এক ব্যাগ বই

226

রুপার সারাক্ষণের খেলার সাথী হচ্ছে দাদু। একমাত্র বন্ধু, সেও দাদু। আবার একজন মাত্র টিচার, সেও দাদু। মোটকথা দাদু ছাড়া রুপার একটা দিনও চলে না। দাদুটা যেন সবসময় ছায়ার মতো লেগে থাকে। দাদুর সাথে কথা বলা। খুনসুটি, ঝগড়া-ঝাটি, বায়না ধরা। সব।
দাদুর মুখে মুখে অ আ শেখা। শ্লেটে চক দিয়ে লেখা শেখা। পড়ালেখার হাতেখড়ি দাদুর হাতে। আবার পিঠে বসে ঘোড়ায় চড়তে গেলেও দাদু। স্কুলে যাবে? মেলায় যাবে? তাও দাদুর হাত ধরে যাওয়া আসা। দাদুর হাত ধরে হাঁটতে শেখা। দাদুর মুখে মুখে বলতে শেখা।
সেই দাদু যখন বাসায় শব্দ করে রুপাকে বর্ণমালা শেখায়, তখন বাসার আশে পাশে অনেকে কান পেতে শোনে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে। বড়রা যারা শোনে, তারা ফিরে যায় অতীতে। সেই সকালে মোরগের ডাক দেওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে ওঠা। তারপর বই নিয়ে পড়তে বসা। রুপার দাদুর পড়ানোর কৌশল দেখে অনেক বলে, রুপার দাদুটা খুব ভালো। অনেকে খুশি হয়। কেউ আবার মুখ টিপে হাসে।
পাশের বিল্ডিং-এ থাকে রাতুল। রাতুলের দাদু নেই। রুপার খেলার সাথী। খেলার সময় রুপা দাদুর সাথে নিচে নামে। রাতুল, রুপা, শম্পা, সোহানা, রিমন সবাই খেলে। দাদু খেয়াল রাখে। কোথাও পড়ে গেল না কি। রাতুল দুঃখ করে মাকে বলে, আমার দাদুটা চলে গেলো কেন? থাকলে কত ভালো হতো।
বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত, আদর্শলিপি বইগুলো দাদুর একেবারে মুখস্ত। তাল দিয়ে দিয়ে এ বইয়ের পড়াগুলো কত সুন্দরভাবে রুপাকে শোনায়। হাত পা নেড়ে, অভিনয় করে রুপাকে পড়তে শেখায়। রুপা মুখে মুখে বলে। তান ধর, গান কর। এখন রুপা মাছের নাম, ফুলের নাম, পাখির নাম বলতে পারে। সব দাদুর কাছে শেখা।
রুপা দাদুর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে। কিন্তু এখনও স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। কখন স্কুলে যাবে। এই নিয়ে রুপার যত চিন্তা। রুপার বড়’দা নবনীল। রোজ বই ভর্তি ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে স্কুলে যায়। দেখতে বেশ লাগে। পিঠে ঝোলানো ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি সব বই আর বই। বেশ ভারী ব্যাগ। তবুও এতটুকু কস্ট হয় না। কেমন আনন্দ আর হাসিমুখে স্কুলে যায়। রুপার ইচ্ছা হয়, দাদার মতো আমিও স্কুলে যেতে পারতাম।
দাদু বলেছে, অবশ্যই যাবি। এই সামনে বছর তোকে স্কুলে ভর্তি করে দেবো। রুপা মুখ ভেংচি কাটে। হুম, যাবো বললে কী হলো। কত ঝামেলা। ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। পাশ করতে হবে। তবে তো ভর্তি। দাদু সাহস দিয়ে বলে, তা হবে কেন? আমার দাদু ভাই কম কীসে? পরীক্ষা দেবে। পাশ করবে। তারপর স্কুলে ভর্তি হবে। আমার দাদুভাই এবার সত্যি সত্যি স্কুলে যাবে।
সত্যিই, দাদুটা যেন জাদু জানে। শহরের নামকরা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিলো রুপা। পরীক্ষায় পাশও করলো। হেড মিস্ট্রেস মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, বাহ! ল²ী মেয়ে। মিষ্টি মেয়ে। ভালোমতো লেখাপড়া করবে কিন্তু। প্রতিদিন স্কুলে আসবে। একদম ক্লাস মিস করবে না। হেড মিস্ট্রেসের মায়াভরা আদর রুপার খুব ভালো লাগে। স্কুলটা মনে হচ্ছে খুব আনন্দের জায়গা। সারাদিন বন্ধুদের সাথে ছুটোছুটি, লুটোপুটি। সে খুব খুশি হয়।
এবার ভর্তির পালা। ভর্তিও হয়ে গেলো। ভর্তির দিন রুপাকে মা নিয়ে যাচ্ছিলো। রুপা বাঁধ সাধলো। বললো, দাদুকেও যেতে হবে। অবশেষে দাদুও সাথে গেলো। রুপার আনন্দ দেখে কে। মা বাবা সবাই খুশি। জীবনের প্রথম পরীক্ষায় পাশ করে রুপা প্রথম স্কুলে যাচ্ছে।
রুপার আনন্দের সাথে সাথে বায়নারও যেন শেষ নেই। আজ এটা লাগবে, কাল ওটা লাগবে। নতুন জামা, নতুন জুতো, মৌজা সব। সবচেয়ে বেশি যে বায়নাটা, তা হলো ভাইয়ার মতো একটা স্কুল ব্যাগ।
বছরের প্রথম দিন রুপাকে স্কুলে যেতে বলেছেন টিচার।
বছরের প্রথম দিন। দাদা সকাল থেকে তৈরী। নবনীল বলেছে, আজ স্কুলে বই উৎসব। নতুন ক্লাসের নতুন বই দেবে সবাইকে। রুপা জানতে চাইলো, আমাকেও দেবে তো? নবনীল বললো, কী করে বলি। তুই তো মাত্র ক্লাস ওয়ানে। তাছাড়া নতুন ভর্তি হয়েছিস। স্কুলে গেলেই বুঝতে পারবি। রুপার মন খারাপ হলো। তাহলে কি রুপা নতুন বই পাবে না? দাদুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলো। দাদু মুচকি হেসে বললো, আজ প্রথম স্কুলে যাচ্ছিস। মন খারাপ করতে নেই।
আজ স্কুলের প্রথম দিন। একটু ভয়ও লাগছে রুপার। স্কুল গেইটে ঢোকার আগে রুপা দাদুকে হাত নেড়ে বললো, তুমি যাবে না কিন্তু। দাদুও আচ্ছা বলে গেটের ভিতর রুপার হাতটা ছেড়ে দিলো। টিচারদের সাথে মাননীয় জেলা প্রশাসকও সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন শহিদ মিনারের সামনে। হেড মিস্ট্রেস উপস্থিত সকলের সাথে প্রধান অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
নতুন বছরের অভিবাদন জানালেন। বললেন, এখন এ্যাসেম্বলী হবে। তারপর প্রধান অতিথি মহোদয় বই উৎসব উদ্ভোধন করবেন। সকলের হাতে নতুন বই তুলে দেবেন। রুপা ভাবছে, আমি বই পাবো তো?
রুপা জাতীয় সংগীত ভালো গাইতে পারে। সবাই মিলে এই প্রথম গাইছে। খুব ভালো লাগছে। সমবেত জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন প্রধান অতিথি। তারপর নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই তুলে দেওয়ার আনন্দের কথা বললেন। সবার সাথে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলেন। এর মধ্যে রুপার সাথে অবরার ভাব হয়। অবরাও প্রথম স্কুলে এসেছে। এবার ডাক পড়লো অবরার। অবরা গিয়ে প্রধান অতিথির হাত থেকে বই নিলো। ডাক পড়লো রুপার। রুপাও ছুটে গিয়ে বই নিলো। নতুন বই পেয়ে রুপার চোখে জল এলো। আনন্দের জল। আজ আর ক্লাস হবে না। স্কুল শেষে দাদুর হাত ধরে বাসায় ফিরছে রুপা।
বইয়ের বোঝা ভারী দেখে দাদু ব্যাগ নিতে চাইলো। রুপা কিছুতেই দেবে না। সে একাই পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে বড়’দার মতো খুশি মনে বাড়ি ফিরলো।