কবে সমাধান হবে রোহিঙ্গা সংকট !

15

রোহিঙ্গারা এখনও জগদ্দল পাথরের ন্যায় বাংলাদেশের গায়ের উপর বসে আছে। ছোট অথচ জনবহুল এ দেশটিকে নিজেদের জনসংখ্যার নানা সমস্যা সমাধানে যেখানে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে এগারো লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে দীর্ঘকাল আশ্রয়ে রাখা, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য নয় কী! বাস্তবতা হচ্ছে, সেই দুঃসাধ্য কাজটি বাংলাদেশকে করতে হচ্ছে সর্বশেষ ছয় বছর ধরে। এ ছয় বছরে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার একেবারে নিরব। চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মাঝেমধ্যে সরব হতে দেখা গেলেও কার্যত কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় এক অনিশ্চয়তার মধ্যে তাবু জীবন কাটাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের, সেইসাথে বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে বিশাল এ বোঝা। সমকালীন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য এক জগদ্দল পাথর বৈ কি! এ পাথর যত তাড়াতাড়ি সরানো যাবে ততই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল হবে, নচেৎ দেশের আইন-শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অতিসম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবিরে গোলাগুলি, খুন, ডাকাতি ও ধর্ষণের মত ঘটনা অশনি বার্তা দিচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি কক্সবাজার জেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অসামাজিক কার্যক্রম বৃদ্ধির পেছনে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন এবং তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক অভায়রণ্য ধ্বংস হতে চলছে। গাছগাছালি ও বনজঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এরফলে সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকা কক্সবাজার পরিবেশগত মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। কক্সবাজারবাসী অনুযোগের সাথে বলছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে তারা নিজ গৃহে পরবাসী হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজার পর্যটন এলাকার মর্যাদা হারাবে বলেও মত দেন বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশের কক্সবাজারে অশ্রয় নেয়। এর আগে প্রায় ১৯৮২ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আরো চার বার রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। । তবে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ আশ্রিত সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। আগে পরে সব মিলিয়ে এখন এগারো লাখের অধিক রোহিঙ্গা দেশের প্রধান পর্যটন জেলা কক্সবাজারের উখিয়া, রামু ও টেকনাফ উপজেলায় আশ্রয়ে আছে তবে গত বছর এখান থেকে কয়েকহাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। মিয়ানমার সরকার ও তাদের সামরিক বাহিনীর জাতি বিধ্বংসি গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে রোহিঙ্গারা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সীমানা খুলে দেয়া হয় একান্তই বিশ্ব মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক আহবানে। এটি ছিল একান্ত ই সাময়িক। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এসময় শেখ হাসিনার এ সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরৎ পাঠাতে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টিসহ বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বিগত ছয় বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান বা তাদের ফেরৎ নেয়ার ক্ষেত্রে কোন কার্যকর প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। আগেই বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘ সময় চলমান থাকলে বাস্তচ্যুত এই জনগোষ্ঠীর কট্টরপন্থা, সন্ত্রাস এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে এবং এর ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও বৃহত্তর এ অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। উদ্ভুত এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ২০২১ সালের ১ ফেব্রæয়ারি সামরিক অভ‚্যত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত। সামরিক সরকার এখন চীনের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এ কারণে চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে রোহিঙ্গাদের দ্রæত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারে। চীনের এই পদক্ষেপ রাখাইনে স্থিতিশীলতা এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। আমরা আশান্বিত হয়েছি যে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরপর এবছর ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিতভার্চুয়াল বৈঠকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি চীনের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুও ঝাওহুই উপস্থিত ছিলেন এবং আলোচনা শেষে প্রত্যাবাসন শুরু করতে সব পক্ষ সম্মত হয়। চীনের এধরনের আন্তরিক উদ্যোগ সংকটকে সমাধানের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং বিস্তৃত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ইতিবাচক অবস্থানকে আরো জোরদার করতে দেশের ক‚টনেতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে সেইসাথে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করতে হবে।