কমদামি ব্রয়লার মুরগির চাপে চাহিদা কমে যাচ্ছে দেশীয় মোরগ-মুরগী

286

চন্দনাইশের গ্রামে-গঞ্জে এখন আগের মত দেশীয় মোরগ-মুরগী চোখে পড়ে না। যৎ সামান্য গৃহস্থীর বাড়িতে মোরগ-মুরগী পালিত হয়। তা অধিক মূল্যে বিক্রি হয়। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর পূর্বে চন্দনাইশের প্রতিটি গ্রামে গৃহস্থীর ঘরে ধানের গোলার নিচে আলাদা টংঘর নির্মাণ করে মোরগ-মুরগীর জন্য ঘর তৈরি করা হত। প্রত্যেকটি পরিবার অন্যান্য পশু পালনের পাশাপাশি দেশীয় মোরগ-মুরগী পালন করে গৃহ বধুরা একটি বিশাল অংকের রোজগার করত। এখন সে দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় চন্দনাইশের বিভিন্ন এলাকায় এখন মুরগীর ফার্ম গড়ে উঠায় মানুষ অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছে মোরগ-মুরগী। এ ব্রয়লার মুরগীগুলো অতিরিক্ত খাবার খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড় হওয়ায় এ মুরগীর ফার্মের দিকে ঝুঁকেছে অনেক যুবক এবং অনেকেই সফলও হয়েছেন। বর্তমানে ব্রয়লার ও ফার্মের মুরগীর ব্যবসা ততটা লাভজনক না হলেও তবুও এ পেশায় অনেকেই গা লাগিয়ে দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মোরগ-মুরগী পালন তথা উৎপাদন ব্যবসা।
২০ বছর আগেও চন্দনাইশের বিভিন্ন পাড়ায়-পল্লীতে ভোর বেলা মোরগের ডাক শোনা যেত। এ সকল মোরগ একটু বড় আকৃতির হত। সে মোরগের ডাকে অনেকের ঘুম ভাঙত। বিশেষ করে রমজান মাসে তৎকালীন মুরুব্বীরা মোরগের ডাক শুনে বলত সকাল হয়েছে, ছেহেরী খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এখন সে রেওয়াজ আর নেই। প্রতিটি মসজিদে বেজে উঠছে ছেহেরী খাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে এবং শেষ মুহুর্তে সাইলেন বা সংকেত। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে দেশীয় খাবার খেয়ে বড় হওয়া মোরগ-মুরগীগুলো আসতে আসতে বেড়ে উঠে এবং এগুলো খুবই সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং শরীরের জন্য উপযোগী। ব্রয়লার তথা ফার্মের মুরগীগুলো রাসায়নিক জনিত খাবার খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠায় এগুলোর স্বাদ তেমন নেই বললেই চলে। এখন প্রতিটি বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ফার্মের মুরগী দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু অনেকেই এ ধরনের ব্রয়লার বা ফার্মের মুরগী না খাওয়ার কারণে টেবিলের মধ্যে মুরগীর মাংস থেকেই যায়। এখনো দেশীয় মুরগীর স্বাদ আলাদা হওয়ায় হোটেল-রেঁস্তোরায় দুই ধরনের মোরগ-মুরগী রান্না করা হয়ে থাকে। দেশীয় মুরগীর চাহিদা বেশি থাকায় সে পরিমাণ মুরগী বাজারে না আসার কারণে দাম চড়ায় থাকে সব সময়। স্থানীয় মুরুব্বীদের মতে দেশীয় মোরগ-মুরগীগুলো ২০ থেকে ৩০টি ডিম দেয়। এ ডিমগুলো সূর্য না দেখে মত বাড়ির একটি জায়গায় জমায়েত করে রাখা হয়। পরবর্তীতে মুরগীর ডিম দেয়া শেষ হলে একটি কাঁচায় করে বাচ্চা ফুটানোর জন্য স্থান করে দেয়া হয়। সেখানে মুরগীটি তা দিয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে তাদের বংশ বিস্তার করে। এমনকি এ সকল মুরগী দিয়ে হাঁসের বাচ্চাও ফুটানো হত বলে তারা জানান। ফলে এ বাচ্চাগুলো গৃহস্থের লালন-পালনের মধ্য দিয়ে আসতে আসতে বড় হতে থাকে। সময় লাগে অনেক। ফলে এ কষ্ট বর্তমান সমাজের লোকজন করতে চায় না। তাই তারা ফার্মের তথা ব্রয়লার মুরগী ক্রয়ের জন্য তাদের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মোরগ-মুরগী। এক সময় হয়তো দেশীয় মোরগ-মুরগী আষাঢ়ের গল্পের মত শুনবে আগামী প্রজন্ম। তাই এ দেশীয় মোরগ-মুরগীর স্বাদ পেতে এবং ধরে রাখতে সরকারিভাবে দেশীয় মোরগ-মুরগী লালন-পালনের উপর পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল। অন্যথায় এ সুস্বাদু দেশীয় মোরগ-মুরগী আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে এক সময় হারিয়ে যাবে। দেশীয় প্রজাতির মোরগ-মুরগীর ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রেয়াজুল হক জসিম বলেছেন, বর্তমান বাজারে এটার চাহিদা থাকার কারণে মানুষ আবার নতুন করে মোরগ-মুরগী লালন-পালনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
দেশীয় তুষ পদ্ধতিতে ডিম ফুটানো এবং মুরগী ছাড়া বাচ্চা পালনের ব্যবস্থা করা, মুরগী অধিক ডিম দেয়ার ব্যাপারে গৃহস্থীদের বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এতে এর ফলপ্রসু অগ্রগামী হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অপরদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও হালদা বিশেষজ্ঞ মনজুরুল কিবরিয়া বলেছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমানুপাতে চাহিদা মোতাবেক দেশীয় মোরগ-মুরগী উৎপাদন পর্যাপ্ত না হওয়ায় অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দেশীয় মুরগীর গ্রোত কম। কিন্তু ফার্ম মুরগীর গ্রোত বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে সেদিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখনো পর্যন্ত দেশীয় মুরগীর যে চাহিদা রয়েছে এটাকে নিয়ে আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে কাজ করি বা ফার্মিং করি সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসলে এক্ষেত্রে অর্থনীতিক সমৃদ্ধিসহ দারিদ্র ও বেকারত্ব নিরসনে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।