জাতীয় গণহত্যা দিবস মুক্তিকামী মানুষের জীবনে এমন দিন যেন আর ফিরে না আসে

64

আজ ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতি কৌশলে বঙ্গবন্ধুর সাথে সব আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়ে মধ্যরাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর নিষ্ঠুর গণহত্যা চালায়। উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, জাতীয়তাবাদের বজ্র কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। এভাবে রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কোনও বাহিনীর আক্রমণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। প্রতিবছর এ দিনটি মুক্তিপাগল বাঙালি অশ্রæসজল নয়নে উদ্যাপন করে থাকে। তবে এবারের দিবসটি অন্যান্যবারের চেয়ে একটু ভিন্ন কর্মসূচিতে পালন করবে সরকার ও দেশের সাধারণ মানুষ। যেহেতু এবার দিবসটি পালন হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। যে গণহত্যা স্বশস্ত্র স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যক্ষ কারণ সেই দিনটি উপলক্ষে করোনাকালেও ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। তবে তা হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত লোকসমাগমের মাধ্যমে। আমরা জানি, ২৫ মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য ২০১৭ সালের ১১ মার্চ সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ওই বছর থেকে দিনটি জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালিত হচ্ছে।
গণহত্যা দিবস বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগের মহান স্বীকৃতির পাশাপাশি তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদের প্রতীক। নানা ষড়যন্ত্র করেও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে প্রতিহত করতে না পেরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করতেই ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারেরা এ দেশের গণমানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। একাত্তরের বীভৎস গণহত্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব মানবতার ইতিহাসেও একটি কালো অধ্যায়। এমন গণহত্যা আর কোথাও যাতে না ঘটে, গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে সে দাবিই বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হবে। এই দিনে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বলিদান দেয়া সব শহীদকে আমরা স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়। রাষ্ট্রভাষার অধিকার লাভে বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয় ১৯৫২ সালে। এরপর পাকিস্তানিদের ক্রমাগত শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য, অধিকার হরণ বাঙালির ক্ষোভকে ক্রমেই জমাট করে। ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এসবের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এবং সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তারা গণতন্ত্রের রায় মেনে না নিতে শুরু করে নানান টালবাহানা, চালাতে থাকে নানান ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা পরিণত হয় এক দফায়। শুরু হয় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশ দিলেন তিনি। ৭ মার্চের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে প্রতিদিনের চিত্র। একদিকে দানা বাঁধতে থাকে বাঙালির বিক্ষোভ, অন্যদিকে আঁকা হয় পাকিস্তানিদের নীলনকশা। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকা ছাড়েন। তবে ইয়াহিয়া তার সেনাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে যান। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এ রাতেই সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী হায়েনার মতো নেমে পড়ে গণহত্যায়। একেবারে প্রথম পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাসভবন এবং ছাত্রদের হল, রাজারবাগ পুলিশের হেডকোয়ার্টার, ইপিআর সদর দপ্তর, বিভিন্ন স্টেশন ও টার্মিনালে আক্রমণ চালানো হয়।
ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালি হত্যার উৎসব শুরু হয় ওই রাতে। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। ২৫ মার্চে কালরাতে পাকিস্তানিদের ধ্বংস ও নিধনযজ্ঞ বাঙালিকে তো দমাতে পারেইনি, বরং তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ করে। হানাদার বাহিনী যে অত্যাচার, অবিচার ও নৃশংসতা করেছে তা নজিরবিহীন। দেরিতে হলেও ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, আমরা এই দিনটি পালন করব। পাকিস্তানিদের বর্বরতা গোটা বিশ্ব জানে। তারপরও তাদের ঔদ্ধত্য আমাদের হতবাক করে। এখনো পাকিস্তানি শাসকরা সচেষ্ট একাত্তরের গণহত্যা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মদদে বই লিখে প্রচার করা হচ্ছে যে, একাত্তরে কোনো গণহত্যা হয়নি। এসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র রুখতে আমাদেরও কাজ করতে হবে। ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এখন তৎপর হতে হবে