৪০ বছরে ১৮ ধরনের ফল ও সবজির জাত উদ্ভাবন

229

পার্বত্য চট্টগ্রাম কৃষিনির্ভর অঞ্চল হিসেবে বেশ পরিচিত। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও এ অঞ্চলে এখনো তেমন কোন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। ফলে ভৌগোলিক কারণে পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। এ লক্ষে পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষির উন্নয়নে ১৯৫৭ সালে ‘প্ল্যান্ট ইন্ট্রোডাকশন সেন্টার’ নামে কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা থানাধীন কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ‘রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় এ কেন্দ্রে শুধুমাত্র বিদেশ হতে আমদানিকৃত বীজ সংরক্ষণ করা হত। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে একই এলাকায় ৯৬ একর জমিতে গড়ে উঠে পূর্ণাঙ্গভাবে ‘রাইখালী পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র’। যা হয়ে উঠে কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণার আঁতুরঘর হিসেবে। প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরে ১৮টি উদ্যানতাত্ত্বিক বিভিন্ন ফল ও সবজির উন্নত জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এ অঞ্চলের কৃষকের ‘বাতিঘর’ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
রাইখালী পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলতাফ হোসেন জানান, কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে উদ্ভাবিত ফল ও সবজি শুধু এ অঞ্চলেই নয়, দেশের কৃষির উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। দুজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৬৫ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা নিয়ে এগিয়ে চলা এই গবেষণা কেন্দ্রে গত তিন বছরে নতুন আরও ৩টি ফলের উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। শুধু জাত উদ্ভাবনই নয়, মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে গবেষণা কেন্দ্রটি। প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রমে পাহাড়ি অঞ্চলে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে নিরবে কাজ করে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এখানে উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাত ব্যবহার করে কৃষকরাও পাচ্ছেন সুফল।
গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবিত ৯টি সবজির জাত হল, বারি ঝারশিম-২, বারি ঝারশিম-৩ (খ্যাইসা), বারি জ্যাকবিন-১, বারি সীতা লাউ-১, বারি ব্রোকলি-১, বারি চিনাল-১, বারি শিম-৯, বারি শিম-১০ এবং বারি শিম-৪। ৯টি ফলের জাত হল, বারি কলা-৩, বারি কলা-৪, বারি কামরাঙ্গা-২, বারি আম-৮, বারি মিষ্টি লেবু-১, বারি কুল-৪ (বড়ই), বারি ড্রাগনফল-১, বারি জলপাই-১ এবং বারি পেয়ারা-৪ জাত। এছাড়া সম্প্রতি সুদান হতে আমদানিকৃত এ্যাভোগোডা নামক একটি পুষ্টিকর ফলের বীজ এনে এর চাষ শুরু করেছে কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ।
রাইখালী এলাকার উন্নয়নকর্মী রুবি চৌধুরী জানান, এ গবেষণা কেন্দ্র হতে বিভিন্ন প্রজাতির আম এবং ড্রাগন ফলের চারা নিয়ে চাষ করে সুফল পেয়েছি। এখানকার আম খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। এছাড়া মাত্র তিনমাসের মধ্যে ড্রাগনের গাছে ফলন ধরে।
কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আনন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, রাইখালী পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১০০টি বারি কমলার চারা নিয়ে রোপণ করি। গত বছর থেকে ফল আসা শুরু করেছে। খাওয়া-দাওয়া, আত্মীয়স্বজনকে দেওয়ার পরও ৩০ হাজার টাকার কমলা বিক্রি করেছেন তিনি। বাগান পরিচর্যা ও বার্ষিক ব্যয় হয় ১০-১৫ হাজার টাকার মত। আনন্দ বিকাশ আরও জানান, রাইখালী গবেষণা কেন্দ্রে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে কখন কি ওষুধ দিতে হবে এবং কীভাবে গাছের পরিচর্যা করতে হবে, সেভাবেই ওষুধ ও পরিচর্যা করছি। এসব বিষয় তারা সবসময় খোঁজখবর রাখেন এবং সহযোগিতাও করে থাকেন।
কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটি জেলার উপ-পরিচালক পবন কুমার চাকমা বলেন, রাইখালী পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত জাতগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছানোর কাজটি কৃষি সম্প্রসারণ অফিস। তাদের উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বারি আম-৮, বারি আম-১১, বারি আম-৪, বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করার কাজ চলছে। গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞনিক কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ি কৃষির উন্নয়নে রাইখালী গবেষণা কেন্দ্র নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাটি থেকে ১৮টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। গত ৩ বছরে ৩টি ফলের জাত উদ্ভাবনসহ এ বছর আরও ২টি জাত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চলের কৃষি বিপ্লবের এ গবেষণা কেন্দ্র যে ভূমিকা রেখে আসছে, তা এখানকার কৃষক থেকে শুরু করে সর্বমহলে এর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করেন তারা। যাতে ভবিষ্যতে নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে এ অঞ্চলের কৃষিকে তারা আরও সমৃদ্ধশালী করতে পারে।