৫ প্রজাতির মাছে বিপ্লব ঘটাতে চায় মৎস্য অধিদপ্তর

62

এম এ হোসাইন

খাল-বিলের মাছ হিসাবে পরিচিত অনেক মাছ এখন বেশ চোখে পড়ছে বাজারে। কিছুদিন আগেও বিলুপ্তির তালিকায় এসব মাছের নাম থাকলেও এখন সেসব মাছ ভাতের পাতে ফিরছে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশী মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ উপযোগী করার মাধ্যমে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করা গেছে এসব মাছ। দেশে এ পর্যন্ত ২৪টি দেশী প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন করে চাষাবাদ সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ প্রজাতির মাছ চাষাবাদ হচ্ছে চট্টগ্রামে। ইতিমধ্যে আশানুরূপ সফলতাও এসেছে দেশী প্রজাতির মাছ চাষে। সামনের দিনগুলোতে দেশি মাছের চাষের উজ্জ্ব¡ল সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
এক বছর আগে গত মার্চে চট্টগ্রামে কৃত্রিম প্রজননের পোনার চাষাবাদ শুরু হয়। পটিয়াতে পাবদা মাছের এই চাষাবাদ শুরু করেন কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে প্রাপ্ত পোনা চাষ করে ভাল ফল পায় তারা। জেলা মৎস্য অফিসের সহযোগিতায় হাটহাজারী ও কর্ণফুলীতেও দেশী মাছ চাষ শুরু হয়। শিং, মাগুর, কৈ, টেংরা, পাবদা- এই পাঁচ প্রজাতির মাছের চাষ হচ্ছে চট্টগ্রামে। এক বছরের ব্যবধানে এসব মাছের আশানুরূপ ফলাফলও পেয়েছে মৎস্য কর্মকর্তারা। এই ফলাফল থেকে আগামীতে দেশী মাছের উজ্জ্বরল সম্ভাবনাও দেখছেন তারা। দেশী মাছের ব্যাপক চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে কৃত্রিম প্রজননের চাষের মাছ।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, আগে আমাদের এদিকে দেশী মাছ চাষ হতো না। আমরা খালে-বিলে পেতাম। মানুষ খাল-বিল ভরাট করে ঘরবাড়ি করছে। বিষের কারণে অনেক মাছ মারা যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে দেশী অনেক মাছ বিলুপ্ত হতে চলছিল। দেশী মাছের সক্রিয়তা বাড়াতে সরকার দেশী মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়। এই পর্যন্ত ২৪টি প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। পাবদা, ট্যাংরা, শিং, মাগুর, কৈ কৃত্রিমভাবে প্রজনন করে পোনা করা হয়েছে। চট্টগ্রামে শিং, মাগুর, কৈ, টেংরা, পাবদা এই ৫ প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন থেকে পোনার চাষাবাদ হচ্ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে নতুন কওে প্রদর্শনী দিচ্ছি, চাষ করা শুরু করেছি। অনেক জায়গায় ভাল উৎপাদন হচ্ছে। পটিয়া, হাটহাজারীতে আমরা চাষ করেছি। গত বছর পটিয়াতে খুবই ভাল ফলন হয়েছে। কয়েকজন ইউনিভার্সিটির ছেলে চাষ করেছে। ফলাফল অনেকটা ভাল। হতাশাজনক কিছু আমরা পাইনি।
পুষ্টির দিক বিবেচনায় মাছকে নিরাপদ আমিষের প্রধান উৎস বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া প্রাণিজ আমিষের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ যোগান আসে মৎস্য খাত থেকে। চট্টগ্রামে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বাড়ছে প্রতি বছরে।
মৎস্য বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চট্টগ্রামে মাছ উৎপাদন হয়েছিল ৬৯ হাজার ১৫৫ টন। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৭৫ হাজার ৪৯৬ টন। পরের বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৮৩ টন। সর্বশেষ গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেড়ে হয় ৮০ হাজার ১৪৯ টন। তিন বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে ১০ হাজার ৯৯৪ টন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন, বাংলাদেশের দেশীয় মৎস্য উৎপাদনে দেশীয় ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫ শতাংশ। এসব মাছের চাহিদা বেশি থাকায় চাষাবাদও দিনে দিনে বাড়ছে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা প্রাপ্তি সহজলভ্য হওয়ায় এর মধ্যেই হ্যাচারিতে বা কৃত্রিম পদ্ধতিতে পাবদা, গুলশা, শিং, মাগুর, আইড়, চিতল, রাজপুটি, মেনি, দেশি সরপুঁটি, কালিবাউশ, গজার, টেংরা ও কৈ মাছের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক দশকে ছোট মাছের উৎপাদন চারগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে এই মাছের উৎপাদনের পরিমান যেখানে ছিল ৬৭ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০১৮ সালের উৎপাদন ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে ২০০০ সালের মে মাস থেকে ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু, শিকলবাহা ও চাঁদখালী নদীতে পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, পাঁচ নদীতে মোট ১৩০ প্রজাতির মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়ার খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ও কাঁকড়া রয়েছে। ১১২ প্রজাতির মাছের মধ্যে নাইলোন্টিকা মাছকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া ৬ প্রজাতির মাছ বিপন্ন ও ১১ প্রজাতির মাছ অস্তিত্বের হুমকিতে রয়েছে।
গবেষণায় দেশীয় মাছের মধ্যে আছে বাইম, অলুয়া, গ্যাং মাগুর, গুলশা, ট্যাংরা, বাগাড়, চরপ মহাল, নাক কাটা, ঢেলা, শিং ওয়ালা রুই, ছেপচেলা, কালা বাটা, ঘোড়া চেলা, শিল বাইলা, চ্যাং মাছ, টাকি, ভোট বাইলা ও শোলসহ বেশ কিছু মাছ বিপন্ন অবস্থায় থাকার কথা উল্লেখ করা হয়।