দ্বিতীয় পর্ব-২ পেট্রোদাসী

404

পানসি পুকুরঘাটে বসে আছে। রূপীর কথাগুলি তার হৃদয়ের ভেতর নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ওর বিদেশি গল্প শুনে পানসির মধ্যে ক্ষীণ আশার আলো জাগে। বিদেশ স্বর্গের মতো। মেয়েটা কেমন বিরামহীনভাবে কথা বলতে পারে। রূপীর মুখটা তার চোখের সামনে ভাসে। কী সুন্দর! স্বর্গভাবনায় বিভোর পানসি। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পায় সে। মা তো বাসায় নেই! চুলায় ভাত বসাতে হবে। নিজ কাজে মনোযোগ দেয় সে। ঘরের সামনে উঠানের এক কোণে চাটাই দিয়ে ছোট্ট একটু ছাউনি। ছাউনির নিচে দুটো চুলা। এই এলাকায় এটাকে বলে ছায়লাঘর। প্রত্যেক বাড়িতেই রান্নার জন্য এমন ছায়লাঘর আছে। পানসি মাটির হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে দেয় চুলার ওপর। শুকনো পাতা দিয়ে জ্বাল দিতে থাকে চুলায়। টগবগ করে ভাত ফুটতে থাকে। এক রাখাল উঠানে এসে দাঁড়ায়। রাখালকে দেখামাত্রই ওর ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে ওঠে। এ রাখালকে আগে কখনো দেখেনি ও। পুতি ও পাতা ছাগল নিয়ে মাঠে গেছে। বলতে গেলে এখন শূন্য বাড়ি। পানসি চোখ তুলে তাকাতে পারে না। ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপতে থাকে। এমন হচ্ছে কেন তার? লজ্জা, নাকি ভয়? নাকি অন্যকিছু। রাখাল এদিকে-সেদিক তাকিমুকি করে। পানসি ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। অগত্যা সমস্ত নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে রাখাল, ‘গুতুচাচা বাড়ি নাই?’
পানসির মুখটা গোধূলির মতো, গোলাপি চোখ দুটি বুজে আসতে থাকে। বুকের মধ্যে উথালপাথাল ঢেউ। মনের ভেতর একটু সাহস সঞ্চার করে লাজরাঙা গোলাপি মুখটি তুলে আলতো করে নমনীয় দৃষ্টিতে তাকায় রাখালের গোটা-গোটা চোখে। কালো[ঢ়১} গাঙের জলের মতো গহিন দুটো চোখ প্রতিফলিত হয় চার চোখের চোরাবালিতে। চার চোখের প্রতিফলনের আভা ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিগ। সেই শুভ্র রঙিন ঠোঁট দুটো নেড়ে পানসি বলে, ‘বাজান গাওয়ালে (ফেরি করতে) গেছে।’ পানসি চুলার দিকে চোখ দুটি ফেরায়। দৃষ্টি যদিও আগুনের শিখায়, তথাপি মনের ভেতর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ।
‘আমারে একটু আগুন দেওন যাইবো? বিড়ি ধরাইমু,’ রাখাল পানসির দিকে এগিয়ে আসে। পানসির গহিন সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে এরই মধ্যে। পাটখড়িতে আগুন ধরিয়ে রাখালে হাতে দেওয়ার সময় রাখালের হাতের এতটুকু ছোঁয়া লাগে অনিচ্ছাকৃত। পানসির ভেতর রাঙা ভ‚কম্পন ঘটে। এ কম্পনে তিলে তিলে গড়া সবুজ দ্বীপে নতুন জলের অনুপ্রবেশ ঘটে। ‘আর একটু কষ্ট দেই। একটু পানি দেওন যাইবো?’ রাখালের এ কথা পানসি যেন শুনতে পায়নি। রাখাল বেশ খানিক সময় অপেক্ষা করে। রাখাল পুনরায় পানি খেতে চাইলে পানসি কিছুটা হকচকিয়ে যায়। তার পাশেই মাটির কলসি থেকে পানি ঢেলে কাঁসার গøাসে খেতে দেয়। রাখাল ছায়লাঘরের দাওয়ায় মাটিতে ধপাস করে বসে ঢকঢক করে পানি খেয়ে গøাসটা মাটিতে রেখে দেয়। বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে জানতে চায়, ‘বাড়িতে আর কাউরে দেখতাছি না যে?’
পানসির হৃদয়ের সবুজ বনভ‚মিতে এখনো কীসের যেন অলৌকিক ডুগডুগি বেজে চলেছে। সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। লজ্জায়, ভয়ে ঠোঁট দুটো আড়ষ্ট হয়ে আসে। অনেক কষ্টে উত্তর দেয়, ‘সবাই কামে গেছে।’
‘আইচ্ছা যাই। তোমারে অনেক কষ্ট দিলাম।’ একা একাই নিজের নাম জানায় সে, ‘আমি গহর। বাড়ি কুষ্টা। তোমাগো বাড়ির সামনে পাটখেতে কাম করতাছি। ও, তোমার নামডা কি বলা যাইব?’
লজ্জায় আরো যেন গলে যায় পানসি। মাথায় ঘোমটা বড়ো করে টেনে উত্তর দেয়, ‘পানসি।’
‘নামডা তো খুব ভালা। মায়ের কাছে শুনছি, আগে ধনী লোকেরা নাকি পানসি নৌকা দিয়া যাতায়াত করত। পানসি নাও, দেখতে নাকি খুব সুন্দর!’ গহরের চোখে স্মৃতির পানসি ভেসে ওঠে। হরিপুরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা ঝিনাই নদী। একসময় এই নদীর ওপর দিয়ে বড়ো বড়ো নৌকা মাল বোঝাই করে বিভিন্ন গঞ্জে যাতায়াত করত। বড়ো নৌকাগুলির নাম ছিল মাল্লার নাও। হয়তো মাল সরবরাহের কারণে এ ধরনের নাম। ছোটো ছোটো ছইওয়ালা নৌকা করে গাঁয়ের বউ-ঝিরা নাইয়র যেত বাপের বাড়ি। গাঁয়ের ধনী ব্যক্তিরা পানসিতে চড়ে বিয়ে করতে যেত। পানসি নৌকাটার মাঝখানে চারকোণা ঘরের মতো। কাঠের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। দেওয়ালগুলো বিভিন্ন রঙের কারুকাজ করা। বলা যায়, ধনীদের ভ্রমণবিনোদনের বাহন। সেই থেকে পানসি খানদানি নাম। মনে মনে বলে, পানসি দুর্লভ! এই পানসি আমি পাইমু!
পানসির হৃদয়ের অলৌকিক ডুগডুগি এখনো বাজছে। এদিকে পানসি নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখে, গহরকে দেখামাত্র তার ভেতরে এমন ভ‚মিকম্প হলো কেন? এখনো তার কম্পন থামেনি। গহর চলে গেছে সেই কখন! রান্নাঘর থেকে বের হয়ে উঠানে পেয়ারাগাছের নিচে এসে দাঁড়ায় পানসি। এখান থেকেই দেখা যায় কুষ্টা গাঁও। হরিপুর ও কুষ্টার মাঝখানে বড়ো একটি মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে কুষ্টা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরজা খুললেই ওই গ্রাম চোখে পড়ে তার। এতদিন তো এ গ্রাম নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। এখন গ্রামটার প্রতি এত মায়া হচ্ছে কেন? মায়াবী চোখে ভাসছে দুই গ্রামের মাঝে শুধু সবুজ আর সবুজ।
গহর অন্যমনস্কভাবে পাটখেতে নিড়ানি দেয় আর বিড়ি টানে। চোখের মাঝে ঝিলিক দিয়ে ওঠে পানসির লাজরাঙা গোলাপের মতো মুখটি। পাটগাছের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। পাটের পাতাগুলিতে আদরমাখা মায়াবী সবুজ রং। রোদের ঝিলিকে পাটপতাগুলো লাজুক-লাজুক ভঙ্গিতে হেলছে দুলছে পানসির রাঙা মুখটির মতো। হঠাৎ রোদের ঝিলিক নিভে যায়। গহর চোখ রাখে আকাশের দিকে, পানসির লাজরাঙা মুখটি বারবার মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়। আবার হঠাৎ হঠাৎ মেঘের বুরুজ ভেঙে চাঁদ ওঠে। মাথাল মাথায় নিড়ানি হাতে মাঝে মাঝে স্তব্ধ হয়ে যায় গহর। নিজের সঙ্গে নিজের মৌন গল্পে গল্পে সময়টা কাটছে তার ভালোই। আবার চোখ নামায় সে সবুজ পাতায়। কখনো কখনো সবুজ পাতায় হাত রেখে সুখস্পর্শ নেয়। > ৪র্থ পৃষ্ঠায় দেখুন
> ৩য় পৃষ্ঠার পর
তন্ময় দুটো চোখ গহরের চোখে ডুবসাঁতার খেলে। যেন রাশি-রাশি কালো জল টলমল করছে মুগ্ধ চোখের নীরব চাহনিতে। হৃদয়ের ভেতর পতপত করছে ভালোবাসার নিশান। তাই তো বুকের তিমির ঠেলে জেগে ওঠে ভালোবাসার দ্বীপ। দুপুর গড়িয়েছে। বিকেলের লাবণ্যময় রোদের হাতছানিতে উঠে দাঁড়ায় গহর। মুগ্ধ চোখ রাখে আসমানে। একি! নীলিমার মতো শুভ্র স্নিগ্ধ মুখটি! নীল আসমানের ভাঁজে-ভাঁজে ভেসে বেড়াচ্ছে! মেঘের পাহাড়ে কালো চুল এলিয়ে নীল আঁচল বিছিয়ে বসে আছে স্বপ্নধোয়া সুখদ্বীপ।
এ সময় খেতের আল ধরে হেঁটে আসে মনু মিয়া। ‘গহর নাকি? এই চহে (মাঠে) মেলা দিন পর আসলি?’
‘হু, মনুভাই, চুক্তিতে কাম নিছি। কামলা খাটা মানুষ। যেইখানে কাম পাই সেইখানেই যাই। তয় মনুভাই, তোমারে এত খুশি খুশি লাগতাছে যে?’
‘হু রে গহর। একটা সুখের খবর আছে।’
‘কী খবর ভাই?’
‘পংকুরে চিনস না?’
‘চিনুম না ক্যা? এই গাঁয়ের প্রায় সবাইরেই চিনি। তা কী হইছে? পংকুচাচার?’
‘পংকুচাচার ম্যায়া তেলির বিয়া হইছে কুহপডরা। হেই তেলির নোনদ রূপী, বিদেশ থাকে।’
‘ভাই, এইটা কী কও? ম্যায়ামানুষ বিদেশে যায়?’
‘আরে গহর, হেই বিদেশি মেম পংকু চাচার বাড়ি আইছে। হেই বিদেশি মেমসাবের লগে দেখা কইরা আইলাম। কী যে ভালা লাগল বিদেশি মেমরে। মেসসাব আমারে খুব খাতির করল। মেমসাব আমার বাড়ি অহিবো।’ ঠেঁটের কোণে মৃদু হাসি টেনে মনু বলে, ‘যাইরে গহর।’
গহর ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের ভেতর কথাটা বাজতে থাকেÑ ম্যায়া মানুষ বিদেশে যায়!
পানসি বাহিরবাড়ি কদমতলে বসে আছে। তার উদাস দুটো চোখ সবুজ মাঠে ওঠানামা করছে। হঠাৎ চোখ দুটি উচ্ছল হয়ে ওঠে। গহর! নীল আসমানে কী দেখছে!
পানসির হৃদয়ে জ্যৈষ্ঠের নূপুর বেজে ওঠে। ভালোবাসার গাঙে খেলা[ঢ়২} করে অজ¯্র সোনালি মাছ। রাশি রাশি সবুজ নাচানাচি করে ধূলিমাখা বাউকুড়ানিতে। এ সময় পুতি কোথা থেকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে পানসিকে! ওর ঝাঁকুনিতে বন্ধ হয়ে যায় পানসির সুখমাখা ভালোবাসার পাÐুলিপি। ভেঙে যায় ধ্যান। পানসির চোখ দুটো পতিত হয় সবুজ পাটের খেতে। অস্পষ্ট ছবির মতো লাগছে। মুখটা পুরোপুরি বোঝা না গেলেও গহরকে দেখা যাচ্ছে। গুটিগুটি পা ফেলে ফিরছে আপন আলয়ে।
‘বড়ো বু, বড়ো বু, আমার ছাগলটা দেখছো?’ পানসির দৃষ্টি গহরের গমনপথের দিকে। পুতির কথায় কর্ণপাত না করে সে তাকিয়ে থাকে। কুষ্টা গাঁয়ে ঢোকার আগ পর্যন্ত চোখের পলক ফেলে না। গহরের কোনো চিহ্ন আর পানসির দৃষ্টিতে পড়ে না এখন।
‘পুতি, কী হইছে?’
‘বড়ো বু, তোমার কী হইছে? নিরিখ বাইন্ধা কী দেখতেছিলা?’
পুতির নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে পানসি বলে, ‘বেশি পাকনা হইছো! তোমার এতকিছু বোঝার দরকার নাই। ছাগলের কথা কী কইছিলি?’
‘বড়ো বু, ছাগলডা পাই নাই। বাড়িতে আইছে?’
‘না তো, বাড়ি আসে নাই। ভালা কইরা খুঁইজা দেখ।’
‘সব জায়গায় খুঁজছি। পাই নাই।’
‘পাতা কোথায় রে, পুতি?’
‘পাতারে খোঁয়াড়ে পাঠাইছি দেখতে, ছাগলডারে কেউ ধইরা খোঁয়াড়ে দিছে নাকি। কয়েকটা গ্রাম মিলে ‘খোঁয়াড়’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। গায়ের গোরু-ছাগল কারো জমিতে ফসলের ক্ষতি করলে, সেই পশুটিকে খোঁয়াড়ে আটক রাখা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে পশুর মালিক তার পশুকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।
‘পুতি, তুই বস। কান্দিস না। পাতা খোঁয়াড় দেইখা তো ফিরা আইবো। তারপর দেখি, কী করন যায়?’
এরই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে পাতা হাজির হয়। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, ‘বড়ো বু, ছাগল পাই নাই।
‘পাতা দেখ তো। এইদিকে কে যান আইতাছে। জাগিরা। পাতা, আগাইয়া যা। জাগিরাকে জিজ্ঞাসা কর, ছাগলডা দেখছে নাকি?’
পাতা দৌড়ায় আর ডাকে, ‘জাগিরাভাই, ও জাগিরাভাই, আমাগো ছাগলডা দেখছ?’
জাগিরা জবাব দেয়, ‘ছাগলডা কি সাদা?’
‘হ ভাই।’
‘সাদা একটা ছাগল কুষ্টার আটায় (ময়দানে) দেইখা আইলাম। তাইলে, তাড়াতাড়ি যা পাতা।’
পাতা ওখানে থেকেই চিৎকার করে ডাকতে থাকে, ‘মেজো বু, মেজো বু, তাড়াতাড়ি আয়।’
দুই বোন দৌড়াতে থাকে কুষ্টার আটার দিকে। কুষ্টা গ্রামের একটা বড়ো জায়গা জুড়ে অনেক গাছপালা ও বাঁশঝাড় ঘেরা জঙ্গলের মতো। জঙ্গলের সামনের ফাঁকা জায়গাটাকে বলে কুষ্টার আটা।
দুধজান বলে, ‘বড়ো গেদি, অল্প চারডা চাইল আছে। ভাত বসাই দে। তোর বাজান সারা দিন গাওয়াল কইরা বাড়ি আইবো।’
গুতু ফকির গ্রামে গ্রামে ফেরি করে, আলতা, চুরি, ফিতা, সোনালি-রুপালি রং বিক্রি করে টাকা ও ধানের বিনিময়ে। প্রতিদিন বোঁচকা একটা কাঁধে নিয়ে ভোরে বের হয়। সারা দিন শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। কোনো কোনো দিন রোজগার ভালো হয়। তাতে কয়েক দিনের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দিন আয় খুব সামান্য হয়। সমস্ত দিন শেষে গুতু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ঘরে ফিরবে। অথচ ঘরে খাবারের ব্যবস্থা নেই। ঘরে যে চালটুকু আছে তাতে পেটের কোনাও ভরবে না। এটা নতুন নয়। এরকম সমস্যা তাদের প্রায়ই ঘটে। তাই কষ্টটা দুধজানের গা-সয়া হয়ে গেছে। দুধজান পানসিকে হাঁড়ি চড়াতে বলে ছিাগলের খোঁজে বের হয়।
পানসি ছায়লাঘরে চুলার ওপর ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দেয়। চরদিকে সন্ধ্যার পিনপতন নীরবতা। আজানের সুর বেজে ওঠে। গুতু ফকির উঠানে এসে দাঁড়ায়। দুধজান এগিয়ে ধানের বস্তাটা ঘরে নিয়ে আসে। ‘বড়ো গেদির মাও, এক গিলাস পানি দেও।’ দুধজান ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে পানি এনে দেয়। গুতু ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয়। ‘বড়ো গেদি, পাতা-পুতিরে দেখতাছি না যে?’ বলতে বলতেই দুই বোন হাজির হয়।
পাতা বলে, ‘একজুনের ছাগলের সাথে চইলা গেছাল কুষ্টা।’
পুতি খুঁটির সঙ্গে ছাগলের দড়ি বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘ওরে বাবা! কুষ্টার আটায় এই ভরা সন্ধ্যায় মানুষ যায়? আমার যে কী ডর করছে!’
অজানা আশঙ্কায় গুতু ফকিরের মন দুলে ওঠে। দুধজানকে ডেকে বলে, ‘বড়ো গেদির মাও, ওগো দুইজনরে ঘরের বাইরে বাড়তি চালার নিচে খাড়া করাও। তার বাদে চালের উপুরে পানি ঢাইলা নাহাইয়া (গোসল) দেও। কুষ্টার আটায় বাঁশঝাড়ে বরমাদুষ্ট থাকে। এই ভরা সন্ধ্যায় ওরা বাহির হয়। এই সুময় যারে পাইবো তার উপুরেই ভর করবো।’
কুষ্টার আটা জায়গাটা হরিপুর ও কুষ্টা দুই গ্রামের মানুষের কাছেই ভয়ংকর স্থান। সবার বিশ্বাসÑ ওখানে বরমাদুষ্ট নামে ভ‚তের সর্দার বাস করে। তাই কার্তিক মাসের শেষ দিন হিন্দু স¤প্রদায় ভ‚তসর্দার বরমাদুষ্টকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য পূজা দেয়। আর মুসলমানরা ওইদিন সন্ধ্যায় একমুঠি পাটশোলার আটি বেঁধে মশাল জ্বালায়। দুই গ্রামের ছেলে-বুড়োরা দল বেঁধে মশাল হাতে কুষ্টার আটায় দৌড়াদৌড়ি করে আর ছড়া কাটেÑ
ভাড়া গেল
ভুড়া গেল
বোচার কান
মশায় খাইল।
সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মশালের আগুন নিভিয়ে দেয়। আগুনে পোড়ার পর যতটুকু পাটখড়ি থাকে তা ওখানে পুঁতে দেয় আর ছড়া কাটেÑ
ভাড়া দিলাম ভুড়া দিলাম
মশার গাও পুইড়া দিলাম
বরমাদুষ্ট, তোর জায়গা রাইখা দিলাম।
তিন বার ছড়ামন্ত্র পড়ে তিনটা পাটখড়ি পুঁতে দেয়। গ্রামবাসীর ধারণা, এতে বরমাদুষ্ট কারো ক্ষতি করবে না। তার পরও জায়গাটা সবার কাছে ভয়ের। ওখানে গেলে গা ছম ছম করে। কিন্তু ব্যতিক্রম পাতা। তিন বোনের মধ্যে ছোটো। স্বভাবটা ডানপিটে। ডাক দোহাই, নিয়মকানুন খুব একটা মানতে চায় না। কাজেই ওর কাছে এসব কিছু নয়। দুধজানকে বলে, ‘তোমরা ডরের কুবুতররে নাহাও, আমার কিছুই অইবো না।’

দুধজান পুতিকে গোসল করায় আর বলে, ‘ছোটো গেদি, তুই কী বুঝবি? তুই তো ডরপড়ার পাতা খাইছস। কথা বাদ দিয়া চালার নিচে খাড়া।’
‘মাইয়া (মা), আমার লাগব না। পুতিরে নাহাও।’
দুধজান একা-একাই গজগজ করে। ‘মুখপোড়া, বেহারা, তোর সাথে আমি কোনো দিনই পারলাম না। সগল কামেই গতরের জোর খাটাস। ম্যায়াগো এত বেহারাপনা ভালা না। তোরা পরের ঘরে যাইয়া কী করবি? এত বেলেহাজ হইলে পরের ঘর করতে পারবি? মুরুব্বিগো কথা না মানলে এক দরজা দিয়া নিব, আরেক দরজা দিয়া বাইর কইরা দিব।’
এসব কথায় পাতার কিছু যায়-আসে না। সে হাতমুখ ধুয়ে পানসির পাশে বসে গল্প জুড়ে দেয়।
রান্না শেষ হলে দুধজান ভাতের হাঁড়ি ঘরে এনে গুতু ফকিরকে ভাত বেড়ে দেয়। গুতু ফকির পিঁড়িতে বসে বলে, ‘বড়ো গেদি, মাইঝা গেদি, ছোটো গেদি, তোরাও বস।’
‘তুমি আগে খাও। ওরা পরে খাইবো,’ বলে দুধজান। গুতু ফকির কচুশাক দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে ফেলে। দুধজান আবার ভাত দেওয়ার উদ্যোগ নিলে, গুতুর চোখ পড়ে ভাতের হাঁড়িতে। হাঁড়িতে ভাতের পরিমাণ খুবই কম। গুতু আবার ভাত নিলে বাকিদের একমুঠ করেও হবে না। এতক্ষণে বুঝতে পারে, মেয়েদের খেতে না বসার কারণ। বুকের ভেতরটা তার ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে। দুধজানের চোখ দুটো ছলছল করে নোনাজলে। বাবা-মায়ের মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে তিনটি মলিন মুখ। সমস্ত ঘরে পিনপতন নীরবতা। ঠান্ডা ঝড় বয়ে যাচ্ছে পাঁচটি হৃদয়ের গহিন গাঙে। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুুক্ষণ।
গুতু নোনাজলে ভেজা চোখ দুটো মুছতে মুছতে পাতাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি এমুনি নিঃস্ব বাপ হইছি! তোরা এক লুকমা কইরা খাইয়া পানি খা।’
পাতার চোখে আষাঢ়ের ঢল। পানসির চোখেও ছিটেফোঁটা বৃষ্টি। পানসি পাতার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমার আইজ ক্ষুধা নাই। তুই আর পুতি খা।’ বাড়ির সবারই জানা, পেট ভরে খেতে না পারলে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় পাতা। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্যরকম।
পাতা পানসির হাত ধরে বলে, ‘বড়ো বু, তুমি সবটুকু ভাত শাক দিয়া মাখাও। আমরা সবাই মিলা খাইমু।’ পানসি ভাত মাখিয়ে, প্রথম লোকমা পাতার মুখের দিকে তুলে দিলে বলে, ‘মাইয়ারে আগে দেও।’
‘না, তোরা খা মা,’ বলে দুধজান।
‘মাইয়া, তুই আগে এক লোকমা খা। তুই না খাইলে আমরা কেউ খাইমু না। তুই আমাগো জুন্যে কত কষ্ট করস? মাইয়া, আমি আর দুষ্টোমি করমু না। তুমি যা কইবা, আমি তাই শুনমু।’ বলে পাতা। মেয়ের ব্যথাভরা কথায় বানের মতো পানি উপচে পড়ে দুধজানের চোখে বেয়ে। অথালি-ঝড়ের তাÐব শুরু হয়েছে হৃদয়ের গহিনে। পাতাকে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরলে শান্তির নহর নেমে আসে তার হৃদয়ের রুক্ষ ভ‚মিতে।
গভীর হয়ে আসে নিস্তব্ধ কালো রাত। ক্ষুধার জ্বালার দাপাদাপিও স্তিমিত হয়ে আসে; অনাহারী শুকনো মলিন চোখগুলিতে নেমে আসে নিদ্রা।
সবারই চোখে ব্যথাভরা বিষাদের ঘুম। শুধু ঘুম নেই পানসির রুক্ষ দুটো ভেজা চোখে। দাপড়াতে দাপড়াতে একসময় স্তিমিত হয়ে যায় ক্ষুধা নামক জন্তুটা। চোখের সামনে মেলে দেয় ধ্যানের জানালা। কষ্টের তামাটে মাটির গন্ধ বুকে নিয়ে ধ্বংসের কবর ডিঙিয়ে মুখ রাখে সে জানালায়। পানসির চোখে-মুখে ঝলমল করে ওঠে রংধনুর সাত রং। অনাহারী হৃদয়ে পাঁজরে যেন সে পুষে রেখেছে পুষ্পের ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে জেগে ওঠে স্বপ্নের নতুন বসতভ‚মি গহরকে ঘিরে।
বিজন রাতের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপন শেষে ভোরের স্নিগ্ধ আভায় চোখ মেলে নির্ঘুম পানসি। সজীব ভোরের সঙ্গে মিতালিতে মেতে ওঠে সে। কুয়াশাকাতর উষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আসমানের নীলিমায়। আজ তার কাছে ভোরের আসমান বর্ণময় রঙিন-বিষাদ চেতনার নীলে ছাওয়া। আলো-আঁধার লুকোচুরি খেলতে-খেলতে বাহিরবাড়ি এসে বসে পড়ে, কদমতলে সবুজ গালিচায়। উদাস চোখে সে তাকায় সবুজ বনভ‚মিতে। কানের ভেতর বেজে ওঠে নির্ঘুম বাঁশির সুর। আকাশের আঙিনায় উড়ছে অসহায় গাঙচিলটি। সবুজ বনভ‚মি থেকে নীল আসমানে উঁকি মারে পানসির দুটি চোখ। খাড়া হয়ে ওঠে কান দুটি। আরো গভীর হয়ে কানে বাজতে থাকে বাঁশির সুর। নিরাপদ আশ্রয়ের তৃষ্ণায় চোখ মেলে, তন্ন-তন্ন করে খুঁজে ফেরে গাংচিলটি। আসমানে ঠোঁট রেখে বলে, খড়কুটো বিছানো একটুখানি ঘর দাও, আমার নির্ঘুম রাতের অবসান করো। রোদে পোড়া মনটা জুড়িয়ে দাও, নির্জন ঘরের সুশীতল ছায়াতলে। আরো মায়াবী ও গভীর হয়ে ভেসে আসে বাঁশির সুর। পানসির দৃষ্টি আসমান থেকে প্রতিফলিত হয়, দক্ষিণের খোলা মাঠে। একি! বাঁশিওয়ালা আর কেউ নয়, তার স্বপ্নের মানুষ, গহর।
গহরের নির্ঘুম রাতের না-বলা কথাগুলো সুর হয়ে আছড়ে পড়ে পানসির হৃদয়গাঙে। দুটি হৃদয় যেন জড়াজড়ি করে বলছে, দিঘল রাতের না-বলা সমস্ত কথা, উষ্ণ সুন্দর সকালে। গুতু ফকির ফজরের নামাজ পড়ে এসে পানসির পাশে বসে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘মা রে, তোর মুখটা কেমুন শুকনা হইয়া গেছে। শরীরডা কাহিল। কাইল তো কিছু খাওয়া হয় নাই।’
পানসি বাপের মাথায় রেখে বলে, ‘বাজান, আমি ভালা আছি। জোয়ান মানুষ। এক দিন না খাইলে কী হয়? তুমি চিন্তা কইরো না।’
এ সময় জাগিরা উঠানে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘গুতুচাচা, ও গুতুচাচা, বাড়ি আছো?’
গুতু ওখান থেকেই জবাব দেয়, ‘কারা? এই দিকে আয়।’
‘চাচা, আমি।’ এক হাতে কলাপাতায় লবণ আর ফালি-ফালি করে কাটা আদা, আরেক হাতে এক কোষ্ঠা পাট।
‘চাচা, কাইল রাইতে সাপের বাতাস লাগছে। মাথা ঠিক রাখতে পারি না। ঘুইরা পইড়া যাই। বমিও হইছে কয়েকবার।’
গুতু পাটের কোষ্ঠায় ফুঁক দিয়ে গলায় পড়িয়ে দেয়। আদা ও লবণে ফুঁক দেয়। জাগিরার মাথাটা ধরে ঝাড়ফুঁক দিয়ে বলে, ‘লবণ-আদা যতটুকু পারো খাও। আর বাকিটুকু পরে খাইবা। যাও, ঠিক হইয়া যাইবো।’
দুধজান উদাস হয়ে বসে থাকে ছায়লাঘরে। হাতে শূন্য ভাতের হাঁড়ি। বেদনায় নড়ে ওঠে জাগিরার ভেতরটা। গুতুর সংসারে ঠিকমতো খাবার জোটে না, তা জাগিরার অজানা নয়। জাগিরার আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে-শাদিও করেনি। খুব সাদাসিদে সে। সবাই নানাভাবে তার সঙ্গে দুষ্টুমি করে। তার উপাধি পাগলা জাগির।
এতে সে খ্যাপে না কখনো। দুধজানের করুণ মুখটা শেলের মতো আঘাত হানে তার হৃদয়ে। জাগিরা চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। হাতে গামছার পুঁটুলি। ‘চাচি, ধরো, চাইল। ভাত পাক কইরা খাও। তোমার মুখ দেইখা বুঝছি। কাইল রাইতে খাওন হয় নাই।’
দুধজান জাগিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাজান, তোরে মানুষ পাগল কয়। তোর ভিতরে যে এত দরদ, এইডা কেউ জানে না।’ বন্যায় ভেসে যায় দুধজানের শুকনো চোখ দুটো।
‘চাচি, তুমি তো আমার মায়ের মুতন। আমার মা নাই। তুমিই আমার মা। তোমার কোনো সমস্যা হইলে নিজের পোলা মুনে কইরা কইবা।’
পাতা ঘর থেকে বের হয়ে বলে, ‘জাগিরাভাই, খোদা তোমায় ভালা করব। কাইল সারা দিন পরে রাইতে এক লুকমা ভাত খাইছি। অখন নড়াচড়া করতে পারি না।’ মাকে বলে, ‘মাথা ঘুরতাছে মাইয়া, তাড়াতাড়ি ভাত পাক করো।’
‘চাচি যাই। মনু মিয়ার বাড়ি যাইমু।’ বলে জাগিরা চলে যায়।

মনু মিয়ার ছোট্ট ছনের ঘর। একচিলতে ভিটে। এই ভিটেটুক ছাড়া আর কিছুই নেই তার। পরের জমিতে শ্রম বিক্রি করে। তবে সে জন্মের অলস। এক দিন কাজ করবে তো অন্যদিন করবে না। স্বভাবটা উড়–উড়–। খেয়ে-না-খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় আর তাস খেলে দিন পার করে। তাই সংসারে অভাব-অনটন লেগেই আছে তার। একদিকে অভাব, অন্যদিকে সন্তান না হওয়ার কষ্ট। এর জন্য ঘরে এসে বউকে বকাঝকা করে। এমনকি মারধরও করে। এভাবেই কাটছে মনু মিয়া ও জয়তুনের সংসার। মনু মিয়া বলে, ‘জয়তুন, বিদেশি কুটুম রূপী আইবো। তোর আন্ডা পাড়া কালা কুরকাডা (মুরগি) জবাই কইরা পাক (রান্না) কর।’ জয়তুনের মুখটা কালো হয়ে যায়। তবু সে মুরগিটা ধরে। বলে, ‘জবাই কইরা দেন। কতগুনা আন্ডা বেইচা সদাই কিনা খাইছি। কুরকাডা ল²ী আছাল।’
মনু মিয়া ভেংচি দিয়ে বলে, ‘রাখ তোর ল²ী। তোর ঘরে তুই নিজেই তো পোড়াকপাইলা অল²ী। কুরকা ল²ী হইলে তোর লাভ কী? ল²ী কুরকা কি তোরে সন্তান দিব? নিজের মুরাদ হইল না একটা বাচ্চা দেওয়ার। আঁটকুড়া ম্যায়ালোকের মুখে আবার কথা।’
জাগিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনু মিয়ার কথা শোনে। জয়তুনের জন্য ভেতরটা কেঁপে ওঠে তার। মন খারাপ করে ফিরে আসে সে। মনু মিয়ার ঘরে প্রবেশ করতে তার রুচিতে বাধে। মানুষ এত জঘন্য হয় কী করে! জয়তুন মুরগি কাটছে। দুচোখে তার শ্রাবণের ধারা। মাঝেমধ্যে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে, নাক মোছে আর মুরগি কাটে।
মনু মিয়া জয়তুনের গালে থুকনা মেরে বলে, ‘এই আটকুঁড়া অল²ী, কান্দন মারাও ক্যা? কাম কর। চোখের আলুনি (আহ্লাদি) পানি দেখার সুময় নাই আমার। পাক যান ভালা হয়। না হইলে খবর আছে।’
মনু মিয়া উঠানে পায়চারি করতে থাকে। জয়তুন ছায়লাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। মনের ভেতর তার ভয়। পাক ভালো না হলে তুলকালাম কাÐ ঘটাবে। হঠাৎ মনু মিয়ার হৃদয়ের ঘুঘুটা খুশিতে নেচে ওঠে। মনু ও জয়তুনের মধ্যে এতক্ষণ যেন কিছুই হয়নি, মনু এমনভাবে দরদ মাখানো গলায় বলে, ‘জয়তুন দেখো, কারা আইতাছে!’
জয়তুন ছায়লাঘর থেকে বের হয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। ‘আল্লা, ওডা কী? অমুন ক্যান? গায়ে পোলাগো গেঞ্জি আর পিন্দিছেও পোলাগো ফুলপ্যান্ট।’
‘আরে, তুই কী বুঝবি? হে তো বিদেশি মেম। বিদেশে ম্যায়ারা অমন পোশাক পিন্দে।’ দুজনের আলাপচারিতার মধ্যে রূপী এসে হাজির হয়।
‘কি মনুভাইয়া, খুব রোমান্টিক গল্প হচ্ছে বুঝি?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই, প্রশ্ন করে, ‘এটা ভাবি?’
‘হ, আমার বউ, জয়তুন।’
‘বাহ্, নামটা বেশ সুন্দর। ভাবি দেখতেও কিন্তু চমৎকার।’
জয়তুন লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে দেয়। মনু বলে, ‘বসেন, মেম সাহেব।’
রূপী টুলের ওপর বসে। জয়তুন খাবার তৈরি করতে করতে রূপীর বেশভ‚ষা দেখে আর ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়।
রূপী বলে, ‘মনুভাইয়া, আমাকে তুমি সন্বোধন করবেন। আপনে বললে, পরপর লাগে।’
মনুর পালটা প্রশ্ন, ‘আমার বেলায়ও তাই।’
মুচকি হেসে রূপী বলে, ‘ঠিক আছে। তা-ই হবে।’
‘রূপী, আমার বিদেশ যাওয়ার খুব শখ। তুমি যেভাবেই পারো আমার জুন্যে চেষ্টা করো।’
‘মনুভাইয়া, শোনো। এখন পুরুষদের বিদেশ যেতে লাগে ২ লক্ষ টাকা। আর বেতন ৮-১০ হাজার টাকা। তার মধ্যে নিজের থাকা-খাওয়া। শেষে দেখা যাবে মাস শেষে ৫-৬ হাজার টাকা থাকবে। তবে ভালো কাজ শিখে যেতে পারলে ভালো বেতনে চাকরি পাবে। তুমি ড্রাইভিং শেখো। আমি তোমার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা করব।’
একটু থেমে রূপী আবার বলে, ‘মনুভাইয়া, তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকে মনে হয় কত আপন। কত যুগের পরিচিত আমরা। তোমার চেহারাটাও আকর্ষণীয়!’ মনুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘তোমার হাত দুটো কত সুন্দর!’ মনু মিয়ার চোখ-মুখ ঝিলমিলিয়ে ওঠে রংধনুর সাত রঙে। মনুর কাছে এটা বিশাল স্বপ্ন। রূপীর মতো মেয়ে তাকে এত…!
জয়তুন খাবার নিয়ে আসে।
‘ভাবি, এত লাজুক কেন? বসুন। একসাথে খাব।’
জয়তুন জড়সড়ো হয়ে বলে, ‘আপনে খান। আমি পরে খাইমু।’
‘ভাবি, আপনাকে বসতেই হবে। খাব আর বিদেশের গল্প করব।’
মনু মিয়াও ভদ্রলোকের মতো সুন্দর করে বলে, ‘জয়তুন বসো। বিদেশি কুটুম তোমারে পছন্দ করছে। এইটা তোমার জুন্যে সৌভাগ্য।’
রূপী শুরু করে বিদেশের গল্প। ‘ভাবি, আমাদের দেশ বড়ো বড়ো গাছপালা ঘেরা সবুজ। কিন্তু আরবে তেমন বড়ো গাছ নেই। কোনো-কোনো জায়গায় ছোটো-ছোটো কাঁটাবন। বালি আর পাথর দিয়ে ঘেরা রুক্ষ ভ‚মি। আকাশ ধূসর বর্ণের। ধূসর আকাশের তলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষহীন উলঙ্গ ভ‚মি। অথচ ওই রুক্ষ মরু দেশ, স্বর্গের দেশ। কী আরামে সেখানে থাকা যায়। গরমের দিনে সব সময় ঠান্ডা থাকে এসির কারণে। আর শীতের দিনে গরম থাকে, রুমহিটারের কারণে। ভাবি, আপনি কষ্ট করে পাটায় মসলা পিষলেন, চুলায় খড়ি দিয়ে ভাত রান্না করলেন, চোখমুখে ধোঁয়া লাগিয়ে এই পাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছেন। এগুলি সব কাজ সেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়।’
গল্প শুনতে শুনতে জয়তুনের জড়তা কমে আসে। প্রশ্ন করে, ‘বুজি, তাইলে তো বিদেশ আরামের জীবন।’
‘ভাবি, ঠিক বলেছেন। বিদেশ তো স্বর্গরাজ্য। তিন মাসের ছুটিতে এসেছি। এক মাস হয়ে গেল। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। কী গরম!’
‘বুজি, একটা কথা জিগাই?’
‘বলেন, ভাবি।’
‘আপনের বিয়া হয় নাই?’
‘না ভাবি। দেশে আসার পর বিয়ের জন্যে সবাই পাগল হয়ে গেছে। অনেকগুলি বিয়ের প্রস্তাবও এসেছে। কিন্তু আমার পছন্দ হয়নি।’ মনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলে, ‘একজনকে মনের ভিতর পুরেছি। দেখা যাক কী হয়।’
‘বুজি, আপনে তো বিদেশি মেম হইছেন। তাই তো দেশের পোলা পছন্দ হওয়ার কথা না। তয় বিদেশের পোলা একটা ধইরা নিয়া আসলেই হইতো।’
রূপী খিলখিল করে হেসে ওঠে। ‘ভাবি, আপনি তো বেশ মজার। ভাবি, চলেন, আপনাকে বিদেশ নিয়ে যাই।’
‘বুজি, কী যে কেন! আমার মুতন পোড়াকপাইলা অল²ীরে বিদেশে নিবো, কারা?’
‘আমি নিয়ে যাব। কে বলেছে আপনি পোড়াকপাইলা, আপনি তো রাজকপালী।’
‘বুজি, আমি বিদেশে কী করমু? আমি তো লেখাপড়া জানি না।’
‘কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বাসাবাড়িতে চাকরি করবেন। আমি শিখিয়ে দেব তাহলেই পারবেন।’
‘বুজি, আপনের মাথা কি ঠিক আছে? সংসারের কামকাজ করলেই আমারে টাহা দিব?’
‘ভাবি, বিদেশ হলো স্বপ্নরাজ্য। ওই দেশে গেলে সব স্বপ্ন পূরণ হবে। বিদেশে সংসারের কাজের অনেক দাম। আমাদের দেশে সংসারের কাজ কোনো কাজই না।’
মনুকে লক্ষ্য করে রূপী বলে, ‘মনুভাইয়া, তোমার বউকে বিদেশ পাঠাবে? ভাবি বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবে। সেই টাকা দিয়ে ড্রাইভিং শিখে তুমিও চলে আসবে।’ রূপী কথাগুলি বলে আর মিটিমিটি রহস্যময় হাসি দিয়ে মনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রূপীর চোখের রহস্যময় তির্যক রশ্মিতে মনুর হৃদয়ে সুনামি বয়ে যায়। সুনামির আঘাতে মনুর শিরা-উপশিরা পর্যন্ত নড়ে ওঠে। তার পরান জুড়ে বিচরণ করে রূপীর ঘ্রাণ। সেটা লক্ষ করে রূপীর কঠিন বাঁকা ঠোঁটে বিজয়ের হাসি ফুটে ওঠে। একটু আহ্লাদের সুরে জয়তুনের চিবুক ধরে সে বলে, ‘ভাবি, সোনা ভাবি, আসি। কথা দিলাম তোমাকে বিদেশ নিয়ে যাবই যাব। ভাইয়া, যাই।’ মনু ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভেতরে এখন বইছে উথাল-পাথাল ঢেউ।

জয়তুনের মনের যত কথা পানসি ও দুধজানের কাছে প্রকাশ করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। না বলতে পারলে পেটের ভাত হজম হয় না তার। তাই তো রূপীর কথা বলার জন্য সে পাগল হয়ে ওঠে। বিদেশি মেম বলে কথা। সেই মেম স্বয়ং তার বাড়ি এসেছে। এটা আশ্চর্য ঘটনা। এটা বলার জন্য মন তার আনচান করছে। তাই ফাঁক খুঁজে দুধজানের কাছে যাওয়া।
দুধজান রান্না করছিল। মুখটা উচ্ছিষ্ট হাঁড়ির মতো রুক্ষ বিষণœ। তার ভেতরে ভাবনা, জাগিরা তাকে ঋণী করে গেল। এ ঋণ শোধ দেবে কীভাবে? সামনের দিনগুলোই-বা চলবে কেমন করে? অনাহারী বিধ্বস্ত করুণ তিনটি মুখ মায়াবী চোখে চেয়ে আছে দুধজানের দিকে। মনে হচ্ছে তার কাঁধে বোঝা হয়ে আছে তিনজন। এ বোঝা কাঁধে নিয়ে যেতে হবে কত হাজার মাইল! তা সে জানে না।
গুতু ফকির হাঁড়িতে ভাত দেখে অবাক হয়। ‘কি গো বড়ো গেদির মাও, ঘটনা কী? চাইল পাইলা কই?’
দুধজান চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দেয়, ‘আমার পেটে খোদা পোলা দেয় নাই। কিন্তু খোদা তার আরশ থিকা একটা পোলা পাঠাইছে। হেই পোলা অনাহারী মায়ের মুখে খাবার দিয়া গেছে। খাও আর আমার পোলার জুন্যে দোয়া করো।’
পাতা পট করে বলে ওঠে, ‘বাজান, জাগিরাভাই চাইল দিয়া গেছে।’
গুতু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে খেতে বসে, খাওয়া শেষ করে বলে, ‘বড়ো গেদির মাও, পান দেও।’ দুধজান পান বানিয়ে গুতুর হাতে দেয়। গুতু পান খেতে-খেতে বলে, একটা কথা শুনো।’
‘বলো।’
‘বইলামপুরের কাশির নাম শুনছ?’
‘শুনমু না কেন? কাশি যে চোর, তা তো সবাই জানে। হে নাকি বিড়াল হইয়া ঘরে ঢুইকা চুরি করতো। আমাগো ঘরের পাছ দিয়াই তো কালিহাতী যাতায়াত করছে, কালা কুচকুচে শুকনা ছোটোখাটো মানুষটা।’
‘দুই বছর হইল কাশি চোর মরছে। তার একটা পোলা আছে। নাম জইনদালি। সবাই ডাকে জইন। ঝারমুনির গয়না বানাইয়া বেচে। দস্তা দিয়ে বিভিন্ন রকমের গয়না তৈরি করা হয়, গ্রামের মানুষ বলে ঝারমুনির গয়না। আমিও জইনের কাছ থিকা ঝারমুনির গয়না আইনা গাওয়াল করি। ধলাবুড়ি প্রস্তাবডা দিচ্ছে। বড়ো গেদির সাথে মানাইবো ভালা। বড়ো গেদির মাও, কথাডা ভাইবা দেখো।’
‘ভাবার কী আছে, একে তো চোরের পোলা। আবার জাতে মিশিগারি!’
বইলামপুর গ্রামে মিশিগারি নামে এক শ্রেণির ছোটো জাতের বাস। এদের পেশা ঝারমুনির গয়না তৈরি করা এবং গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ধান-চালের বিনিময়ে বিক্রি করা। এরা খুব দরিদ্র। কারো ঘরে দিনান্তে খাবার জোটে। কারো জোটে না। গ্রামের অন্য জাতের লোকেরা এদের ঘৃণার চোখে দেখে। তাই তো দুধজানও বিষয়টা মেনে নিতে চাইছে না।
‘বড়ো গেদির মাও, তোমার কথা ঠিক। তয় জইন খুব ভালা। কোনো এলেমেলে নাই। কাম করে ভাত খায়। আর জাতের কথা কস, আমাগো মতো গরিব মানুষের আবার জাত কী? এখানে ম্যায়াডা পেট ভইরা ভাত পাইবো।’
‘বড়ো গেদির বাপ, ঠিকই কইছেন, গরিবের আবার জাত! আপনে তো তালুকদার বংশের পোলা। সেই তালুকদারের পোলার দিন কাটে আনাহারে! আপনি দেখেন। তারপর বুইঝা-শুইনা ঠিক করেন, কী করবেন। ম্যায়াগুনা না খাইয়া আর কত থাকব? আর কিছু দেখার নাই। পেট ভইরা ভাত খাইতে পারলেই যথেষ্ট। চোখের সামনে আর সহ্য হয় না। পরেরগুনাও চোখের সামনে ডাঙর হইয়া উঠতাছে। বড়্ডা বিদায় করতে পারলে মাথাডা একটু পাতলা আইবো।’
‘আমাগো ঘরের পাছে হালট দিয়া যাওনের সময় বড়ো গেদিরে দেখছে। জইনের পছন্দও হইছে।’ উচ্ছ¡াসের সঙ্গে বলে গুতু।
‘খোঁজখবর নেন। পাওনাদাওনা কী? আমাগো তো কিছু দেওয়ার খ্যামতা নাই।’
‘বড়ো গেদির মাও, আরেক খিলি পান দেও।’ গুতু পান মুখে দিতে দিতে বলে, ‘ধলাবুড়ির কাছে যাই। কথা কইয়া দেখি।’

পানসির পেটের ক্ষুধার রাক্ষসটা এখন নীরব। মুখটাও সবুজে মাখামাখি। আয়নায় নেড়েচেড়ে দেখে। মুখটা যেন রোদে পোড়া বাঁশিওয়ালার জন্য আকুল। সবুজ মুখটির স্বপ্নিল আভা, এক টুকরো ছায়াসুশীতল আদরের অপেক্ষায় উন্মুখ। সেই ভরা কণ্ঠের মানুষটি যেন বলছে, দরজা-জানালা খোলা। তুমি নির্জন ছায়াতলে আসো। শীতল পবনের তলে চুল ছড়িয়ে বসো। সেই মেঘের কালো পাড়ের ভেতর আঙুল চালিয়ে আদর মাখাব। গল্পে-গল্পে দিন পার করব।
পানসি যার ধ্যানে আয়নার মগ্ন, সেই স্বপ্ন চোখের সামনে। অন্তরে শুরু হয় কালবৈশাখীর দাপাদাপি। হৃদয়ের ঘোর অবসাদে শরীরটা যেন নুয়ে আসছে তার। অন্তরের অবরুদ্ধ দ্বার দাপাদাপি করছে মুক্ত হওয়ার জন্য। মুক্ত দ্বার বেয়ে আশ্রয় নেবে সুশীতল ছাড়ানীড়ে।
গহরের হাতে আমের আঁটির বাঁশি। গায়ে সাদা গেঞ্জি, পরনে সবুজ লুঙ্গি, লাল চেক গামছাটা কাঁধে, মাথায় মাথাল। গামছায় বাঁধা মুড়ি। আঙুলের চিপায় বিড়ি। চোখ দুটো বেশ সুন্দর গোটা গোটা! নাকটা চওড়া, শ্যামল বর্ণটা রোদে পুড়ে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। বেশ লম্বা-চওড়া। স্বপ্নের পুরুষটি যেন পানসির মনের মতো করে বিধাতা গড়েছে। ‘পানসি, একটু আগুনের জুন্যে আইছি।’ পানসি দৌড়ে মাটির হাতায় আগুনের ছাই এনে গহরের হাতে দেয়। পানসির ভেতরে লজ্জা ভয়-জড়তা। কিন্তু সারা মুখে ঝিলমিল খুশির আভা। গহর বিড়িতে টান দেয় আর পানসির দিকে তাকায় মায়ভরা চোখে। পানসির মুখটা মাটির দিকে। ‘এক গিলাস পানি দিবা?’
পানসি কুয়া থেকে ঠান্ডা পানি তোলে, ঘটি ভরে গহরের সামনে রাখে। গহর কাঁঠালতলে ছায়ায় বসে মুড়ি খায়। পানি খেয়ে বলে, ‘আর খাইমু না। তোমার আঁচল পাতো।’ পানসি লজ্জায় মোচড় দেয়। মুখে কথা নেই। আঁচল পাতে না, গহর নিজেই আঁচল ধরে মুড়ি ঢেলে দেয়, তারপর আমের আঁটির বাঁশিতে মায়াবী সুর তুলতে তুলতে চলে যায়। পানসি ওর গমনপথের দিকে চোরা চোখে তাকায়। ওর চোরা চাহনিতে যেন আসমানের দেহ থেকে নীলিমা ঝরে পড়ছে। ওর রাঙা ঠোঁট দুটো একা একাই ভালোবাসার কথা বলছে, চোখের কোণে নিঃশব্দ দেওয়াল ভেঙে আঁকছে স্বপ্নের ছবি। মৌনতার জালে বুনছে। কত গল্প, কত স্বপ্ন গাঁথা।
জয়তুনের ডাকে ধ্যান ভাঙে পানসির। বেশ আগ্রহ নিয়ে পানসি প্রশ্ন করে জয়তুনকে। ‘ভাবি, বিদেশি মেম তোমার বাড়ি আইছল?’
‘হু রে। হেই কথা কইবার জন্য মন আনচান করতাছে। চাচি আম্মা কই?’ পানসি ঘরের দিকে দেখিয়ে দেয়। দুধজানের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয় জয়তুন। পাশে পানসিও শ্রোতা।

হৃদয়তট তছনছ করে গেছে যে সুনামি, সেই সুনামির স্বপ্ন দেখতে দেখতে দিন যায় মনুর। মনুর চোখে দুটো স্বপ্ন। রূপী আর স্বপ্নের দেশ। এখন খুব একটা বাইরে যায় না সে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় শরিক হয় না। বেশিরভাগ সময় পার করে ঘরে শুয়ে শুয়ে, আর স্বপ্ন দেখে। বেশ কয়েক দিন কেটে যায় এভাবে।
মনুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। নতুন শার্ট আর পরিষ্কার লুঙ্গি পরে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে আর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায়। জয়তুন পানসির বাড়ি থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই অবাক হয়। ‘কি গো সাইজা-গুইজা যাও কই? তাও আইজ শনিবার। শনিবারে যাত্রা ভালা না।’ গরমে শরীর ঘেমে ওঠে জয়তুনের। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলে জয়তুন।
‘জাহান্নামে যাই। তোর কাছে কৈফিয়ত দিতে অইবো!’
জয়তুন চুপ হয়ে যায়। এমনিতেই মনুকে সে ভয় পায়। তার ওপর কয়েক দিন যাবৎ সে বাইরে বের হয় না। ঘরে শুয়ে শুয়ে কী যেন ভাবে। জয়তুনের সঙ্গে কোনো কথাও বলে না। তারপর মনকে প্রবোধ দিতে পারে না। কী এক অজানা আশঙ্কায় আর্তনাদ করে ওঠে। তাই ভয়ে-ভয়ে আবার বলে, ‘শনিবাইরা দিনডা ভালা না। তাই কইছিলাম, আমার কাছে একটু কওন যায় না?’
মনুর অন্তরের কোথায় যেন জয়তুনের জন্য একটু কোমল ছায়া নড়ে ওঠে। নরম স্বরে বলে, ‘রোজগার না করলে তো সংসার চলব না। কুহপডরা যাইমু। রূপী বিয়াইন দেখা করতে কইছে। দেখি কী করা যায়? তুই ভালা থাকিস। আমার জুন্যে ভাবিস না।’

গুতু ফকির পান চিবাতে চিবাতে ধলাবুড়ির বাড়ি হাজির হয়। উঠানের কোণে বসে পাটের শিকা বুনছে ফটিকের মা। তার পাশেই অতীতের গল্পে মশগুল ধলাবুড়ি। অতীতের গল্প বলা তার প্রধান কাজ। সুযোগ পেলেই গল্পের ডালা খুলে বসে। গল্প শুনে সবাই সেসব নিয়ে ধলাবুড়ির সঙ্গে খুনশুটি করে। গুতু উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘ধলাচাচি, ধলাচাচি, এইদিকে আসো। তোমার সাথে কথা আছে।’
ধলাবুড়ি লাঠি ধরে ঠকঠক করে এগিয়ে এসে বলে, ‘গ্যাদা, ঘরে চলো। তারবাদে তোমার সাথে কথা কই।’
ধলাবুড়ি পিঁড়িটা এগিয়ে দেয়। গুতু ফকির পিঁড়িতে বসতে বসতে বলে, ‘চাচি, বড়ো গোদির মায়ের সাথে আলাপ করলাম।’
ধলাবুড়ি পান বানাতে বানাতে বলে, ‘গ্যাদা, জইন পোলাডা ভালা। কেমুন ডাকখোঁজা। হালটা দিয়ে যাওনর সুময় আমার সাথে দেখা করবই। জাতে মিশিগারিÑ এটুকু দোষ। তা ছাড়া আর কোনো দোষ নাই। খাওন-পিন্দনের অভাব অইবো না।’ পানের খিলিটা গুতুর হাতে দিতে দিতে বলে ধলাবুড়ি।
গুতু পানের খিলিটা মেলে ধরে বলে, ‘চাচি, আরেকটু গুয়াপাতা (তামাকপাতা) দেও।’ বুড়ি তামাকপাতা ছিঁড়ে দেয়। গুতু আয়েশ করে পান চিবায় আর কথা বলে। ‘চাচি আমার অবস্থা কী, তা তো জানো। কিছু দেওনের ক্ষমতা নাই। শরীরডা যদি পাইড়া যায়, তাইলে ভিক্ষা ছাড়া উপায় নাই,’ বলে গুতু ফকির।
‘গ্যাদা, আমি তো জানি। জইনরে সবকিছু খুইলা কইছি, হে কইছে, দেওন-থুয়ন নিয়া বাজব না। গ্যাদা, তুমি একটা তারিখ দেও। হেইদিন ময়মুরুব্বিরা থাকব। কথাবার্তাও পাকা অইবো।’
‘চাচি, আগামী শুক্করবার জুমার নামাজ বাদে। তাখিটা জানাইবা। তারা কয়জন আইব হেই খবরডাও আমারে জানাইবা। বেশি মানুষ আসলে তো আমি পারমু না।’
‘তুমি চিন্তা কইরো না। তোমার খবর আমার চাইয়া তো কেউ বেশি জানে না। জইন ভালা পোলা। আমি বুঝাইয়া কইমু। হেও তোমার খবর জানে। আইজ বৈকালেই খবর পাইবা।’
গুতু বাড়ি ফিরে দুধজানকে বিস্তারিত জানায়। দুধজান মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘ঘরে নাই খাবার। এখন কী করবেন? আমি তো চোখে অন্ধাইর দেখতাছি!’
গুতু বাড়ি থেকে বের হতে হতে বলে, ‘দেকি কী করন যায়? খোদার উপর ভরসা কইরা বাইর হইতাছি।’ গুতু পথ দিয়ে হাঁটে আর ভাবে, কী করা যায়। ভাবতে ভাবতে একসময় গেটু মাতবরের বাড়ি এসে হাজির হয়।
গেটু হরিপুর গ্রামের মাতবর। এ গাঁয়ে তার কাথার ওপর কথা বলার সাহস কারো নেই। কারণ গ্রাম্য পলিটিকসের প্রধান নায়ক সে। গুতু ফকির মুখটা কাঁচুমাচু করে মাতবরের সামনে দাঁড়ায়। ‘চাচা, একটা বিষয়ে কথা কইতে আইলাম আপনের কাছে।’
‘বাজান, কী কথা গো? কও।’
‘চাচা, আগামী শুক্করবার আমাগো বড়ো গেদিরে দেখতে আইবো। বৈলামপুরের কাশির পোলা জইনদালি। আমার খবর তো জানেন। ঘরে নাই খাবার। আমি মহা চিন্তায় পইড়া গেছি। চাচা, আমারে পরামর্শ দেন কী করমু? আপনে ছাড়া আর আমার আপন কেউ নাই।’
‘বাজান, এক কাম করো। আইজ রাইতে আসো। দেখি কী করন যায়!’
গুতু ফকিরকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে একদল ছেলেমেয়ে উল্লাস করতে থাকে আর সুর করে বলতে থাকেÑ
‘আয় আয়-বুলু-বুল-বুল।
ঘুমায় না ঘুমায় না। ঘুমায় না।
গুতুদাদার ঝোলায় কুল-কুল-কুল \
গুতু এসব শুনে অভ্যস্ত। কাজল, আলতা, চুরি, ফিতা বিক্রি করে বাচ্চাদের আকৃষ্ট করার জন্য সে চোখে কাজল দেয়। আর ছড়াটি সুর করে আবৃত্তি করে।
কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো হঠাৎ গুতু ফকিরকে নিয়ে ছড়া বলা বন্ধ করে দেয়। তারা গাঁয়ের মেয়ে আমেনাকে দেখে তার পেছনে লাগে। হইহই করে বলতে থাকেÑ
‘এক কলমে দুই ননার পানি
আমিনা তুমি স্বীকার করো
গেটু তোমার স্বামী।’
আমিনা বকা দেয় আর ওদের ধাওয়া করে। দুষ্টু ছেলের দলও দৌড়াতে থাকে আর ব্যঙ্গ করে ছড়া কাটতে থাকে। গুতু ফকির আমেনাকে থামায়। তার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘দিদি, খ্যাপো ক্যা? তুমি খ্যাপো, তাই ওরা মজা পায়। তুমি যদি না খ্যাপো ওরা আর কইবো না।’
‘দাদা, তুমি তো শুনলা। ওরা কী পচা কথা কয়।’ আমেনার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে।
‘দিদি, বাড়ি যাও। কাইন্দো না।’
দুষ্টুর দল আবার ছড়া বদল করে করে বলতে থাকেÑ
‘ওই ছেড়িরে ধর, ঘটির মধ্যে ভর
ঘটি গেল ভাইঙা, ছেড়ি গেল কাইন্দা।’
আমেনা এবার জোরে কাঁদতে থাকে আর বকাবকি করতে থাকে। গুতু আমেনাকে আগলে ধরে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘যা দিদি, বাড়ি যা।’

গুতুর বাড়িতে নতুন অতিথির আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত সবাই। গুতু এক বস্তা চাল এনে ঘরে রাখে। দুধজান চমকে যায়। বলে, ‘এত চাইল? ট্যাহা পাইলান কই?’
‘কাইল রাইতে গেটু মাতবরের বাড়ি গেলাম না? তখন মাতবর চাচা, পংকু, গেদু ও ফটুরে কইল, আমারে যান সাহায্য করে। আইজ গেছিলাম। সবাই সাহায্য করল। যে যা পারছে, কেউ ট্যাহা দিছে, কেউ দিছে চাইল। যাউক, দেখাদেখির দাবার পার করতে পারমু।’
‘এই ধাক্কা না হয় সামাল দিলেন। তার বাদে কী অইবো?’ জানতে চায় দুধজান।
‘পরের কথা পরে। খোদা একটা ব্যবস্থা করবই। কোনো উপায় না হইলে সুদে ট্যাহা পাওন যায়। বাদ দে পরেরডা নিয়া এখন ভাবিস না। পান দে।’

পানসির কোলে একটা ছাগলছানা। সামনে উন্মুক্ত দক্ষিণের সবুজ মাঠ। পুতি কোথা থেকে এসে পানসির গলা জড়িয়ে বলে, ‘বড়ো বু, তোরে দেখতে আইবো। যে দুলাভাই আইবো, হে তোরে পছন্দ করছে। শুক্কুরবার মুরব্বিরা আইবো। হেগো পছন্দ হইলে ঐদিনই বিয়া। বড়ো বু, তোর বিয়ার মধ্যে কী যে মজা করমু!’
পানসির কলজের মধ্যে চিড়িক দিয়ে ওঠে। বেদনার নীলে ছেয়ে যায় সমস্ত মুখ। তার অন্তরে লুকানো সুন্দর দ্বীপটা বিষণœতায় ঢাকা পড়ে যায়। বুকের মধ্যে ঠাঁই নিয়েছে যে মনপোড়া দেবতা, তাকে কোন রঙের তুলি দিয়ে মুছবে সে?
‘বড়ো বু, তুমি এমন বেজার ক্যা?’ এরই মধ্যে পাতা এসে হাজির হয়। পুতি বলে, ‘বড়ো বু, বাড়িডা কেমুন খুশি খুশি লাগতাছে। পাতা দেখ, বড়ো বু মুখটা কেমুন প্যাঁচার মুতন কইরা রাখছে।’
পানসি নির্লিপ্ত। নোনা পানিতে চোখ দুটো টলমল করছে তার। পুতি বলে, ‘বড়ো বু শরম পাইছে। পাতা, আয় চইলা যাই। বড়ো বু, তুমি দুলাভাইরে নিয়া খোয়াব দেখো।’ সত্যি, পুতি ও পাতার কথায় পানসির স্বপ্ন ভাঙতে হানা দেয় অসুর। তার ভেতরের সুন্দর স্বপ্নটি ভাঙন ধরে।

মনু মিয়া কুহপডরায় রূপির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রূপী মাচানের ওপর বসে ছিল। উদাস দুপুরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় উড়ছে তার কুঞ্চিত কেশ। মনু পেছনে থেকে ছাতা দিয়ে রূপির ঘাড়ে আলতো খোঁচা দেয়। রূপী পেছনে ফিরে অবাক হয়! ‘আরে তুমি? তোমাকেই ভাবছিলাম। আশ্চর্য! ভাবনাটা এভাবে বাস্তব হবে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’
মনুর হৃদয়গাঙে ভালোবাসার দাপাদাপি শুরু হয়। সাপের নীলচে বিষের ছোবল খেয়ে যেন নিষিদ্ধ গন্ধমের আকর্ষণে দাউদাউ জ্বলে ওঠে সে। মনুর হাত ধরে রূপী হ্যান্ডশেক করতেই সে যেন কেমন করে ওঠে। মনু স্তব্ধ! রূপী মুচকি হেসে বলে, ‘এই কী ভাবছ? বসো, পানি নিয়ে আসি।’ মনু মনে মনে ভাবে, রূপীর শরীরও কি থরো থরো কাঁপছে। নিষিদ্ধ তৃষ্ণার তার সারা অঙ্গ হাহাকার করে ওঠে।
‘মেমসাব, তৃষ্ণা কি পানিতে মিটবো?’
রূপী প্রহসনের কৃত্রিম হাসি হেসে বলে, ‘ইস! তাই বুঝি? আপাতত শরবত খাও। তোমাকে গাঙের গভীর জলের কাছে নিয়ে যাব। সেই গহিন জলে দুজনে ডুবসাঁতার খেলব। দেখবে সমস্ত তৃষ্ণা মিটে গেছে সুখসায়রে, শুধু ভাসবে আর ভাসবে।’
রূপীর কথাগুলি মনুর হৃদয় রাঙিয়ে দেয় কৃষ্ণচ‚ড়ার রঙে। দুজনের মধ্যে কত কথা, হাসিঠাট্টা চলে অনেকক্ষণ। রূপী মনুর হাতটা নিজের হাতে নি