কিংবদন্তী নেতা নেলশন ম্যান্ডেলা প্রফেসর

54

 

কিংবদন্তী মহান নেতা নেলশন ম্যান্ডেলা আমাদের সকলকে ছেড়ে পরপারে চলে যান বিগত ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ৮:৫০ মিনিটে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গের নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিশ্ববাসী হারিয়েছে মানবতাবাদী বর্ণবাদবিরোধী অসাম্প্রদায়িক নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতাকে।
একজন মহান নেতা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছাড়িয়ে কিভাবে সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী জনগণের প্রতীকে পরিণত হতে পারেন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ নেলশন ম্যান্ডেলা। এই সেই মহান মানুষ যার মৃত্যু পৃথিবীর সব সংবাদ মাধ্যম পত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার, ফেইসবুক, টুইটার এ শিরোনাম হয়েছে। একবিংশ শতাব্দিতে এটি একটি অসাধারণ ঘটনা। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ওশেনিয়াসহ পৃথিবীর মাধ্যমের শিরোনামে নেলশন ম্যান্ডেলা। যেই যুক্তরাষ্ট্র একদিন নেলশন ম্যান্ডেলাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করেছিল সেই দেশটিতেই এখন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ হচ্ছে তাঁর নাম। সংবাদ মাধ্যমগুলো নেলশন ম্যান্ডেলাকে ‘মানবতাবাদী’, ‘শান্তির দূত’, ‘ভবিষ্যত বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণাকারী’ সহ অসংখ্য উপাধিতে অভিহিত করেছে। রাশিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেল বলেছে, ম্যান্ডেলার সারা পৃথিবীর মানুষের এই ভালোবাসা অর্জন অলৌকিক।
নেলশন ম্যান্ডেলা মহান আদর্শের এক মহান প্রতীক। তিনি বিশ্বসম্প্রীতি আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মহান প্রতীক। ‘ম্যান্ডেলা : লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ ছবিতে ম্যান্ডেলার চরিত্রে অভিনয়কারী অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যান বর্ণবাদ বিরোধি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলশন ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ‘নেলশন ম্যান্ডেলা ছিলেন সত্যিকার অর্থে গত শতকের সবচেয়ে বড় মানুষের একজন’। ফ্রিম্যান আরো বলেছেন, ‘নেলশন ম্যান্ডেলা ছিলেন অসামান্য মর্যাদা, অদম্য শক্তি ও মনোবলের অধিকারী এক ব্যক্তি। বহু মানুষের কাছে তিনি এক সাধুর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। মুক্তি, স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদার জন্য সংগ্রামকারীদের কাছে তিনি এক বীর হিসেবে পরিগণিত হবেন’। উল্লেখ্য যে, ‘ম্যান্ডেলা : লং ওয়াক টটু ফ্রিডম’ ছবিটি ম্যান্ডেলা কর্তৃক ১৯৯৪ সালে আত্মজীবনীমূলক বইয়ের চিত্ররূপ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা নেলশন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে এক শোক বার্তায় বলেছেন, ‘নেলশন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ও বিংশ শতাব্দীর রাজনীতির এক বিশাল ব্যক্তিত্ব’। তিনি ম্যান্ডেলাকে ‘মানবজাতির এক মহান মুক্তিযোদ্ধা হিসেব অভিহিত করে বলেন, তাঁর মৃত্যুতে শান্তি, স্বাধীনতা ও সাম্যের জন্য নিরলস সংগ্রামী এক জীবনের অবসান হলো’। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ মহান নেতার জীবন-সংগ্রাম বিশ্বে সামাজিক ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় যাঁরা লড়ছেন তাঁদের পথ নির্দেশনা হয়ে থাকবে’। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বে অনেকে মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থ সংগ্রামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। গভীরভাবে আমাদের সাড়া দিয়েছে তাঁর জীবন গাথা’।
‘শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বৎসর পূর্তি অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান দিমিরেলের সঙ্গে নেলশন ম্যান্ডেলার বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী এ মহান নেতার আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং ম্যান্ডেলার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান’। (দৈনিক জনকণ্ঠ ৭ ডিসেম্বর, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ)। জননেত্রী শেখ হাসিনার মতো আরো বিশ্বনেতা নেলশন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। এই নেতার মৃত্যুতে সংবাদ টেলিভিশনের পর্দায় বিশ্ববাসীকে প্রথম অবহিত করেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকম জুমা। গভীর রাতে টেলিভিশন ভাষণে জুমা বলেন, ‘জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো’। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা নেলশন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে জীবনে যা কিচু অর্জন করা যায় ম্যান্ডেলা তার চেয়ে বেশী কিছু অর্জন করেছেন। তিনি অন্যদের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন’। ভারত নেলশন ম্যান্ডেলাকে গান্ধীবাদী মহান নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ভারতের প্রধানন্ত্রী ড. মনমোহন সিং শোকবার্তায় বলেছেন, ‘বিশ্বে সৌহার্দ্য ও সংহতি স্থাপনের মহান উদাহরণ নেলশন ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলাকে ভারতের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি’। ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশের মাধ্যমে বলেন, ‘ম্যান্ডেলা তাঁর নিজ দেশের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তাঁর পরিশ্রমের ফসল আজকের শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকা আমরা দেখতে পাচ্ছি’। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এক বাণীতে ম্যান্ডেলাকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে অভিহিত করেন। বান কি মুন নেলশন ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ, তাঁর মানুষের প্রতি মর্যাদা, সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য তাঁর নিঃস্বার্থ সংগ্রামে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বিশ্বনেতৃবৃন্দের এই সব মন্তব্যে সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়, বর্ণবাদ বিলোপে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে নিরন্তর সংগ্রাম, ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলন, মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবতার মহান আদর্শের এক মহান প্রতীক, মহানুভবতা, ধৈর্য এবং সহনশীলতার বিমূর্ত কালজয়ী মহানায়ক, নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, সংখ্যালঘু জনতার অধিকার আদায়ের বিরল অসাধারণ মহান নেতা, জাতিগত অধিকার, সচেতনতা ও মর্যাদাবোধের প্রতিষ্ঠায় মহান সংগ্রামী নেতা, নিরহংকার, ক্ষমা, মিত্রতা, ঐকতান সৃষ্টিতে নেলশন ম্যান্ডেলা বিশ্বনায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন।
স্বমহিমায় আলোকিত এই মহানায়ক নেলশন ম্যান্ডেলার জীবন বৈচিত্র্যপূর্ণ। দক্ষিণ আফ্রিকার মবাসবে নদীর তীরবর্তী ট্রান্সকেইর রাজধানী উমতাতার সন্নিকট মভেজো নামক এক ছোট্ট গ্রামে ১৯১৮ সালের জুলাই মাসের ১৮ তারিখ রোলিলাহলা ম্যান্ডেলা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল মাদিবা। পুরোনাম ছিল রোলিলাহলা ম্যান্ডেলা। ‘রোলিলাহলা’ শব্দের অর্থ হলো ‘গাছের ডাল ভাঙে যে’ অর্থাৎ দুষ্টু ছেলে। ম্যান্ডেলার পিতার নাম ছিল গাদলা হেনরি মগাকানইসা। মার নাম ছিলো নোসেকেনি ফ্যানি। নোসেকেনি ফ্যানি ছিলেন পিতা মগাকানইসার তৃতীয় স্ত্রী। পিতা মগাকানইসার চার স্ত্রী। তাঁর ১৩টি সন্তান ছিল। তন্মধ্যে ৪ পুত্র, ৯ কন্যা। যোসা ভাসিক টেম্বু গোত্রে ম্যান্ডেলার জন্ম। ডাক নাম ‘মাদিবা’ ছিল নিজের গোত্র থেকে পাওয়া।
রোলিলাহলা ম্যান্ডেলার বংশ ঐতিহ্যের ইতিহাস সমৃদ্ধ তাঁর প্রপিতামহ নগুলেংচুকা ছিলেন টেম্বু জাতি গোষ্ঠীর ইনকোসি এনখুলু অর্থাৎ রাজা। নগুলেংচুকা ১৮৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নগুলেংচুকা রাজার পুত্র হলেন ম্যান্ডেলা যিনি ছিলেন নেলশন ম্যান্ডেলার পিতামহ। ‘ম্যান্ডেলা’ হচ্ছে পিতামহ থেকে প্রাপ্ত বংশগত নাম। নেলশন ম্যান্ডেলার শরীরে রাজরক্ত প্রবাহিত হলেও তাঁর পিতামহ ‘ম্যান্ডেলা’ রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি কারণ নেলশন ম্যান্ডেলার পিতামহী ছিলেন ইহিবা গোত্রের। ভিন্ন গোত্রের হওয়ায় রীতি অনুযায়ী তাঁর শাখার টেম্বু রাজবংশে আরোহন করার অধিকার হারান। রাজবংশের উত্তরাধিকারী হতে না পারলেও পিতা মগাকানইসা মভেজো গ্রামের গ্রাম্য প্রধান বা মোড়ল ছিলেন। তবে নানাবিধ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে মতবিরোধের কারণে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরাজগভাজন হন এবং এরই প্রেক্ষিতে গ্রাম্য প্রধান বা মোড়লের পদ থেকে পিতা মগাকানইসাকে পদচ্যুত করা হয়। এর ফলে মভেজো গ্রাম ছেড়ে সপরিবার কুনু নামক একটি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন নেলশন ম্যান্ডেলার পিতা মগাকানইসা। এত কিছুর পরও মগাকানইসা ইনকোসিদের প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাদে টেম্বুর গভর্নর নির্বাচনে জ্যোঙ্গিন্তাবা দালিন্দোবোকে নির্বাচিত হবার ব্যাপারে প্রশংসনীয় ও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
মগাকানইসার মৃত্যুর পর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোলিলাহলা ম্যান্ডেলাকে দালিন্দোবো পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এর আগে রোলিলাহলার শৈশব কাটে নানার বাড়িতে। তাঁর মা ফ্যানি ছিলেন মপেন্ত হোসা গোত্রের নকেদামার কন্যা। যেই গ্রামে মগাকানইসার পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস সেই ‘কুনু’ গ্রাম সম্পর্কে কিচু জানা প্রয়োজন। এটি মফেজো গ্রাম থেকে পূর্বাঞ্চলীয় কেপে প্রদেশে অবস্থিত আরো ছোট্ট একটি গ্রাম। ইন্টারনেট থেকে নেয়া তথ্য অনুযায়ী এই কুনু গ্রামটি ছিল মফেজোর আরো উত্তরে। একটি সরু ঘাসাবৃত উপত্যকার মতো বসবাসের জায়গা। কোন রাস্তা নেই। পায়ে হেটে অত্যন্ত কষ্ট করে কুঁড়ে ঘরে যেতে হতো। তাও যেতে হতো গবাদি পশুর চারনোপযোগী তৃণ ও লতারপাতার গুল্ম পেরিয়ে। পরিবারের সদস্যদের খাবারের তালিকায় ¯’ানীয়ভাবে উদ্যাপিত ভূট্টা, সোংহাম, কুমড়া এবং সীম, মটরসুটি ইত্যাদি থাকতো। তাও তাদের সাধ্যের সীমিত আয়ের মধ্যে যা পেত তাই নিয়ে পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন জীবন চলতো। খাওয়া পানি পান করতো ঝর্ণাধারা এবং ছোট্ট নদী থেকে। কুঁড়েঘরের বাইরে রান্নাবান্না হোত। খেলাধূলার প্রতি রোলিলাহলা ম্যান্ডেলার ছিল প্রবল আগ্রহ। গাছ ও কাদামাটির তৈরী খেলার সরঞ্জাম দিয়ে ছোট্ট বন্ধুদের সাথে শিশু ম্যান্ডেলাড খেলাধূলায় নিমগ্ন থাকতো।
পিতার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পরামর্শে রোলিলাহলা ম্যান্ডেলাকে অদূরবর্তী একটি মেথোডিস্ট গীর্জায় খ্রিষ্ট্রিয় ধর্মধারায় পবিত্র বারিধারায় অভিসিঞ্চিত করা হয়। রোলিলাহলার বয়স যখন ৯ (নয়) বৎসর তখন তাঁর মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য যে রোলিলাহলা ম্যান্ডেলাই ১৩ জনের মধ্যে একমাত্র সন্তান যে স্কুলে পড়ালেখা করেন। জ্যোঙ্গিন্তাবা দালিন্দোবোর পোষ্যপুত্র হিসেবে রাজপ্রাসাদের সন্নিকটস্থ একটি মিশনারী স্কুলে লেখা পড়ায় প্রথম হাতেখড়ি। যেহেতু সেই সময় একটা প্রথা প্রচলিত ছিল খুব সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকায় বৃটিশ শিক্ষা পদ্ধতির প্রভাবের কারণে স্কুল শিক্ষিকা মদিঙ্গানে রোলিলাহলা ম্যান্ডেলার নামের আগে ‘নেলশন’ শব্দটি যুক্ত করে দেন। সেই থেকে শিশু ম্যান্ডেলা ‘নেলশন রোলিলাহলা ম্যান্ডেলা’ নামে পরিচিত হতে শুরু হন। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী নেলশন ম্যান্ডেলা নামে পরিচিত হন।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা