হারালেন স্ত্রী, ৪ সন্তানকে বাঁচানোর লড়াইয়ে জামাল

11

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পাশাপাশি দুটি কক্ষ। একটি পুরুষ ওয়ার্ড, অপরটি মহিলা ওয়ার্ড। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে কিছুক্ষণ পরপর ছুটছেন জামাল শেখ ও লিমন শেখ। দুইজনই পিতা-পুত্র। যারা গত সোমবার রাতে উত্তর কাট্টলীতে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। তাঁদের ছুটাছুটির কারণ, উৎকন্ঠা। বার্ন ইউনিটের দুই ওয়ার্ডেই দগ্ধ অবস্থায় ভর্তি আছেন তাদের পরিবারের পাঁচজন। দুইজনের এমন ছুটাছুটিতে মহিলা ওয়ার্ডের সিটে সুস্থ অবস্থায় ননদ মাহিয়াকে দেখভাল করছেন ভাবি দিলরুবা বেগম। এই দিলরুবার স্বামীও দগ্ধ হয়ে ভর্তি আছেন পুরুষ ওয়ার্ডে।
গতকাল বিকালে চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে জামাল শেখের পরিবারের এমন দুর্বিষহ জীবন চোখে পড়ে। যে সময়টি পরিবারকে নিয়ে নিজ ঘরে আলো ছড়ানোর কথা সেখানে সবাই মিলে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে ব্যস্ত আছেন হাসপাতালে। যদিও সে যুদ্ধে গতকাল রাতেই পরাজিত হয়েছেন জামাল শেখের স্ত্রী সাজেদা বেগম। ৮৫ শতাংশ দগ্ধ হওয়া সাজেদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা সাজেদা বেগম ও মেয়ে মাহিয়াকে সামনা-সামানি দুটি বেডে রাখা হয়। দুইজনেরই সাদা প্লাস্টারে মোড়ানো পুরো শরীর। পাশের একটি বেড থেকেই শাশুড়ি ও ননদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত আছেন দিলরুবা। কিছুক্ষণ পরপর স্ত্রী সাজেদা ও মেয়ে মাহিয়ার আর্তনাদে দুই বেডেই ছুটছেন জামাল শেখ। আর ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া লিমন শেখ ওষুধ আনা-নেওয়া কিংবা চিকিৎসকের দুয়ারে ধর্ণা দিচ্ছেন। বালিশে মাথা ফেলতেই চিৎকার করে উঠছেন আহমদ উল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়–য়া মাহিয়া। তাইতো কিছুক্ষণ পরপর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সোজা করে বসিয়ে রাখছেন। আর অন্য বেডে স্ত্রীর আর্তনাদ দেখে চোখের পানি ফেলছেন। পুরুষ ওয়ার্ডে পাশাপাশি তিনটি বেডে কাতরাচ্ছেন সানি শেখ (২৫), মো. জীবন শেখ (১৭), মো. স্বাধীন শেখ (১৪)। কিছুক্ষণ পুরুষ ওয়ার্ড, কিছুক্ষণ মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে গুরুতর পাঁচজনকেই দেখভাল করছেন জামাল শেখ ও লিমন শেখ।
গতকাল রাত ৮টার দিকে লিমন শেখের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চিকিৎসক আমার মা ও বোনকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু ঢাকায় নেয়ার আগেই সাড়ে ৭টার দিকে আমার মা মারা যান। হাসপাতালে কথা হলে জামাল শেখ বলেন, আমার এক ছেলে ও পুত্রবধূ ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছেন। বাকি পাঁচজন আগুনে পুড়ে গেছে। সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।
বেঁচে যাওয়া জামাল শেখের পুত্রবধূ দিলরুবা বেগম পূর্বদেশকে বলেন, মরিয়ম ভিলার তিনকক্ষের বাসায় সবাই মিলে বসবাস করতাম। রাতে ভাত খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবাই। আমি ও লিমন বাথরুমে থাকায় রক্ষা পেয়েছি। বের হয়ে দেখি আমার মাথায় আগুন ধরেছে। সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে হাসপাতালে নিজেকে দেখতে পাই। আমি, আমার শ্বশুর ও দেবর লিমন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও আমার শাশুড়ি, স্বামী, অন্য দুই দেবর, ছোট ননদ মৃত্যুশয্যায়।