বাড়ি নির্মাণ ঃ আগস্ট ১৯

215

আগে কবিতা লিখতাম প্রতিদিন। কবিতার ভেতর থেকে খুঁটে খুঁটে তুলতাম পৈত্রিক চারা গাছ-উদ্ভিদ বলি যাকে এবং সেটা দহন দিনের বৃক্ষ। মাশরুম লিখলে যৌবনবতী সকাল, আকাশ লিখলে সেগুনবতী বৃষ্টির চোখ ফুটতো-
এখন কবিতার ভেতর দেখি বাড়ি নির্মাণের ইট, বালি, কনক্রিট। মিস্ত্রী, ইঞ্জিনিয়ারের নকশাবন্দি চোখে ভবিতব্য আঁকা। এই যে ব্যস্ততা, এই যে চিলে কোঠা রোদ, মশগুল দুপুর, ঘুরে ফিরে দেখি পঙক্তিগুল্মের মেঘলতিকা, গ্রাম্য বনবাদারের পাখিকুল
পক্ষান্তরে রড সিমেন্ট লিখলে জীবন এবং স্বপ্নের কবিতা হয়ে যাচ্ছে অনায়াসে

শরতের বৃষ্টি
কমরুদ্দিন আহমদ

এখানে আকাশে স্বপ্ন-কৃষাণীর মেঘের ধূসর চাদর
বৃষ্টি কন্যা ঝরে অবিরাম মেহগনিদের পাড়ায়
বিশুদ্ধ মায়া গাঢ় সবুজেরে চুমুর আবেগে নাড়ায়
গড়ায় ঝর্না, মাটির বুকে বাদামি রঙের আদর ।

ভোরের ঝরা শিউলিরা ভাসে, দিঘির মাছেরা নাচে
কাশের বনেরা স্নাতক-বিধবা অনাদৃতা শান্যাল
শঙ্খের না’য় ব্যস্ত ধীবর ফেলে ইলিশের জাল
ভেজা কাকেরা কার্নিশে চুপ নেই মাঠে আর গাছে ।

এখানে বৃষ্টি বিলায় বোনাস মিঠে বর্ষণ খরা
ইলশে-গুড়ির সোনারঙ সাজে নিলাজের ঘেউ-ঘেউ
রোপা-আমনের শ্যামল লহরি চুপ হয়ে যায় ফেউ
বৃষ্টি-ধন্য সবুজ বাংলা শস্যে-সুফলা ধরা।

অবাক সুন্দরবন
সাঈদুল আরেফীন

গোপন স্বপ্নান্বেষনে ছুটে চলেছি নিরুত্তাপ রাতে,
তন্দ্রালু চোখে দেখি সবুজাভ উদাসী মন
ঘোর লাগা হরেক বিচিত্র সব প্রাণীকুল ছুটে চলেছে
দিকবিদিক ছায়া-মায়ার অন্যরকম সুর আসছে
বন হতে বনান্তরে;
মধ্যরাতের জল থৈ থৈ করা সবুজ অরণ্যের ভেতর যাচ্ছি,
পাড়ি দিচ্ছি সাগরের লোনাজল, পা রাখছি আলো আঁধারিতে
কখনো নীল জলরাশি ছুঁয়ে যাচ্ছি হাতের তালুতে;
জেলি ফিশের কী আশ্চর্য সৌন্দর্য টানে আমাকে
দূরের সুন্দরবন মায়াবি আঁচল পাতে
নিবিড় কাঁদাজলে পাড় ভেঙ্গে,শত পাখি উড়ে যায়
যায় গাংচিল, বৈচিত্র্যের সমাহার এখানে ওখানে
নোঙর গড়ে জোছনালোক বিলায় জীবে-কীট-পতঙ্গে।
কটকায় ভোরের কুয়াশা ঝরানো আলোয় ফেলি পা,
দুরন্ত হরিণ শাবকেরাও ছুটছে স্বপ্নময় চালচিত্রের ভেতর
ভেসে ওঠে অবাক সুন্দরবন, গোলপাতার সমাবেশ
দুবলার চরে এসে মিলেছে নতুন জীবনপট;
সৈকতের বালিয়াড়ি নিরব আঁচলে ডুবে প্রজাতির পর প্রজাতি
ধাবমান লঞ্চ ছুটছে তো ছুটছে অন্ধকার রাত্রি নিশিতে
মাঝরাতে কাঁপে মন ঠান্ডা হাওয়ায় স্থির নক্ষত্রের মতো
সবুজের বনে রাশি রাশি সুন্দরী গেওয়া নাচে পরমাত্মীয়তায়
পূবে পশ্চিমের জঙ্গল; হিরণপয়েন্ট আর করমজল হাতছানি দেয়
গাঙ্গেয় বদ্বীপে, ত্রিমাত্রিক স্বপ্নান্বেষণ খোঁজে
আশৈশব শ্বাসমূলীয় নিঃশ্বাস জ্বালিয়ে জীবনবাতি।

বিস্মিত স্পিকার
জামশেদ উদ্দীন

দেখো, ওরা বেহুলা-ল²ীন্দরের
মর্মকথায় ব্যতিত নয়,
তাই রোদ-খরায় তারা তাবিজ নয়।
সমুদ্রের ঢেউ-গর্জনে জাগ্রত হয় না,
দিবানিশি নেশায়-মাদকতায় ভুঁদ;
ওরা ওদের মতো বিচ্ছিন্ন
দ্বীপে বাস করে!
ওরা মায়া হরিণের কেওয়া কেওয়া
ডাকে বিস্মৃত নয়।
ওরা পুতুল নাচের ইতিকথা,
জীবন সুতোর নিরবচ্ছিন্ন বন্ধন
ছিন্ন করে নির্লজ্জো অনুভবে।
তারা শহরের চিলেকোঠা
আভিজাত্যের চরকাকারণ,
তাই ঝুলন্ত স্পিকারে শৃগালের হুয়াহু
ডাক-সবুজের বনবাগান উজার;
অতঃপর গালগল্পে বাজিমাত
যতসব আড্ডুরা।
তারা মেঠোপথ, শীতল ছায়া-শষ্যের
অঙ্কুর, ভেজামাটি মাড়ায় না।

অষ্টপ্রহর
চৌধুরী শাহজাহান

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর দেশে এলো প্লাবন খড়া
বৃষ্টি পড়ে পাহাড়তলী বাদামতলী আর মোহরা
বৃষ্টি পড়ে বি-বাড়ীয়া ফেনী ঢাকা চট্টগ্রামে
ভরা শ্রাবণ, শুধু তোমার কথা পড়ে মনে।

পতেঙ্গার সী-বিচ হলো বাদল মাতাল
নতুন সড়ক বৃষ্টিতে হলো উথাল পাতাল
তোমার মনের এলোকেশী উদাস বাতাস
এসো সাগর বিহার করে মাতি উল্লাস।

বৃষ্টি পড়ে সিআরবিতে শিরিষ বনে
দু’জন বৃষ্টি ভিজে স্বপ্ন বুনি নির্জনে
তোমায় খুঁজে আজ তৃষিত রক্তিম অধর যুগল
এসো বর্ষায় ভেসে বেড়াই অথই জলে।

আষাঢ়স্য প্রথম দিনে তোমার কথা মনে পড়ে
প্রিয়তমা, তুমি যে নেই কাছে চলে গেছো দূরে
জানতে ইচ্ছে করে, কিভাবে কাটাও অষ্টপ্রহর
ওগো বর্ষা, তোমায় আমার ভীষণ মনে পড়ে।

টান
জাহিদ হোসেন

সুনীল স্বনির্ভর আকাশে সোনাঝরা তারায়
রাতের কাবিনে ঝুলে থাকে কোজাগরী চাঁদ
বাংলা মাটির টান আছে, গান আছে
সুর আছে আকাশে বাতাসে-

এখনও ছুটে যায় মেয়েরা লেইস ফিতার টানে
ছেলেরা জেমসের গানে,
কাঁচ-ঘেরা বাক্সে বাতাসাওয়ালার টুংটাং
বাদরখেলার ঘুটঘটি, সাপখেলা এখনও টানে
আজও সূর্য ওঠে আজও হয় ভোর
নাড়ির টানে বুকপকেটে তুলে রাখে আনলিমিটেড আদর।

জীবনটা সংজ্ঞাশূন্য
কৌশিক সূত্রধর

জীবনটা লিপিহীন কাব্যের ভূর্জপত্র
ক্ষণিকেই মিলিয়ে যায় সিংহনাদ
কল্পিত জীবন রয়ে যায় সংজ্ঞাশূন্য,
হাত বাড়ায় আর্তনাদের ছায়াপথ।
জন্মলাভ ঘড়ির ন্যায়,
নিরন্তর ঘোরপাক খাওয়া একই সমান্তরালে
স্মৃতির ক্যালেন্ডার পড়ে রয় অস্তিত্ব অনাদরে
অগুচরে ধুলোর আস্তরণে মাখামাখি।
ক্ষণিকেই টিকটিকি হয়ে উঠে রাক্ষস,
সময় ঢলে পড়ে পাহাড়ের ফাটল ঘেঁষে
যেনো বেদনার নীলোৎপল…
পরিযায়ী পাখির ন্যায় খন্ডিত জীবন
স্বত্ব ক্ষণিকেই ভেসে উঠে আকাশে,
বয়ে যাওয়া সময় ফিরে আসে স্মৃতিচরে।
প্রতি মুহূর্ত ছুটে চলে অস্বস্তিকে ঘিরে
জীবনে লাগামহীন ঘোড়া হয়ে….

শরৎ এসেছে
স্বপন শর্মা

বর্ষার পর্ব শেষ
কালো মেঘ ফিরে যায়।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে পায় আকাশ
নতুন স্নিগ্ধ ছোঁয়া তার অবয়বজুড়ে
গগন ক্যানভাসে শৈল্পিক অনিন্দ্য কারুকাজ।

সবুজ নীলের মাঝে সাদা আস্তরণ
দূর্বাঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু
কাঁশবনে দোলে বকের পালক।

তাল পাকা সোনা রঙে রোদ আসে
ভাদ্র আসে তার মহিমায় মেঘের ভেলায়
সওদাগরের হাঁটার মতো ছুটে চলে মেঘ

মেঘের ছোটাছুটি বলে দেয়…
শরৎ এসেছে।
রাতের প্রহরগুনি বটঘুঘুর ডাক শুনি
কুমোরপাড়া মেতে ওঠে শারদীয় উৎসবে।

জেসমিন জুঁই
জালাল জয়

রাতের কোন নিজস্ব জমি নেই
আকাশের চোখে চোখ রেখেই
তার আঁধারযাপন কিংবা জ্যোৎ¯œায় ¯œান
কল্পনার যতই
বিলাসিতা থাকুক না কেনো
তার ভেতরে ডুবে যেতে
আমার কোনো সাধ জাগেনা

আমি তো তার ভেতরেই
ডুবতে ডুবতে দিশেহারা
কাজল চোখের ইশারায়
রাত্রীর মায়া খুঁজি
চোখেমুখে একটাই ভাষা
কোমল ঠোঁটে এক বিন্দু জল পেলে
মনের ভেতর তৈরি হয় স্বর্গ জমিন
এমনও হাওয়ায় আমি উড়তে উড়তে
ছুটে আসি সুখের দোলনায়
পৃথিবীর বুকে আমি এঁকে দেই
আঁধার কিংবা জ্যোৎ¯œার মায়া
শিউলীর ফোঁটা কোন এক রাত্রীর ছোঁয়ায়…

চাঁদের জোছনায় করবো গোসল
জোবায়ের মিলন

এই শরতে আমরা চাঁদের জোছনায় গোসল করবো। আমাদের প্রত্যেকের হাতে গোলাপের অসংখ্য পাপড়ী থাকবে বেথুন পাতার মতো সবুজ। মাটিতে বিছিয়ে পড়া বাকলের সাথে বন্ধুত্ব পেতে কথা বলবো দিনের অধিকাংশ সময় ধরে আর উঠানে বসে মারফতি গান শুনবো মনের আনন্দে। তখন শিশুরা মায়েদের পাশে বসে হাসবে, ধানের দুধ খাবে, নিজেদের ভাষায় কল্পনা করবে এবং নারীরা পানের খিলি মুখে পুরে এর, ওর দিকে চেয়ে চেয়ে উপভোগ করে শরতের রাণী-রূপ… শরতের নিজস্ব আলো খেলায় ভিজে উঠবো আমরা ও আমাদের বাড়ি ঘর, জবুথবু হয়ে দেখবো ঘৃতকুমারী রঙের জেগে উঠা জোছনা- অব্যক্ত কথার কাকলী। নীল আবিরের ধরা লালন গীত করতে করতে কোথায় যাবে তার কিছুই জানবো না; হাত নেড়ে গ্রামবাসী খুশি ভাগ করে নিলে সাদা সাদা তুলোর টুকরোগুলো বর্ষিত হবে পরম আনন্দে। শরতকে সন্তান ভেবে আমাদের মায়েরা চুমু উড়িয়ে দেবে, শরৎ ্আমাদের মায়েদের জন্য কাজলহীন প্রহর পাঠাবে উপহার করে। আমরা সে প্রহর পকেটে পুরে স্বচ্ছ রোদের উদ্যান পেরিয়ে ঢুকে যাবো নৃত্যরতো এক কাশের বনে, পিছুটানহীন।

এখানে অম্লান কিছু নেই
হাসান নাজমুল

এসব উন্মাদ কোলাহল ছেড়ে
যেতে চাই অনন্ত অদেখায়;
এ শহরের অঢেল আলোয়-
আমি চির অসহিষ্ণু;
এখানে অ¤øান কিছু নেই,
মৃত্যু ছাড়া আর সব অপ্রিয় এখানে,
‘লাশ’ শব্দটিই এখানে নিঃসঙ্গ
নীরব-মধুর;
মৃত্যু- চিরশান্ত-চির একান্ত
যেখানে কেবল যেতে চায় বোধের বিকাশ,
এসব বৈভব ছেড়ে-
আমিও যেতে চাই মরণোত্তর জীবনে।