‘অ শ্যাম রেঙ্গুন ন- যাইও …’

24

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

ভারতীয় বিখ্যাত পুরানা হিন্দি মুভি পাতেঙ্গার একটি প্রসিদ্ধ গান,‘মেরি পিয়া গেয়্যি রেঙ্গুন কিয়া হে উহাঁসে টেলিফোন তোমহারি ইয়াদ সাতাতি হে।’ অত্যন্ত ভাইরাল একটি গান, সম্ভবত ১৯৫০-এর পূর্বের হবে, এখনো সমান জনপ্রিয়! শামশাদ বেগম ও মুকেশের দ্বৈত-কণ্ঠে গাওয়া গানটি শুনলে আজও দেহ তরঙ্গায়িত হয়। আমার প্রিয় রেঙ্গুন গেছেন, সেখান থেকে তিনি টেলিফোন করেছেন, তোমার স্মৃতি পীড়া দিচ্ছে। এ কথাটি উক্ত কলিতে বলা হয়েছে, এবং রেনুকা দেবী তা বলছেন। আর ওদিকে পতিদেব চারজন বর্মি তরুণীকে বগলদাবা করে বলছেন, ‘হাম ছুড়কে হিন্দুস্তান বহুৎ পস্তায়ি হোয়ি ভুল জো তুমকো সাথ না লেকর আয়ি। হাম বার্মা কি গলিওঁ মে, অওর তুম হো দেরাদূন, তোমহারি ইয়াদ সাতাতি হে।’আমি হিন্দুস্তান ছেড়ে এসে অনেক আফসোস করেছি, ভুল হয়েছে তোমাকে সাথে না আনাটা। আজ আমি বার্মার গলিতে পড়ে আছি, আর তুমি দেরাদূনে, তোমার স্মৃতি পীড়া দিচ্ছে। মুখে এ কথা বলছেন আর বুকে তার চার তরুণী করছে খেলা, হাহাহাহা।এই ছিল তৎকালীন বার্মার স্বাভাবিক চিত্র।
উপমহাদেশের অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তৎকালীন যুবকরা জীবিকা আর সেবিকার সন্ধানে জলপথে ও স্থলপথে বার্মায় পাড়ি জমাতেন সচরাচর। বার্মার তরুণীগণ ছিল তাদের মনোরঞ্জনের খোরাক, ফলে উপমহাদেশীয় বহু তরুণ এককালে রুজির তাগিদে গিয়ে বউঝি নিয়ে চির তরে সেখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বার্মাকে একপ্রকার মোদের বাপদাদাদের শশুরবাড়ী বলা চলে। এখনো কুষ্ঠি ধরে খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে আমাদের রক্তের সম্পর্কের প্রচুর আত্মীয়স্বজন রয়েছে। তবে বিষয় সেখানে নয়, বিষয় হল বার্মা একসময় আমাদের বিনোদন কেন্দ্র তথা বাগানবাড়ি ছিল। এদেশীয় তরুণ, যুবকদের সেখানকার বিনোদন-বালারা তীব্র আকর্ষণ করত, তাই চট্টগ্রামের সংগীতের মালেকা, সুরেররাণী শেফালী ঘোষ গেয়েছিলেন, অ শাম রেঙ্গুন ন- যাইও। অর্থাৎ ওগো শ্যাম তুমি রেঙ্গুন যেও না। এই গানটির মধ্য দিয়ে এদেশীয় তরুণীদের মনের কথা ফুটে উঠেছে। তারা রেঙ্গুন, আকিয়াবের মক্ষিরাণীদের ভয় করত, পাছে তাদের পরাণ ভোমরদের তারা টান দেয়। এ কারণে এদেশের তৎকালীন নারীরা পুরুষদের বার্মায় যেতে নিরুৎসাহিত করত। কিন্তু কালের প্রবাহে এখন সবকিছু উল্টা হয়ে গেছে।
এখন দেখা যায় আমাদের নারীরা অনেক এগ্রেসিভ ও প্রগ্রেসিভ। তারা এখন ভীতও নয় নতও নয়, তারা এখন মহিমান্বিত। ফলে দু-চার-দশটা ছেলে বন্ধুর সাথে তারা সম্পর্ক মেন্টেইন করে। সে সুবাদে মিনি বার্মা এখানে শুরু হয়েছে, ইডেন কলেজ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়, টিএসসি তার প্রকৃষ্ট নমুনা প্রেমের যমুনা। বার্মা একসময় যা করত, আমাদের কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়গুলো এখন তা করছে, ভার্জিন সাপ্লাই, বিনোদন বালা এ্যাপ্লাই। এবং এই সাপ্লাই ও এ্যাপ্লাই কাজে নিয়োজিতও রয়েছে অনেকে। একসময় বার্মার তরুণীরা পাগল ছিল আমাদের তরুণদের জন্য। এমন কি অং সান সুচিও নাকি এক পাকিস্তানি যুবকের জন্য দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। বার্মার সেই হাওয়া এখন আমাদের দেশে এসে লেগেছে, আমাদের কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে এখন প্রমোদবালার ছড়া ছড়ি। কাজেই হাওয়া গেল ঘুরে, যে বার্মা একসময় আমাদের প্রমোদবালা সরবরাহ করত সে বার্মা এখন আমাদের বোমা প্রয়োগ করছে।
আশ্চর্য বিষয়, যারা একসময় আমাদের মক্ষিরাণী দিয়ে আকর্ষণ করত তারা এখন বুলেট মেরে বিকর্ষণ করছে। তাজ্জব কথা আমাদের শালারা আমাদের ঝালাপালা করছে, মনে হয় দুলাভাইয়ের সাথে মস্করা করছে, হেহেহেহে।
ভাবতে অবাক লাগে বার্মা এ শক্তি, এ সাহস কি করে অর্জন করল! অথচ একসময় তারা আমাদের চাইতে অনেক দুর্বল ছিল, যা উল্লেখিত আলোচনা হতে এবং ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান। তাহলে চলুন এবার একটু ইতিহাস থেকে ঘুরে আসি। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দের কথা, জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ছিলেন তখন বাংলার সুলতান। আরাকানরাজ মেং সোয়াম্ উন ব্রহ্মদেশের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজ্য হারান এবং বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন-এর কাছে আশ্রয়গ্রহণ করেন। জালালউদ্দিন তাঁর রাজ্য উদ্ধারের জন্য এক সৈন্যবাহিনী পাঠান। কিন্তু ঐ বাহিনীর অধিনায়ক বিশ^াসঘাতকতা করে ব্রহ্মরাজের সঙ্গে যোগ দেন এবং উনকে বন্দী করেন। উন কোনক্রমে পালিয়ে এসে জালালউদ্দিনকে সব কথা খুলে বলেন। জালালউদ্দিন তখন অন্য এক সেনানায়ককে পাঠান এবং তাঁর প্রচেষ্টায় আরাকানরাজের হৃত রাজ্য উদ্ধার হয়। তাহলে দেখুন, মাত্র এক পল্টন সৈন্য পাঠিয়ে বাংলার সুলতান, ব্রহ্মদেশকে পরাজিত করে ছিলেন! অতএব ভেবে দেখুন তৎকালীন বাংলা ব্রহ্মদেশ থেকে কত বেশী শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তাই বলে ভাববেন না, জালালউদ্দিন বেশী শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন। তাঁর চাইতে অনেক অধিক শক্তিশালী নরপতি তখন মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান।
১৪২০খ্রিস্টাব্দের কথা, জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কী সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহের রাজ্য তথা বাংলা আক্রমণ করেছিলেন। তৈমুরলঙ্গের পুত্র শাহরুখ তখন পারস্যের হিরাটে ছিলেন। জালালউদ্দিন তাঁর কাছে দূত পাঠিয়ে ইব্রাহিমের আক্রমণের কথা জানান। আব্দুর রাজ্জাক রচিত ‘মতলা-ই-সদাইন’, চীনা গ্রন্থ ‘মিং-শ-র’ ও গোলাম হোসেন সলিম রচিত ‘রিয়াজ-উস-সলাতীন’ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শাহরুখ ইব্রাহিম শর্কীকে অবিলম্বে বাংলা আক্রমণ বন্ধ করতে আদেশ করেন। ফলে ইব্রাহিম বাংলাদেশের উপর হস্তক্ষেপ করা থেকে চির বিরত হলেনÑসূত্র: বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, কে এম রইছউদ্দিন খান। তৎকালীন বিশ্ব মুসলিমদের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল। শাহরুখ মির্জার পিতা জগদ্বিখ্যাত, ইতিহাস খ্যাত, দিগি¦জয়ী বীর তৈমুরলঙ্গের নাম শুনলে গোটাদুনিয়া তখন কাঁপত। হিরাত, শিরাজ, উজবেক, কাজাখ, আজারবাইজান, আফগান, পারস্য নিয়ে মধ্য এশিয়ায় বিশাল সা¤্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন শাহরুখ। আর এই তৈমুরলং পুত্রের নামে আজকের বলিউড বাদশার নাম শাহরুখ খান। শাহরুখ মির্জার ভাই মীরণ শাহ মির্জার বংশধর ছিলেন বাবর, আকবর, ঔরঙ্গজেব প্রমুখরা। এবং পরবর্তী চারশত বছর তাঁদের বংশধরগণমহাদাপটের সঙ্গে বিশ্বে রাজত্ব করে গেছেন।
সুতরাং এ কথা পরিষ্কার বাংলাদেশের তুলনায় বার্মা বরাবরই অত্যধিক দুর্বল ছিল এবং আরাকান ঐতিহাসিকভাবে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। বর্তমানে বার্মার আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ আমাদের অতি বিস্মিত করছে। তবে আরাকান একটি স্বতন্ত্র সত্তা, সেটি বার্মার অংশ ছিলনা। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহর উপকারের কারণে আরাকান তাঁর সামন্তরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে মেং সোয়া মুনের পুত্র মেং-খরি বিদ্রোহ ঘোষণা করে রামু ও তার দক্ষিণাঞ্চল জয় করে নেন এবং পরে আবার তাঁরও পুত্র বসোআহ্প্যু চট্টগ্রাম জয় করেছিলেন। কিন্তু ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুলতান রুকনউদ্দীন বারবক শাহ চট্টগ্রাম পুনরধিকার করে নেন। ফলে বুঝাযাচ্ছে আরাকান এক স্বতন্ত্ররাজ্য ছিল। পরবর্তীতে শক্তি সঞ্চয় করে বার্মা আরাকানকে নিজ রাজ্যভুক্ত করে নিল এবং রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে নাম দিল রাখাইন। কথায় আছে জোরযার মুল্লুক তার। বার্মা জোর জোগাড় করতে পেরেছে তাই মুল্লুকও তার হয়েছে। একই অবস্থা চলছে এখন আমাদেরও দেশেÑস্কুল, কলেজ আর ভার্সিটিতে। এখানে কিছু প্রেসার গ্রæপ সৃষ্টি হয়েছে, তারা প্রেসার দিয়ে হলের মেয়েদের বড় ভাইদের কাছে উপঢৌকন পাঠায়। বড় ভাইরা উপঢৌকন পেয়ে সন্তুষ্ট হয় এবং প্রেসার গ্রুপ তাঁদের আশীর্বাদে সিক্ত হয়।
আসলে ক্ষমতা যার আছে সে তা দেখাবেই। বার্মা একসময় ছিল পতিতালয় এখন হয়েছে যমালয়, ফলে সে রোহিঙ্গাদের মেরে তার ক্ষমতা দেখাচ্ছে সেইসাথে আমাদের দেখাচ্ছে। কারণ একসময় তা ছিল আমাদের শশুরবাড়ি, বালাখানা, এখন সীমান্তে গুলি-বোমা মেরে হয়েছে জ¦ালাখানা। মূলত আমাদের যে তারা সেবাদাস ছিল, সে কলঙ্ক ঘুচাতে আজ তাদের এই প্রচেষ্টা! হাহাহাহা।
আবার ইডেন-জাবি, এসব ছিল একসময় বিদ্যালয় এখন হয়েছে প্রমোদালয়। ফলে এই অসামান্য কৃতিত্ব যাদের অবদান, সেই কীর্তিমানদের সম্মানে নিশ্চয় করিতে হয় বলিদান। তাই কীর্তিমানদের কৃপায় যারা জাবি, ইডেন গুলবাগের মালী হয়েছে তারা বাগের গুলদের সুন্দর সুন্দর ফুলদের শোনায়, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি বলে যায় তোমায় আমার সারাটা হৃদয় আবেশে জড়াতে চায়।’ আর ফুলেরা দলে দলে ছুটে যায় পলে পলে মেহফিলে অর্ঘ্য দিতে কীর্তিমানদের পদতলে। নিজেরে সঁপে তারা জৌলুস করে পূর্ণ, করে মহাঅর্জন সব দিয়ে বিসর্জন। সৌরভে মজে তৃপ্তহয় মহান, ভোমরের পরশে পুষ্পের অবসান। এবার ইডেন বিষয়ক বক্তব্যের শানেন যুল শুনুন, সামাতে ইডেনের একমেয়ে ছদ্মনাম পরিচয়ে লিখেছে তার সারমর্ম এই, ‘যাদের দয়ায় তারা হলে স্থান পায়, সে আপারা মিটিঙের কথা বলে তাদের বাবার দরবারে পাঠায়, বাবা কারবার সেরে যায় সরে, তারা আফসোস করে মরে,’ হেহেহে।
অতএব উপায় নাই গোলাম হোসেন, যার ক্ষমতা সে’ই মহাসেন। বর যেমন আপনক্ষমতা দেখাতে স্ত্রীকে ট্রেন থামিয়ে দেখিয়েছে, ঠিক তেমন ট্রেনের চালকও তার ক্ষমতা দেখাতে বরকে চড় মেরে গিয়েছে। ফলে ক্ষমতা থাকলে দেখাবে, বারণ সে না মানিবে একডাং বেশী দেখাতে পরলেই কেবল থামিবে। কাজেই রেঙ্গুন ন-যাইও বলে লাভ নেই, রেঙ্গুন সে যাবেই, যদি তুমি ইডেন যেতে পার তবেই সে থামিবে। তবে সাকিব খানকে নিয়ে যা হয়ে গেল সেটি কি রেঙ্গুন না, ইডেন? তিনি দুইবিয়ে করেছেন সমস্যা কি? তিনি তো বলেছেন দুইজনকে বিয়ে করেছেন, অনেকে চার বা ততোধিক করেছে। তাকে নিয়ে যারা ট্রল করছে, তারা পারলে আরো বেশী করত। পারছে না বলে আঙ্গুর ফল টক, পারলে বলত হক করত সব লক। আজ চারিদিকে কেবল অস্থিরতা, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র, মেয়ে দেহে নাই বস্ত্র, তাই যুবকরা হয়ে উঠছে হিংস্র। ফলে সবাই যে যার ক্ষমতা দেখায়। দেখা যায় নারীরাই নারীদের ক্ষতি করে বেশী। যেসব নারীবাদীরা কথায় কথায় গর্জে উঠে সাম্প্রতিকইডেন কাণ্ডে তাদের কোন উচ্চবাচ্য করতে দেখি নাই। সাকিবের যে দ্বিতীয় স্ত্রী সেও তো একজন নারী, তবে কেন সে প্রথমস্ত্রীর ঘর ভাংল? নারীই নারীর প্রধান শত্রু, তাই সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বিচারক কথায় কথায় বলতেন, শের্শে লা ফাম মেয়েটিকে খোঁজ। শেষ কথা হল, এখন আর রেঙ্গুন ন-যাইও হবে না, এখন হবে, পাখি ইডেন ন-যাইও, হোহোহোহো।
লেখক: কলামিস্ট