দয়ালু বান্ধব কি আছে ইন্ডিয়ার মত যে একটা ফারাক্কা বাঁধ তৈরী করে দেবে? ওর প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে মরা সরু খাল হবে? দুঃখ-দুর্দশার অবসান হবে? এসব নিয়ে চিন্তা করতে গেলে দুশ্চিন্তা বই আর কিছুই প্রাপ্তিযোগ হয় না। তখন কান্না আসে চোখে। উত্তেজনা বাড়ে, টেনশান হয়। এসব থেকে দূরে থাকতে চায় নিলা। পরে আবার প্রেসার-ট্রেসার হয়ে গেলে বাড়তি যন্ত্রণা। অতিরিক্ত টেনশানে আজকাল স্ট্রোকও করে বসছে অনেকে। সইতে না পেরে কেউ কেউ পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিচ্ছে চরম অনিচ্ছায়, আবার কেউ বা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করছে চিরতরে।
অবশ্য মানুষ তো সবকিছুর নিয়ন্তা নয়। তাই না চাইলেও টেনশান কাজ করে যায় মনে। ডিস্টার্বিং এলিমেন্টস এসে হাজির হয় আপনা থেকেই। দেখা দেয় তাদের অযাজিত উৎপাত। কিছু করার থাকে না।
সেদিন চলার পথে হঠাৎ দেখা পিন্টুর সঙ্গে। আচমকা সাপ দেখার মত ভড়কে গেছে নিলা মনে মনে। ও না দেখার ভাণ করে তাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। পারেনি। পিন্টু যেচে সামনে এসে হাজির।
‘কেমন আছ ভাবীজাআআন?’
দুষ্ট লোকের ক্রুর হাসি হালকা সরু গোঁফের নিচে ঝুলিয়ে পিন্টুর কুশলাদি জানার ধরণ-ধারণ দেখে নিলার গা গুলিয়ে আসে। দেহভঙ্গি সারমেয় তুল্য। আর চোখ জোড়ায় খেলা করে আদিরসের ভাষা। অনভ্যস্ত চোখে তা দেখে বমির উদ্রেক হয় নিলার। ও বমি করেই দেবে মনে হচ্ছে। না হয়নি, ভাগ্যিস।
নিলাকে লালস চোখে পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে পিন্টু বলল,‘যা একখান না মাইরি! আহ, না জানি কত সুখ হবে সাঁতারে বরষায় টইটুম্বুর ওই ভরা গাঙ্গের জলে! আমি আবার ভাল সাঁতারু কিনা। হার-না-মানা ডুবুরিও বটে। সেদিন এর প্রমাণ দিতে পারিনি। তবে কোন একদিন নিশ্চয় পারব। সেই সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় আছি আমি। খাতিরের নাম খেসারত হবে না আর। সেই ভুল আর করব না। ভাল থেকো। আরো সুন্দর হয়ো। বাই।’
যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়েছে, কী মনে করে আবার পিছিয়ে আসে উপদ্রবটা। ‘এত পড়াশোনা, এত বুদ্ধি তোমার। এই ছোট্ট কথাটা তোমাকে ধরতে পারল না, সহিলে সম্পত্তি নহিলে বিপত্তি। ইচ্ছেয় হউক বা অনিচ্ছায়, সেদিন যদি আমার ক্ষুদ্র আবদারটাকে আদর আপ্যায়ন করতে ঠিকঠাক মত, যথেচ্ছ ইন্দ্রিয় সুখ দিয়ে আমার স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে সবল ও প্রবল আলোড়ন তুলতে তবে তোমাকে আমি রাজরাণী হয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিতাম। এই বেহাল অবস্থায় তোমাকে পড়তে হত না। তোমার বাবাও স্ট্রোক করে পটল তুলত না।’
যেতে গিয়ে আবার পিছিয়ে আসে পিন্টু,‘সৌন্দর্যের লীলাভূমি তোমার ওই লালাখালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি একদিন না একদিন বুকে জ্বালা ধরাব। সুন্দরের মোড়কে অসুন্দরের খেলায় মন দেব। বাউলদের মত একতারা বাজিয়ে রসের বন্দনায় মেতে উঠব। আর দিল উপুড় করে তোমাকে প্রেম দেব, ওটার আঠা আঠা জলে ভিজিয়ে নেব দেহ মন গায়ের বসন। মাইন্ড ইট।’
পিন্টু হচ্ছে গিয়ে নিলার দেওর। এই তিলে খচ্চর লোকটির জন্যই নিলা আরো বেশি অপমানিত হয়েছে শ্বশুরবাড়িতে। স্বামী দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন পর নিলা বাড়িতে একা একদিন। হঠাৎ কোত্থেকে ভূতের মত এসে হাজির পিন্টু। তখন অপয়া বলে প্রতিদিন নিলাকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা করা হচ্ছিল। ওই প্রসঙ্গ টেনে পিন্টু খুব নরোম গলায় সুন্দর কথায় ওর সমব্যথী হল এবং এ থেকে আশু মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিল। তবে শর্ত একটা আছে বটে। কারবার করতে হবে। মানে লেনাদেনা। সে চায়, বিনিময়ে নিলা অন্তত একদিন তার সাথে ইচ্ছে মত কর্মযজ্ঞ সাধন করবে। এবং সেই সময়টা আজই, এখনই। তার অনেক দিনের খায়েশ, ওর বাঁকা নদীর পিছল ঘাটে বিপুল উদ্যমে সে উপুড় হয়ে পড়বে চিতার ক্ষিপ্রতায়। একান্ত কায়মনে নিলার প্রেমনদীর জলে ডুব মারবে লম্বা দম নিয়ে। ‘সুযোগ যেহেতু পাওয়া গেছে আর কোন কথা হবে না বস। তবে এই এখনই হয়ে যাক তোমার ডেরায়। উঁ, কী বল।’
দেওরের অশালীন ইঙ্গিত ও সংযম সাশ্রয়ী বচনে নিলা তো মহাগরম। ওর কথার চোটপাট দেখে পিন্টুও ভয়ানক উৎপাত শুরু করে দিল। দরজার খিল শক্ত করে এঁটে দিয়ে জোর করে নিলার সাথে নিজেকে সেঁটে দিতে চাইল সে। সিনেমার খলনায়কদের মত হো হো করে হেসে প্রথমে নিজের দেমাগ জাহির করল। তারপর কুৎসিৎ ভঙ্গিতে কিছু অশিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করে উন্মত্ত হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল নিলার উপর যেমন করে ক্ষিপ্ত ক্ষুধার্ত বাঘ ধরতে যায় ভীত চকিত হরিণশাবককে। জব্বারের বলিখেলায় লড়িয়ে বলিদের মত লড়ে যেতে চাইল সে নিলার সাথে। নিলা, অবলা মেয়েটি কি পারে এই অসুরের সাথে? উপায়ান্তর না দেখে হাতের কাছে পাওয়া শক্ত কাঠের পাত দিয়ে নিলা মাথা ফাটিয়ে দিল পিন্টুর।‘ও মাগো’ বলে আর্তচিৎকার দিয়ে টাইলস করা মেঝেতে কাটা গাছের মত ধসে পড়ল নিলার দেওর-বলি। সে যাত্রায় বেঁচে গেল ও।
পরে বাবা-মাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে দক্ষ রাজনীতিকের মত পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে¡ নিয়ে নিল পিন্টু। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ভয়ংকর ক্ষেপে গিয়ে কটুকথায় তুলোধোনা করল নিলাকে, চড়া মেজাজে যথেচ্ছ অপমান করল, ওর বাপ-মা তুলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিল এবং যা নয় তাই বলে গেল। তাদের বলগাহীন অবাচ্য বচনে নিলার মনে হল, ওর বুকে কেউ উনান পেতেছে। ফোঁড়ার উপর বিস্ফোটকের মত তারা এমনকি ওর জন্ম পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। তারপর ঘর থেকে বের করে দিয়েছে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে।
নিলা জানে, শেওড়া সোজা হলেও গিঁটে গিঁটে বাঁক। ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি অনেক ধন-সম্পত্তির মালিক হলে কী হবে, তাদের মন ও মননে আছে পুষ্টির খরা। তাদের কৃষ্টি-কালচারে উৎকর্ষতার অভাব প্রকট। তাই তো বস্তির লোকদের মত খিস্তি আউড়ে তারা চরম রুচিহীনতার পরিচয় দিতে পেরেছে। তাদের জাতের পরিচয়ে বড়ো করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ছোটলোকের কথা কচ্ছপের মাথা। তাই শত গঞ্জনা অপমান সত্তে¡ও টু শব্দ করেনি নিলা। রা করেনি, মুখের কথা খসায়নি। তাছাড়া জানে, স্বর্গের ফেরেস্তারা মন্দ ভাষায় আক্রমণকারীদের ভর্ৎসনা করে দিচ্ছে তার হয়ে।
অর্ধচন্দ্র খেয়ে বিতাড়নের পর নিলারা নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিয়েছিল শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ও দেবরের বিরুদ্ধে। খবর পেয়ে উন্মাদের মত আচরণ শুরু করে দেয় পিন্টু। সে আবার এক বড় দলের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্থানীয় সাংসদ পুত্রের সাথেও খায়-খাতির বেশ ভাল। রাজনীতি ও রাজনীতি বহির্ভূত সব নম্বরী কাজ তারা একসাথে করে। সেই বলে বলবান হয়ে পিন্টু ব্যাপক হুমকি-ধমকি দিল। মামলা তুলে নেয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে গেল এবং একটা সময়সীমা বেঁধে দিল। অন্যথা হলে এরপরে চ‚ড়ান্ত অঘটনের জন্য প্রস্তুত থাকার হুঁশিয়ারী দিল। শেষ পর্যন্ত নিলারা মামলা তুলেই নিল ভয়ের চাবকানি খেয়ে। প্রশাসনও মামলার ঝামেলায় না গিয়ে আপোষরফার পথ বাতলে দিল, সংলাপের উপর জোর দিল। প্রয়োজনে তারাও করবে সহযোগিতা। আলোচনায় নাকি অনেক জটিল সমস্যারও সমাধান হয়!
এই পিন্টুই রাস্তার দেখায় সেদিন হুমকি দিয়ে গেল দেখে নেয়ার। অতএব টেনশান না করে পারা যায় কীভাবে? এখন তো প্রকাশ্যেই বিশ্বজিতরা খুন হয় লোহার রডের নির্মম পিটুনি খেয়ে। রাজপথে শত শত লোকের সম্মুখে ¯ত্রীর চোখের সামনে রিফাতদেরকে ভবনদীর ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয় চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। রাজনৈতিক ও সামাজিক নির্মমতা এখন নিত্য। আলোচিত ঘটনার পর মন্ত্রী এমপি প্রশাসন ‘হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা’ বলে খুউব চোটপাট দেখায়। আর ক্রমাগত ছুটাতে থাকে কথার বাণ ও বান দুটোই। ব্যাপক উদ্বেগের সাথে মহামান্য হাইকোর্ট জানতে চায়, সমাজটা আসলে যাচ্ছে কোথায়?
নিলা মনে করে, রূপের ডালিই কাল হয়েছে ওর জন্য। ওর সৌন্দর্যে পাগল হয়েই হাসান আজ মানসিক রোগী। ভর্তি আছে পাগলাগারদে। ওর রূপের
ঝংকারে উতলা হয়ে এডভোকেট আতিক জামান খান বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে ‘ডঙ্কার ধ্বনি হোক আজি’ বলে। এবং বাবা-মা আইন পেশায় শাইন করা লোকটিকেই উপযুক্ত বলে গণ্য করেছেন তাঁদের মেয়ের জন্য যদিও নিলা ভয়ংকর মশগুল হাসানের প্রেমে। তার কথাবার্তা, ব্যক্তিত্ব ও আচরণে অজানা এক ঐকতানের রোমাঞ্চে ভেসে যেত নিলা যদিও সে সামান্য চাকুরে। আর আতিক জামান খান অসামান্য এডভোকেট যে কিনা অল্পদিনেই নামডাক করে ফেলেছে বেশ। স্বভাবতই তাকে মেয়ের জামাই করার সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হয়নি বাবা-মায়ের। এবং ওর রূপ দর্শনে অধীর হয়ে এখন অন্য এক সেলিম ওকে একান্ত আপন করে পেতে মাতাল হয়ে আছে যদিও আজ পর্যন্ত বিন্দুমাত্রও পাত্তা পায়নি সে।
হাসানের কথা মনে হতেই নিলার কেমন অস্থির অস্থির লাগে। বুকের ভূমি ফেটে চৌচির হয় চৈত্রের ঠাঠা রোদ আর খরতাপে পিষ্ট জমির মত। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কান্না আসতে চায় তুমুল বেগে। এবং এসেই যায়। নিলা বাধা দেয় না। বরং ভাল লাগে কান্নার প্রবল জোয়ারে ভেসে যেতে, চোখের জলে চোখ মুখ কপোল ভাসিয়ে দিতে। বালিশে মুখ গুঁজে দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে ও। কান্নার তালে দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে। থামতেই চায় না।
এমন একটা ম্যারাথন কান্নার বোধ হয় দরকার ছিল নিলার জন্য। অনেকদিন পর কাঁদতে পেরে ভালই লাগছে। বুকের ভারী পাথরটা সরে গেছে মনে হচ্ছে। নিজেকে হালকা হালকা লাগছে অনেকটা শিমুল তুলার মত।
বিধবার বেশ ধারণ করে হাসানকে একবার দেখতে গিয়েছিল নিলা। তাকে আরেকবার চোখের দেখা দেখতে বড্ড সাধ জেগেছে ওর। বেচারা! সব শেষ হয়ে গেছে তার। জীবন যৌবন বাপ-মা সংসার এখন তার কাছে সব অসার।
তবে এটাও ঠিক, এককালের ঠাটবাটসম্পন্ন আপাদমস্তক ভদ্রলোক হাসানের এখনকার বেহাল দশা নিলা ঠিক মেনে নিতে পারে না। ওর প্রাণে সয় না। তখন একটা প্রবল ইচ্ছে পুষ্পিত হয়ে উঠে ওর মনে, কোন এক অলৌকিক যাদুবলে তাকে সুস্থ করে তোলে। তারপর তার বক্ষে আপনাকে সঁপে দিয়ে কেঁদে-কেটে ক্ষমা চায়।
হায়, তা যে হওয়ার নয়! তার জন্য কাঁদা ছাড়া নিলার যে আর কিছুই করার নেই।
‘আপনি আমায় বলতেন ক্রন্দসী প্রিয়া। ঠিক তাই।’,হাসানকে উদ্দেশ্য করে আপন মনে বলে উঠে নিলা,‘জানেন, আমিও প্রায় সময়ই ওই গানটি শুনি এবং দরদ দিয়ে গাইতে চেষ্টা করি যেটি এখন সারাক্ষণ আপনার গলায় বাজতে থাকে, নিলা, তুমি আবার এসো ফিরে, ভালবাসা কাঁদে বুক চিরে চিরে।’
‘আপনি ভাল হয়ে ফিরে আসুন প্রিয়তম অন্তত এই আমার জন্য, আপনার অবুঝ ক্রন্দসী প্রিয়ার জন্য।’

মোহাম্মদ হোসেন
সিনিয়র অফিসার
প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড
কক্সবাজার শাখা
মোবাইলঃ- ০১৮১৫-৮৫০৩৬৯
মেইলঃ- সফযড়ংংধরহ১৫৭৬@ুধযড়ড়.পড়স