হত্যা-আত্মহত্যা-ধর্ষণে অস্থির সময় দারিদ্র্য-প্রেম-পরকীয়া-বিকৃতির কাছে ক্রমেই বিপন্ন মানবতা ও মূল্যবোধ

12

তুষার দেব
অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকার মধ্যেই অস্থির এক সময় পার করছে সমাজ। প্রায় প্রতিদিনই নগরী ও জেলার কোথাও না কোথাও হত্যা-আত্মহত্যা-ধর্ষণের মত ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর মধ্যে আবার আপনজনের রক্তেও রঞ্জিত হচ্ছে কারও কারও হাত। বিপথগামী ছেলের হাতে খুন হচ্ছে মা-বাবা। পাশবিকতার শিকার হচ্ছে অসহায় নারী ও শিশু। তুচ্ছ ঘটনার জেরে অনেকে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের মত মহাপাপের পথ। দারিদ্র্য-বৈষম্য-প্রেম-পরকীয়া-বিকৃতির কাছে ক্রমেই যেন বিপন্ন হয়ে পড়ছে মানবিক মূল্যবোধ।
সমাজে বিদ্যমান অস্থিরতা নিয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি বা সনাকের চট্টগ্রাম নগর শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত না হলে সত্যিকার অর্থে টেকসই সভ্য সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠে না। এখন আমরা বর্তমানে বিভিন্ন দিক থেকে যে ধরনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই সুস্থতার বদলে রাখঢাক ছাড়াই অন্যায়-অনাচার ও অসুস্থতার চর্চাই বেশি হচ্ছে। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র-সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ লেগেছে। আমাদের হারিয়ে বসা পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চাগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে এই অসুস্থ-অস্থিরতার ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে কারও রেহাই মিলবে না।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণে প্রভাববিস্তারকারী ধারণা বা আদর্শ। মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজের আদর্শ রূপই হচ্ছে মূল্যবোধ। উন্নত জীবনব্যবস্থার জন্যই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা এবং বিকাশের প্রয়োজন। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মানুষের মনোবৃত্তিতে ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধানে অস্থির পরিবার ও সমাজে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে যেন ক্রমশঃ ফাটল ধরেছে। মূল্যবোধের জায়গাগুলোতে তো আসলে মড়ক লেগেছে। অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সকলকে মিলেমিশে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
ছেলের হাত রঞ্জিত হচ্ছে মা-বাবার রক্তে : পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বৈষয়িক অপ্রাপ্তি ও বৈষম্যের পরিণতিতে অনেকটা নিয়মিতভাবেই পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব কিংবা পারিবারিক বিষয়ে তর্কাতর্কির জেরে ছেলের হাতে খুন হতে হয়েছে মা- বাবাকে। এছাড়া, স্বার্থের সংঘাতে খুনোখুনির ঘটনা তো লেগেই রয়েছে। সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের লড়িহড়া এলাকায় বিমান ধর (৪০) নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বত্তরা। তিনি উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের বণিকপাড়ার বাসিন্দা। নগরীর বাকলিয়ায় তার একটি স্বর্ণের দোকান আছে। ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারি ইউনিয়নের পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামের বাপ্পি কলোনিতে পারিবারিক বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কির জের ধরে বাবা বেলাল হোসেনকে (৫৫) ছুরিকাঘাতে খুন করে পালিয়ে যান ছেলে মোহাম্মদ হেলাল (১৭)। এ ঘটনায় বেলালের মেয়ে খতিজা বেগম বাদী হয়ে সীতাকুণ্ড থানায় ভাই হেলালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। রাত একটার দিকে উপজেলার ভাটিয়ারি ইউনিয়নের মাদামবিবিরহাট এলাকা থেকে পুলিশ হেলালকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তার কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটিও জব্দ করা হয়েছে।
এর আগে আপনজনের হাতে সবচেয়ে আলোচিত হওয়ার ঘটনাটি ঘটে পটিয়া উপজেলায়। গত ১৬ আগস্ট দিনেদুপুরে নিজের বাড়িতে গুলিতে খুন হন একমাস আগে স্বামীকে হারানো জেসমিন আক্তার (৫০)। তিনি পটিয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জাপা নেতা শামসুল আলম মাস্টারের স্ত্রী। এ ঘটনায় মেয়ে শায়লা শারমিন নিপা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করলে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত মঈনুদ্দিন মোহাম্মদ মাঈনুর (৩২) কে গ্রেপ্তার করে। মাঈনুর হলেন শামসুল-জেসমিন দম্পতির বড় ছেলে।
নিহত জেসমিনের পরিবারের অপর সদস্যদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, পটিয়ার সাবেক পৌর মেয়র শামসুল আলম মাস্টার মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি ও ব্যাংকে জমা টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্ব›দ্ব শুরু হয়। ঘটনার দিন সকালে ছেলে মাঈনুরের অগোচরে মেয়ে নিপাকে নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলেন মা জেসমিন আক্তার। বিষয়টি জেনে দুপুরের দিকে মায়ের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়ান ছেলে মাঈনুর। এরই একপর্যায়ে মাকে গুলি করেন তিনি। গুরুতর আহত অবস্থায় মা জেসমিন আক্তারকে চট্টগ্রম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পিবিআইকে।
আত্মহননও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে : অপ্রাপ্তি ও পারিবারিক অশান্তিসহ নানা কারণে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মহননের ঘটনাও। মহাপাপ জেনেও জীবনে ক্ষণিকের সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য অনেকেই বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় আত্মহননের কোনও না কোনও সংবাদ চোখে পড়ে। সম্প্রতি নগরীতে এক কলেজ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আট বছরের ব্যবধানে একই পরিবারের দুই ছেলেই বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। গত ৩১ আগস্ট রাতে নগরীর আসকার দিঘির পাড় কাঁচাবাজার এলাকার ভাড়া বাসায় ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেন অরিত্র ঘোষ (২০)। তিনি সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলায়। প্রেমঘটিত কারণে অরিত্র এ পথ বেছে নিয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। এর আগে ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি অরিত্রের বড় ভাই অন্তু ঘোষ (১৮) নগরীর দেওয়ানজি পুকুর পাড় এলাকার ভাড়া বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি তখন সরকারি সিটি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ওই ঘটনার পর অরিত্রের বাবা বাসা পাল্টিয়ে স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে পরিবার নিয়ে আসকার দিঘির পাড়ে চলে আসেন। অরিত্রের মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী। মা-বাবার বুকজুড়ে এখন কেবলই শূন্যতা আর হাহাকার।
নিয়ন্ত্রণে আসছে না পাশবিকতা : এদিকে ক্রসফায়ারের ভয় কিংবা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেও সমাজে ধর্ষণকাণ্ড বা পাশবিকতার লাগাম টানা যাচ্ছে না। হরহামেশাই কোথাও না কোথাও শিশু কিংবা নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে আবার সাম্প্রতিক সময়ে দলবেঁধে সংঘটিত হচ্ছে একের পর এক ধর্ষণকাণ্ড। এমন জঘন্য পাশবিকতার ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। গত পয়লা আগস্ট পটিয়ায় সংঘটিত দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাশবিকতার অধিকাংশ ঘটনার পরপর জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হলেও শেষপর্যন্ত তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছে না। আইনের ফাঁকফোকরে পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকেই।
বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, চলতি বছরের বিগত আট মাসে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে নয় শতাধিক। তার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে একশ’ ৭৭টি। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৩৮টি। ধর্ষণের শিকার হওয়া অন্তত ১২ জন নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর ধরেই সংস্থাটি এসব তথ্য জানিয়েছে ওই সংস্থাটি। এর বাইরে অজানা কিংবা প্রকাশ্যে না আসা যৌন নিপীড়নের ঘটনা অসংখ্য বলেও তারা দাবি করেছে।