শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রার তাৎপর্য

74

আসমুদ্র হিমাচল ভারতভূমির পূর্ব প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের মনোরম সমুদ্রতটে জগতপতি শ্রী জগন্নাথদেব নিত্য বিরাজমান। একইভাবে পরমেশ্বর ভগবান ভারতের উত্তরে হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় বদ্রিনারায়ণ রূপে, পশ্চিমে আরব সাগরের তীরে দ্বারকাধীশরূপে এবং ভারতের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তে রামেশ্বর রূপে পূজিত হচ্ছেন। জগন্নাথ শব্দের অর্থ জগতের নাথ। বিভিন্ন পুরাণে শ্রীজগন্নাথদেবের মহিমা বর্ণিত হয়েছে। পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব, তাঁর অগ্রজ ভ্রাতা বলদেব ও কণিষ্ঠা ভগ্নি সুভদ্রা মহারাণীকে নিয়ে পুরী ধামে রত্ন সিংহাসনে বিরাজিত আছেন। সত্যযুগে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুত্র স্বর্গলোকের দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে দিয়ে পুরীর শ্রীমন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রজাপতি ব্রহ্মা তা উদ্বোধন করেছিলেন। বৈদিক স্থাপত্য ও শিল্পকলার বিচারে এই শ্রীমন্দির আধুনিক যুগেও এক বিস্ময়কর সৃষ্টিকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জগন্নাথের সেবকেরা যুগ যুগ ধরে তাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে জগন্নাথদেবের সেবা করে আসছেন। এই শ্রীমন্দিরে শ্রীবিগ্রহের আকৃতি এবং সেবা পূজার ধরন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। ভগবান এবং ভক্তের এক অপূর্ব প্রেমময়ী সেবাভাবের বিনিময় এখানে দেখা যায়। সারা বছরব্যাপি লক্ষ লক্ষ ভক্তবৃন্দ এই মন্দির পরিদর্শন করে ভগবানের কৃপা লাভ করে থাকেন।
ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের বিবিধ উৎসবের মধ্যে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যমন্ডিত উৎসব হল রথযাত্রা মহোৎসব। আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়া বা রথ দ্বিতীয়া তিথিতে এই মহোৎসব উদ্যাপিত হয়। ভক্ত ও ভগবানের মিলনের ব্যাকুলতা এই উৎসবের প্রতিপাদ্য বিষয়। এই দিন তাঁর ভক্তদের দর্শন দানের মাধ্যমে তাঁর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি রতœবেদী ত্যাগ করে রাজপথে বেরিয়ে আসেন। অন্যসময় আমরা দেখি ভক্ত ভগবানকে দর্শন এবং প্রার্থনা করার জন্য মন্দিরে ছুটে যায়। কিন্তু রথযাত্রায় ভগবান স্বয়ং তাঁর ভক্তদের দর্শন দেওয়ার জন্য রথে আরোহন করে রাজপথে পরিভ্রমণ করেন। এই জন্য জগন্নাথদেবের আরেক নাম পতিত পাবন। বিষ্ফোরিত নেত্রে দু’হাত বাড়িয়ে তাঁর ভক্তদের আলিঙ্গনের জন্য তিনি সদা প্রস্তুত। করুণাময় পতিত পাবন শ্রী জগন্নাথদেবের এই উৎসবে সকলে অংশগ্রহণ করে তাদের মানব জীবনকে ধন্য করার সুযোগ লাভ করেন।
রথযাত্রার উৎপত্তি সম্পর্কে বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। দ্বাপর যুগের শেষভাগে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্য পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দ্বারকাধীশরূপে রাজত্ব করার সময়ে একবার সূর্যগ্রহণের সময় সমস্ত দ্বারকাবাসীদের নিয়ে তিনি কুরুক্ষেত্রের ব্রহ্মকুন্ডের তীরে উপনীত হয়েছিলেন। এইদিকে সমস্ত বৃন্দাবনবাসী ভক্তরাও সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রে এসেছিলেন। অনেককাল পরে ব্রজবাসীদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মিলন হল। ব্রজবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে রাজবেশে দর্শন করতে চাইলেন না। তারা ভগবানের উদ্দেশ্যে মিনতি নিবেদন করেছিলেন, “হে আমাদের প্রাণনাথ কৃষ্ণ, দেখ এখানে আমরা সকলে রয়েছি, তুমিও এখানে উপস্থিত রয়েছ, কিন্তু শুধু একটি বিষয়ের অভাব রয়েছে। সেটি হচ্ছে আমাদের বাল্যলীলাস্থলী বৃন্দাবন ধাম, যেখানে আমরা মধুময় বাল্যলীলা উপভোগ করেছিলাম। চল, চল, আমরা আবার সেই বৃন্দাবনের অরণ্যে ফিরে যাই।” এই বলে ব্রজবাসীগণ কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর রথের ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রথ টানতে টানতে শ্রীধাম বৃন্দাবনে নিয়ে গেলেন। সেই লীলাকে স্মরণ করে আজও সারা পৃথিবীর ভক্তগণ শ্রীজগন্নাথদেবকে বৃন্দাবনে (গুন্ডিচা মন্দির) নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। ভক্তরা যেভাবে রথের রশি ধরে ভগবানকে হৃদবৃন্দাবনে আকর্ষণ করেন, সেইরকম ভগবানও তাঁর ভক্তদের এই জড় জগতের জন্ম মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত করে তাঁর ধামে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কেউ যদি রথের দড়ি ধরে টানে বা রথ স্পর্শ করে বা রথোপরি বিগ্রহ সমূহকে দর্শন করে তাহলে তার মুক্তি সুনিশ্চিত। পরম করুণাময় শ্রীজগন্নাথদেব সমস্ত জীবকে কৃপাবারীতে অভিষিক্ত করে তাঁর ধামে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
আজ হতে ৫০০ বছর পূর্বে কলিযুগ পাবনাবতারী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথ পুরীতে অবস্থানকালে এই রথযাত্রা মহোৎসবে যোগদান করে এই উৎসবকে এক মহিমান্বিত রূপ প্রদান করেছিলেন। সারা ভারতবর্ষ হতে আগত তাঁর ভক্তগণসহ তিনি হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে নৃত্যগীত করতেন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ধারায় আধুনিক যুগে ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ভারতবর্ষের বাইরে সারা পৃথিবীতে এই উৎসবের প্রচলন করেছেন। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যদেশে রথযাত্রা উৎসবের শুভ সূচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে তথা প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন, মস্কো, লন্ডন, বেইজিং, টোকিও, দিল্লী, কলকাতা, সিডনী, মধ্যপ্রাচ্যর প্রতিটি শহর, রোম, বার্লিন ও ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ সমগ্র বিশ্বে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলে রথযাত্রা মহোৎসবে যোগদান করে থাকেন। এভাবে রথযাত্রা মহোৎসব সমসাময়িক বিশ্বে সর্ববৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়েছে।
জাতিগত বিদ্বেষ, হিংসা হানাহানি, ধর্মীয় উন্মাদনায় যখন আমাদের আবাসভূমি পৃথিবী নামক গ্রহটি বিপর্যয়ের সম্মুখিন, বিশ্বনেতৃত্ব দিকভ্রান্ত, মানবতা রক্তাক্ত, তখনই শ্রীজগন্নাথদেবের কৃপাপুষ্ট রথযাত্রা উৎসব বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্য সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে সমস্ত মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে মৈত্রীময় ও প্রীতিময় পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে। সারা বিশ্বে ইস্কন ফুড ফর লাইফ প্রোগ্রামের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নিরন্ন মানুষকে খাদ্য বিতরণ করছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে খাদ্য, ত্রাণসামগ্রী ও ঔষধ বিতরণ করে যাচ্ছে, এ জন্য ইস্কন ফুড ফর লাইফকে জাতিসংঘ বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছে। সমস্ত প্রকার প্রাণী হত্যা বন্ধ, সমস্ত প্রকার নেশা বর্জন, অবৈধ যৌন সঙ্গ বর্জন ও সমস্ত দূতক্রীড়া বর্জন- বৈদিক শাস্ত্রের এই চারটি পাপকর্ম বর্জনের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ইস্কন এক যথার্থ শান্তি ও কল্যাণময় বিশ্ব গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র, সুশীল সমাজ ও অভিভাবক শ্রেণি যখন যুব সম্প্রদায় নিয়ে হতাশাগ্রস্থ ঠিক তখনি ইস্কন সম্পূর্ণ নেশা বর্জনের শিক্ষার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ যুব সম্প্রদায়কে আলোর পথে ফিরিয়ে আনছে।
আবহমান কাল ধরে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমস্ত ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি পালন করে আসছে। এই পরম সুশীতল বাতাবরণকে অবলম্বন করে ইস্কন সোসাইটি এই দেশে সনাতনী কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করে সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে রথযাত্রা উৎসব বিশেষ ভূমিকা রাখুক- এই কামনা করি। দেশবাসীকে রথযাত্রার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

লেখক : ইস্কন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, চট্টগ্রাম।