খান স্যারের খোঁজে…

100

‘আমি দেখি শহরে হেঁটে যাচ্ছে একজন মোহাম্মদ হোসেন খান
তোমাকে বেড়াচ্ছে খুঁজে চকবাজার আন্দরকিল্লা আর জামালখান।’
অভিধানে ‘শোক’ একটে শব্দমাত্র। যাঁর জন্য এ শোক, তিনি জীবনের সত্যে মূর্ত হলে শব্দটি শোকের না হয়ে অনাভিধানিক পরিচয়ে ‘হাহাকার’ হয়ে ওঠে। স্যার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান শোকের নাম নয়, তিনি হাহাকার-হাহাশ্বাসের নাম। তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়-সানাই এমনটেই বলছে, এমুই বাজাচ্ছে।
দৈনিক আজাদী দিয়ে তাঁর বাক্ওয়াজ মুদ্রিত হয়। আজাদীই তাঁকে ‘মুক্তমানুষ’ বানায়। সম্পাদকই তাঁকে এ অঞ্চলের ‘সম্পদ’ বিবেচনা-জ্ঞান করেন। সেই ‘বিরস রচনা’, সেই ‘আজাদী, সেই ‘সম্পাদক’Ñ তিনটের দুটো সালামাতে আছে, কিন্তু একটে বেহাত হয়ে গেছে! মৃত্যু-সম্পাতে এ সম্পদের বিলয় ঘটেছে। সামাজিক দুর্দিনেই বেহাত হয়েছেন তিনি! হাহাকার-হাহাশ্বাসটা এখানেই।
আজাদী তাঁকে অনেক দিয়েছেÑবিশেষে ‘খ্যাতি’ই দিয়েছে। তিনিও বিরসের ভেতর রস-সরসের ভেতরটে পরিবেশনে খামতে করেননি। তাঁর চোয়াল থেকে ‘ফটরফটর’ শব্দ-আওয়াজ বেরুতে দেখে এমএ মালেক সাহেব সেসব লিখিত আকারে-প্রকারে প্রকাশের অনুরোধ করেন। অনুরোধের লেখা এণটে জনপ্রিয় হবেÑ এমুই ভাবেননি তাঁরা! একদিন অনুরোধের মগজ কপচে বের হয় ‘বিরস রচনা’। সেই একদিন, ১৯৯১ খৃস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর দিন। বাংলা বানানের ছিরি-বিচ্ছিরির বয়ান বর্ণননির্ভর প্রথম লেখায় স্বনামে নন, হাজির হন ‘ইবনে সাজ্জাদ’ লুকোচুরি নামে। তিনি তাঁর লুকোচুরি নাম রাখতে চেয়েছেন ‘আবু সাজ্জাদ’। কিন্তু পত্রিকার পাতায় ‘ইবনে সাজ্জাদ’ মুদ্রিত হয়ে আসে! শেষদিন অবধি এ নামে এবং বেনামেই লিখেন তিনি। কিন্তু লুকোচুরি লুকোচুরি গল্পÑ খেলতে পারেননি। অল্পেই জানাজানি হয়ে যায়, এই সেই অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান। সেই হতে জয়তু ইবনে সাজ্জাদ।
ইবনে সাজ্জাদের একটানা ২২ বছরের ‘বিরস রচনা’য় রসের আকাল-নাকাল হয়নি। খেজুরগাছে খেজুর রস থাকুক আর নাই থাকুক বিরস বৃক্ষ ‘রস’ দিয়েছে! লেখায়-কথায় ধোঁয়াসে তৃপ্তি দিয়েছে। শুক্রবারের ‘বিরস রচনা’ পাঠকের জন্য একটে ঠাÐা আইসক্রিস তো অবশ্যই, কলমজীবীর কাছে তা ছিলো রসের ভিয়েন। সরং, সঢং, সভংÑএ লেখা ‘বিরস রচনা’ তাঁকে দানে স্বাতান্ত্রিকতা, রচনাকে দেয় পাঠকপ্রিয়তা। ভাষার স্বকীয়তা, বিদেশি শব্দের মিশেল, গল্পের ভাঙা-গড়া তাঁর কলম ও কলামের প্রাণ। ‘তাঁর কলামে-গ্রন্থে তিনি যে পরিচয়টি রেখে গেছেন সেখানে অন্যদের প্রবেশ দুঃসাধ্য!’ Ñএ মন্তব্য আমার নয়, প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান স্যারের।
হ্যাঁ, খান স্যারের রচনার জীবন-মান-প্রাণের কথা হচ্ছিলো। কথা সামান্যই শোকের কথা থেকে। মানুষ খ্যাতি আর দ্যুতি ছড়ায় বাক্শক্তি ও লিখনীশক্তি দিয়ে। এ দুটে গুণ তাঁর ইকুয়াল ইকুয়াল। বলার সৌন্দর্র্যে আর লেখার সৌকর্যে তিনি মানুষের অন্তরে বিমোহিতা ধরিয়েছেন। কলমে-কলামে, বয়ানে-চিন্তনের টানে তিনি হয়েছেন সকলের হৃৎমাঝার।
আজাদী-পর চট্টগ্রামের আরো দুটো কাগজে তিনি লিখতেন। ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’Ñএ তাঁর কলামনাম ‘সমসাময়িক’। নবীনপত্রিকা ‘পূর্বদেশ’Ñএ লিখেন ‘পথের প্যাঁচালি’ নামে। এতো শতো ‘প্যাঁচাইল্যামি’ কোথায় যে তাঁর জমা থাকতো তা ভাবনা-চিন্তেরও অন্তরীণ! খান স্যার মৃত্যু-হপ্তায়ও তিন পত্রিকায় তিনটে লেখা জমা দিয়ে তবেই জমিন ছেড়েছেন। মাসে ১৫-১৬টি লেখা পয়দা করা দুঃসাধ্য নয়; এ প্রবাদ কেবল তাঁর বেলায়-ই খাটে! এ তত্ত¡ তিনি খাটিয়ে গেছেন।
‘আজাদী’ তাঁকে চকবাজারে বইযাপনের জন্য লাইব্রেরি দেয়। জীবনের বড় একটা অধ্যায় তিনি বইয়ের সাথে যাপন করেন। বই দেখলেই ‘বইআতঙ্ক’Ñএ কাতর হতেন। কারো চা’দোকানের বিল স্যারের বই কেনার বিল হতে কতক্ষণ? এদিকের প্রকল্প অন্যদিকে যাচ্ছে তো এখন! অহরহই যাচ্ছে।
খান স্যারও শুভার্থির আপ্যায়নের বিলটা এভাবে বই মারফতে চেঞ্জ করে নিতেন! নাস্তার বদলে এমুই ছিলো তাঁর আবদার। কত যে দুর্লভ-সুলভ বই তিনি জমা করেছেন, ভাবতেই শ্রদ্ধা নুয়ে-চুঁয়ে আসে।
আজ তিনি ‘নেই জন’! নেই হয়েছে তাঁর কলাম। প্রকাশ পায় না ‘বিরস রচনা’ কিংবা ‘সমসাময়িক’, ‘পথের প্যাঁচালি’। কদম পড়ে না রাস্তায়-সড়কে। চোখে পড়ে না খদ্দর পরিহিত কাউকে। আড্ডা দিতে দেখা যায় না চকবাজার, আন্দরকিল্লা, জামালখান আর চেরাগি মোড়ে। সভা-সেমিনারের ডায়াসের সামনে নেই ছয় বছর ধরে। নেই হয়েছেন আরো আরো স্পেসে। নেই লাইব্রেরিতে, নেই পাঁচ টাকার গাদাগাদির বাসে, নেই আধেক সিগ্রেটের ঔষধে, নেই ছাতা হাতে-কাঁধে থলে ঝুলে-মাথায় টুপি পরিহিতে। প্রতি হপ্তায় শুক্রবার আসে, কিন্তু আসে না। কলাম আসে, বিরসের কালাম দেখি না। ‘বিরস রচনা’র সেই শুক্রবার অন্যরচনায় মন ভরায় না।
খুব খুব অনুভব করি স্যার আপনাকে। খুঁজি বিরসে-বিরহে।