চট্টগ্রামে বাড়ছে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই

20

হঠাৎ করে চট্টগ্রামে বেড়ে গেছে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীর উপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। সূত্র জানায়, সপ্তাহের শুরুর দিন রবিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হতাশার মোড় থেকে হলে ফেরার পথে এক ছাত্রী ও তার বন্ধুকে আটকে বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় নিয়ে যৌন নিপীড়ন করে পাঁচজন। ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টাও করা হয় বলে অভিযোগ। ঘটনার পরদিন সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দেন। এরপর যৌন নিপীড়নের শিকার ওই ছাত্রী মঙ্গলবার থানায় মামলা করেন, তাতে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে।
শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মামলার পর দুই শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রী নিপীড়নের ওই ঘটনায় পাঁচজন জড়িত ছিল। তাদের দুইজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অভিযুক্তদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া মঙ্গলবার রাতে নগরীর জিইসি মোড়ে এক গৃহবধূকে রিকশা থেকে নামিয়ে সংঘবদ্ধ একটি দল যৌন নিপীড়ন চালায়। রিকশাচালক এ সময় পুলিশকে ৯৯৯ জরুরি কল করলে পুলিশ ঘটনাস্থলে দ্রæত এসে মেয়েটিকে উদ্ধার করেন। অপরদিকে দুইদিন আগে পতেঙ্গায় নিজের সৎবাবা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে একজন কিশোরী। সূত্র জানায়, কিশোরীর মা একটি গার্মেন্টস এ চাকরি করেন। এ সুযোগে সৎবাবা মেয়েটিকে বাড়িতে একা পেয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে যৌন নীপিড়ন করছেন বলে খবরে জানা যায়। আশার কথা, পুলিশ উল্লেখিত ঘটনার সাথে জড়িত অধিকাংশ আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি ঘটনাগুলোর প্রায় এক বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় স্বামী পরিত্যক্তা এক অসহায় নারী পাঁচ বছর বয়সী কন্যাশিশুকে এক পাষুÐ যৌন নীপিড়ন চালিয়ে হত্যা করেছে।
একই বছরের ২৭ মে রাতে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় পূর্বপরিচিত এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান এক নারী পোশাককর্মী। এসময় তিন ব্যক্তি মিলে মারধর করে তাড়িয়ে দেন ভুক্তভোগী নারীর বন্ধুকে। পরে অভিযুক্ত তিনজনে মিলে ওই নারীকে ধর্ষণ করে। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক হচ্ছে, যৌন নীপিড়নের অধিকাংশ ঘটনা ঘটছে কথিত পথভ্রষ্ট কিশোর গ্যাং-এর সদস্য কর্তৃক বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা কিছু নেতা-কর্মী কর্তৃক। আর কিছু ঘটনা ঘটছে, বিকৃত মাসিকতাসম্পন্ন বয়স্ক কিছু পাষÐ কতৃৃক। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ নারী কাছের মানুষ দ্বারা ধর্ষিত হন। কোন কোন ঘটনা দুইপক্ষের পরিবার ধামাচাপা দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ অপরাধীর বিচার না করে অপরাধকে বৈধতা দিয়ে দেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটার কারণ হচ্ছে উপযুক্ত শাস্তি কম হচ্ছে। সেটি পুলিশের তদন্তের গাফিলতিতে হোক কিংবা আইনের কোনো জটিলতা থেকেই হোক। আবার যে শাস্তি হচ্ছে তা প্রকাশ্যে কম আসছে। ধর্ষণ এবং তার শাস্তির ভয়াবহতা আমাদের বেশি করে প্রচার করতে হবে। নারীদের নিজেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হবে। দেশে পর্নো সাইট বন্ধ করতে হবে। বাজারে সেক্সুয়াল পণ্য সহজে পাওয়া যায়। এটিও বন্ধ করতে হবে। ধর্ষণ কমাতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা মনে করি, দেশে যৌন নীপিড়নের কঠোর আইন রয়েছে, ২০০০ সালে প্রণয়ন করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। এই আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা এখন মৃত্যুদÐ করা হয়েছে। ২০০০ সালে প্রণয়ন করা এই আইন সবশেষ ২০২০ সালে সংশোধন করা হয়। বর্তমানে এ আইনের অধীনে ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিচার করা হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। তবে ধর্ষণের মামলায় শাস্তি বাড়ানো হলেও কমছে না এ অপরাধের সংখ্যা। উল্টো দিন দিন বাড়তির দিকে। এর অন্যতম কারণ বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতা এবং অনেক সময় বিভিন্ন কারণে প্রকৃত অপরাধী শাস্তির আওতার বাইরে থাকায় ধর্ষণের মাত্রা বাড়ার মূল কারণ। এছাড়া নিজেদের ধর্মীয় অনুশাসন কম মানা, নৈতিক অবক্ষয় ও মানসিক বিকৃতিতে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। আমরা আশা করি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান, পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা সর্বোপরি জনসচেতনতাই এ জঘন্য অপরাধ থেকে নারী সমাজ মুক্তি পেতে পারেন।