থ-বনে যায়

164

পথের দুই ধারে সারিসারি মেহগনি অভ্যর্থনা জানাবে। তারপর হাটতে হাটতে কিছুদূর গেলেই সিদ্দিক মার্কেট। এরপর ডানপাশে ভুতের গলি। ভুতের গলিতে কিন্তু কোন ভুত নেই। সব মানুষ, অধিকাংশো ভদ্দর লোকজন এখানে বাস করে। জায়গাটা একসময় ভেতরে ছিল। চারপাশে অন্ধকার লাগতো। তাই একজন নাম পাল্টে রেখেছেন ভ’তের গলি। এই দিকের এক ছেলে জন্য বৌ দেখতে গিয়েছিল তার বাবা-মা রাস্তার মাদাম বিবির হাটের ওদিকে। মেয়ে দেখে সবার পছন্দ হবার পর মেয়ের ফুফু ছেলের বাড়ি দেখতে আসে। রাতের বেলা এই জায়গা দিয়ে যাবার সময় মন্তব্য করেন। এটা কেমন জায়গারে বাবা! জেনো ভুতের গলি! এখন অবশ্য সিটি কর্পোরেশন রাস্তাঘাট করেছে বিশাল করে। পথের চারপাশে আলোক বাতি লাগিয়েছে। পানির ফোয়ারা বসিয়েছে। রাতের বেলায়ও কত সুন্দর লাগে দেখতে । এই ভুতের গলিকে। ফোয়ারার কাছে কত তরুণ-তরুণী মনের সুখে সেলফি তুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এতকিছুরপরও পূর্ব পুরুষের ভুতের গলি নামটা পরিবর্তন করা গেল না। গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। শরতকালে যা হয় আর কি! যেখানে আকাশের কোণে মেঘ জমে সেখানেই ঝরে পরে। কখনো শান্ত কখনো অবিরাম। সন্ধ্যার পর একটু বেরোলাম। জরুরি কিছু সদাইপাতি সারবো বলে। বাসায় মা একা। কদিন তার একাই খেতে হবে। তাই কিছু কাচা বাজার আর মশলাপাতি নিতে হবে। বেরোনের সময় আকাশ কত উজ্জ¦ল ছিল। যেই আমি বেরিয়ে ভ’তের গলি ফেলে হাদু মাঝিপাড়া পর্যন্ত এগোলাম ঝমঝম করে বৃষ্টি। এগোনোর কোন সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে আরফান সমবায় সমিতির অফিসের নিচে একটু আশ্রয় নি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এক নাগাড়ে পড়ছে। বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। এর মাঝেই দেখলাম দু’চারজন করে লোক আসছে। সমিতির অফিসের তলায়। এসে ফোন করছে। সমিতির অফিসের লোকদের। শুনলাম বেশ কদিন হলো তারা আর অফিস খুলেনা। সমিতি ওপেন করানোর সময় নানান ছালচাতুরি কথা বলে ভুলিয়ে ছিলেন। এখন টাকা দেবার সময় বোধহয় ফুরুৎ। বাংলাদেশের অধিকাংশের এই অবস্থা। টাকা গিলতে পারেনা। পুরোটা একবারে খেয়ে ফেলতে চায়। পড়ে খেতে না পেরে বমি করে দেয়। বাঙালির ঘোড়া রোগ এটা। একটা ছেলে বাদুরতলা গাড়ির গ্যারেজে কাজ করে। সারা শরির তেল চিকচিকে। কাপরের নানা স্থানে পোড়া মবিলের কালো কালো দাগ। চুলগুলো উস্কুখুস্কো। বহু আক্ষেপের সুরে বলে-
Ñ ভাই জানেন, না খাইয়া না খাইয়া জমাইছলাম টাকাগুলো। কত করে বুঝিয়ে সমিতিটা খুলিয়েছে তাদের ফিল্ড অফিসার মহুয়া। এখন দেখেন এক সপ্তাহ ধরে একথা ওকথা বলে ঘুরিয়েই যাচ্ছে চরকার মতন করে। নিজেরে আর মানুষ মনে হচ্ছেনা চরকা মনে হচ্ছে। আমার মায়ের অনেক শখ ভ্ইা একটা জামদানি শাড়ির। কোনদিন তেমন কোন আবদার করেনি। জ্যাঠুমার ছেলের শ্বশুর তার জন্য একখানা জামদানি শাড়ি পাঠিয়েছেন। মার শাড়িটা পছন্দ হয়েছে। গত ঈদে অনেক চেয়েও মাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারিনি। তাই একটা শাড়ি দেবার জন্য টাকাগুলো অনেকদিনে জমিয়েছি।
বললাম,
Ñ দেখি তোমার খাতা। মাত্র বারো শ টাকা!
Ñ হ্যাঁ ভাই। এই বারো শ টাকা জমাতে আমি অনেক বেলা নাশতা করিনি। অনেক দুপুরে খায়নি। বন-কলা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। ভাবলাম শাড়ি নিয়ে বাড়ি যাব। মার মনটা খুশিতে ভরে যাবে। মনটা ভরে মায়ের হাসিমাখা মুখখানা দেখব। ভুলে যাব সব এতদিনের সব ব্যথা।
কথাগুলো শুনে আমার খুব কষ্ট লাগলো। মায়ের প্রতি ছেলেটার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করলো। আমার সমানেই দেখি ফোন দিল। জ্বী ভাই আমরা আসতেছি অফিসে । ঘণ্টা খানেক পর। সে ঘণ্টা আর হলে না। ছেলেটি জানালো এভাবে চার-পাঁচবার করেছে ভাই। শালারপুতরা বোধহয় পালিয়েছে। গরীবের টাকা খেয়ে হজম করতে পারবেনা ভাই। এই বলে বলে চলে যায়। গরীব লোকের এই হলো শেষ অস্ত্র।
খোদার কাছে বিচার দেয়া। খানিকবাদে এক বৃদ্ধ এলো থরথর করে কাঁপছে বৃষ্টিতে ভিজে। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়েছে। বিশ-পঁচিশ হাজার। সে টাকাই েিনত এসেছে। আজ দিবে কাল দিবে। এই বলে গত এক সপ্তাহ ধরে বলেই যাচ্ছে। কাজের কাজ হচ্ছে না। এখন আমার সামনে ফোন দিল। বললো জ্বী আপনি একটু টাইগার পাস পুলিশ বক্সের সামনে আসবেন দয়া করে? চোখেমুখে তার চাপা কষ্ট। বৃদ্ধকে আমি সতর্ক করছিলাম না চিনে না জেনে এই সন্ধ্যায় কোথাও না যেতে। খবরটা বোধহয় লোকটার খান অবধি পৌঁছাতে পারেনি। যে বাবা কন্যা দায়গ্রস্থ থাকে সে কি আর রাতবিরাত ঝর বৃষ্টির তোয়াক্কা করে! ব্যাটা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দৌড়ায়।
ইনিতা ফোন দিচ্ছে।
Ñ কতক্ষণ হলো বাজারে গেলে। এখনো বাজার শেষ হয়নি! পুরো বাজার কি ব্যাগে করে নিয়ে আসছো?
Ñ আরে না। বাইরে দেখো। বৃষ্টি হচ্ছে অনেক।
Ñ ছাতা পাঠাব? তুমি কোথায় আছো?
Ñ লাগবেনা। থেমে যাবে।
বৃষ্টি থামেনি। তাও ভিজে ভিজে গিয়ে জরুরি কিছু সদাইপাতি সেরে বাসায় ফিরলাম। ইনিতা প্রস্তুত। ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখেছে কাল রাতেই। অনেকদিন ধরে আমাদের ঘুরতে যাবার কথা । যাব যাব বলে যাওয়া হয়না। বিয়ের পর থেকেই যাচ্ছি। এভাবে করে দুই বছর কেটে গেল। এখনো মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে কোথাও যেতে পারিনি। সময়Ñই বা পেলাম কয়! একটার পর একটান উঠকো ঝামেলা গায়ে এসে লেপ্টে যাচ্ছে।
‘চারটা খাবে। গরম গরম লুচি করেছি। খাও তাহলে হাত-মুখ ধুয়ে আসো।
আমি মাকে ঔষুধগুলো একবার দেখিয়ে দিয়ে যায়। পড়ে উল্টাপাল্টা খেয়ে রোগ বাঁধাবেন।’ ঘরে অবশ্য দুটো কাজের বুয়া সবসময় থাকে। তাও মায়ের জন্য ইনিতার আলাদা টান। ছোট বেলায় সে মা হারিয়েছে। নিজের মায়ের মমতা নাকি সে আমার মায়ের কাছে পেয়েছে। তাই মায়ের প্রতি তার অগাধ ভক্তি। আমার মায়েরও কোন মেয়ে নেই। তাই সারাজীবন আফসোস করেছেন। মেয়ের আদর পাননি বলে। ইনিতা সে আক্ষেপ লাঘব করেছে। সবার কাছে মা ইনতার গল্প করেন। আমার লক্ষী বৌ এটা।
দুই
সন্ধ্যা সাতটার কিছু পর ড্রাইভার গাড়ি বের করলো। বাইরে তখনো অনেক বৃষ্টি। মা দোয়া কালাম পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন। একেএকে ছেলের মাথায় ছেলে বৌয়ের মাথায়। আমার মায়ের পুরনো অভ্যেসখানা এখনো রয়ে গেছে। কোথাও যাবার সময় মা মনে মনে দোয়া পাঠ করে ফুঁক দেন। ফুঁ দিলে কোন উপকার হয় কিনা জানিনা। তবে আমি নির্ভয়ে থাকি। মা ফুঁ দিয়েছেন মানে কোন বিপদ আমাকে গ্রাস করতে পারবেনা। ইস্টিশনে পৌঁছি তখন পৌনে আটটা। ভেতরে লোকে গিজগিজ করছে । কোথাও তিল পরিমাণ জায়গা নেই। সম্ভবত পাহাড়িকা এসেছে। আবার ঢাকা মেইলেরও যাবার সময়। তাই এই অবস্থা। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিলাম। ও দেখলাম এককোণে ইনিতার সাথে কি একান্ত আলাপ করছে। অবশ্য আমি রোজই দেখি এমন। সে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ইনিতা কি যেন যাচছে তাকে। আর সে কাচুমাচু করছে। আমি যখন অন্য দিকে ফিরলাম তখন চলে গেল। সময় মতন ট্রেনে উঠে বসলাম। রাত তখন শেষের দিকে। অন্ধকার পথে ট্রেন ছুটে চলেছে সবেগে ঝক্ঝকাঝক্ করে। প্যারাডাইস লস্ট বইটা হাতে নিলাম। ইনিতা টেনেÑহিঁচড়ে নিয়ে নিল। আজ কোন পড়া না। আর এই বই তুমি এখানে আনলে কি করে! কাপড়চোপড় সবতো আমি নিজে ভাঁজ করলাম। ব্যাগে নিলাম। বই কে দিল! আচ্ছা তোমার কি আমাকে ভালো লাগেনা? নাকি আমার সঙ্গ তোমার পছন্দ না। কোনটা! বলবে? বাসায় যে আমি সারাক্ষণ একা একা থাকি আমার মন খারাপ হয় কিনা একবারও জানতে চেয়েছো কখনো। বাসায় এসেই ল্যাপটপ কি-বোর্ড নিয়ে ব্যস্ত। কি হবে এত কিছু দিয়ে যদি ভালোবাসা না থাকে! তুমি কি বুঝোনা নিলয়। একটা মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে বলেই ঘর ছেড়েছে। নিকট জনদের হারিয়েছে। বাবা-মাকে পরিবারকে ত্যাগ করেছে। আর তুমি! এত বই পড়ো গল্প পড়ো, কবিতা পড়ো। মন পড়তে পারোনা। মন যদি পড়তে নাÑইবা জানলে তাহলে আর পড়ার দামটা কয়। আমি খানিক্ষণ চুপ মেরে থাকি। তারপর পিঠে হাত দিয়ে মাথাটা আমার বুকের কাছে এনে ধরি। চুপিসারে বলি। তোমার মাঝে আমি ডুবে গিয়ে বেঁচে যেতে চাই , হৃদয়ের অলিন্দ তুমি ভালবাসি তোমায়। ফিক করে হেসে দেয় ইনিতা। মাথাটা বুকের সাথে ঠেকিয়ে রাখে। কখন যে তার চোখ লেগে আসে সেও টের পায়না। আমি টের পায়। ঘুমন্ত ইনিতাকে দেখি মুগ্ধ চোখে। কত সহজ সরল মেয়েটা। কীÑ ঝাঁঝালো কণ্ঠ তার! তার মুখের কথাগুলোও কবিতার মতন মনে হয় । এত কিছুর পরও আমি কেন পারিনা সব ছেড়ে দিয়ে তার কাছে চুপটি করে বসে থাকতে! ঈশ্বর ভালো জানেন। তবে ইনিতা আমাকে বোকার মতন ভালোবাসে বলেই কি আমি অমন করি রোজরোজ তার সাথে। কোন চিন্তাবিহীন, নিরালা নিশ্চিন্তে আমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে ইনিতা। রাত বুঝি ফুরিয়ে এলো। খানিক বাদেই আমরা পৌঁছে যাব গন্তব্যস্থলে। আগে কত গেছি সিলেটে।
বাবার চাকুরি ছিল বলে। প্রায় শিশু-কিশোর -যৌবনের একুশটা বছর এখানে তো কাটিয়েছিলাম। এখনো সব পষ্ট মনে পড়ছে। আমার নানা ভাই বেড়াতে এলে তাকে নিয়ে বেরোতাম। ইস্টিশনের কাছে মোটু মামার দোকান থেকে নানা ভাই আমাদের জুস আচার চিপস এসব কিনে খাওয়াতেন। একটু বাদেই ট্রেন থেকে নামব। সেই চিরচেনা ইস্টিশনে। এতদিনে হয়তো সেই মোটু মামাও নেই। তার টিনের ছাউনি দেয়া সেই চা দোকানও নেই। কি আছে! কি নেই! সব মেলাতে নেই। যা আছে তা দিয়েই দিন কাটাতে হয়। পৃথিবীটা বেশি বড় না। আস্তে আস্তে ডাকি মিনমিন করে। ইনিতা..আমার বাবুটারে..উঠোগো উঠো। ঘুম বালিকা উঠো। ঘুমের ভেতরও ইনিতা ফিক করে আরেকটু লাজুক হাসে। এত সুন্দর করে পৃথিবীর আর দুটো মানুষকে হাসতে দেখিনি। গাড়ি প্লাটফরমে থামলো। লাগেজটা নামালাম। ইনিতার হাতে লাগেজের হাতলটা। সে টেনে টেনে নামছে। পেছন পেছন আমি। ইনিতার ব্যাগটা গলায় ঝুলিয়েছি। হাতে আরো কয়েকটা ছোটখাটো ব্যাগ। সবগুলো একসাথে নিতে বেগ পোহাতে হচ্ছিল।
ইনিতা! থামবে।
সত্যিইতো থেমেছে ইনিতা। আমিও থেমেছি। আমরা দুজনই একসাথে থেমে গেছি। পথে আমাদের এ ভাবে থেমে থাকার কারণে লোকজনের নামতে কষ্ট হচ্ছিল। সে দিকে আমাদের ভ্রæক্ষেপ নেই। হ্যাঁ এটাই তো ইনিতা। যাকে আমি চারবছর টিউশন পড়িয়েছি। আর একটু একটু করে একসময় ভালোবেসে ফেলি। তারপর একদিন হুট করে সে বলে দেয় আরিয়ানকে সে ভালোবাসে। তাকে ছাড়া সে বাঁচবেনা। আমি তখন ভীমরি খেয়ে যায়। আমার অন্ধেরন্ধে বিষাদ ঘুরে বেড়ায়। তোলপাড় করে তুলেছিল জীবনকে। মাকে বলেছিলাম মা বাঁচতে চায়না আর! মাতো কেঁদেই অস্থির। অনেক কেঁদেছি আমিও । এই যে বিয়ে করেছি ইনিতাকে। এই ইনিতাকে দেহ দিয়েছি। মন কি দিতে পেরেছি কোনকালে! না পারিনি বোধহয়।
আমার মন এখনো যে সেই ইনিতার কাছে জমে আছে। ইনিতা সামনে বাড়ে। টপটপ করে তার চোখ বেয়ে জল পড়ে। সে চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে, পারেনা। তখন সকাল সাড়ে সাতটা। ইনিতা বলে খিদে পেয়েছে অনেক। পেটে ইঁদুর দৌড়ায় । আগে কিছু খাব চলো। হুম চলো। ইনিতার হাত ধরে আমি সামনে হাটি। পেছনে আরেক ইনিতা চেয়ে থাকে বহুক্ষণ যাবত হয়তো। হাটতে হাটতে অনেক দুরে আমরা দুজন মিলিয়ে যায়। ইনিতা মিলায়না। মনের ভেতর ইনিতা ঠিকই বসত করে । অনুরণন তুলে আমার পড়ন্ত বিকেলের কোন এক দন্ডে। অন্ধকার হয়ে আসে চারদিক। খানিকপর বৃষ্টি নামে। আমি বৃষ্টিতে গা ভাসিয়ে কাঁদি। যেন এ সংসারের কেউ আমার চোখের জল দেখতে না পায়।