সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি : আধুনিক সভ্যতার অভিশাপ

31

বিলাস কান্তি দাস

দেশে বিদেশে দৈনন্দিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা যে কোন মানুষকে বিচলিত করে। সম্পূর্ণ অনাক্সক্ষাকিত, অপ্রত্যাশিত এসকল অকাল মৃত্যুবরণকারী বিভিন্ন বয়সের মানুষের পরিবার-পরিজনের করুণ আহাজারি দেখে শুনে সকল শ্রেনি পেশার মানুষ আজ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। মানবসৃষ্ট এসকল দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা সভ্যতার অগ্রযাত্রার চরম অন্তরায়। তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগে মামুলি কারণে চোখের সামনে প্রিয়জন হারানোর বেদনা যে কত মর্মান্তিক, ভয়াবহ তা ভুক্তভোগী ছাড়া অনেকের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। অনেকদিন থেকে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে কিছু লেখার অদম্য বাসনা থেকে বর্ণিত শিরোনামের উপর একটি প্রবন্ধ লেখার আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। এর মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার হয়ত তেমন কোন পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে এর মাধ্যমে অসংখ্য প্রাণহানির বিভৎসতার একটা ভয়ংকর চিত্র পাঠক সমাজের কাছে সহজেই দৃশ্যমান হবে বলে আমার বিশ্বাস।
দিনের পর দিন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা এবং সড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ না হওয়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। গত ২ জানু.-২৩ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি’র বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সদ্য বিদায়ী ২০২২ খ্রীস্টাব্দে সড়ক, রেল, নৌ-পথে সর্বমোট ৭ হাজার ৬১৭টি যানবাহন দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে একই দিন প্রকাশিত ‘সেভ দ্য রোড’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই বছরে সড়ক-নৌ ও রেল পথে ১০ হাজার ১০৮টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌ-পথে দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংগঠন দু’টি। প্রতিবেদন বলছে আগের বছরের চেয়ে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯.৮৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি ২৭.৪৩ শতাংশ বেড়েছে। ‘বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২২’ শীর্ষক যাত্রী কল্যান সমিতির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিগত ৮ বছরের মধ্যে বিদায়ী ২০২২ খ্রীস্টাব্দে সড়কে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ১৫ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হয়েছে। ওইদিন ৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত ৯৭ জন আহত হয়েছে। সবচেয়ে কম সড়কদুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর-২০২২। ওইদিন ৯টি সড়কদুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত ও ১৩ জন আহত হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়কদুর্ঘটনায় একদিনে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ২৯ জুলাই,২০২২। ওইদিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত ও ৮৩ জন আহত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার যে প্রতি বছর বাড়ছে সে চিত্রও এসেছে এ রিপোর্ট থেকে।
‘বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি’র পর্যবেক্ষণ মতে- বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রæটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করা, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি, সড়কে চাঁদাবাজি, রাস্তার পাশে হাট-বাজার, ত্রæটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো, মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা, চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট না থাকা, দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি, ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটর সাইকেল, সিএনজি অটোরিকশানির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়াসহ নানা কারণ রয়েছে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে। পরিসংখ্যান বলছে, সড়কদুর্ঘটনায় দেশে মৃত্যুহার বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও লক্ষণীয়ভাবে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে বাংলাদেশে সড়কদুর্ঘটনায় বার্ষিক মৃত্যুহার উচ্চ আয়ের দেশগুলোর দ্বিগুণ এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ নৈপুণ্য দেখানো অর্থনীতির দেশগুলোর চেয়ে পাঁচ গুণের অধিক। আঞ্চলিক গড় বিবেচনায়ও দেশে সড়কে মৃত্যুহার বেশি। গত ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনটির চেয়ারম্যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন ২০২২ সালের সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেন, ২০২২ সালের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ২৪টি। এসব দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছেন ৮ হাজার ১০৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৭৮৩ জন। নিসচা’র পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো, অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’ এর সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০২২ সালে সারাদেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় মোট ৮ হাজার ৩৫৮ জন নিহত হয়েছে। মোট আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৮০১ জন। উল্লেখিত চারটি প্রতিবেদন দুর্ঘটনা, নিহত, আহতের মধ্যে সংখ্যাগত তারতম্য থাকলেও দুর্ঘটনার পরিধি যে কত ব্যাপক এবং ভয়াবহ তা সহজেই অনুমান করা যায়। এভাবে একটি দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা চলতে পারে না।
সা¤প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল এর সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত যথেচ্ছ ব্যবহারের সাথে সাথে গণপরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত (লক ডাঊনের সময় থেকে চোখে পড়ার মতো) হওয়ায় এর মাধ্যমে সংঘটিত দুর্ঘটনায় প্রানহানির সংখ্যা উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। মোটরসাইকেলে মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল বেশি চলাচল করে, এমন ১৬টি দেশের (বাংলাদেশসহ) উপর সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি গবেষণা করে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিঊট (এআরআই)। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন শতকরা ২৮ দশমিক ৪ জন। তাদের প্রায় ৪০ শতাংশেরই বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এই হার সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৯৪৫ জন; যা ২০২২ সালে এসে ২ হাজার ৫৩৩ জনে দাঁড়িয়েছে ( প্রথম আলো, ৩ জানু.-২৩)। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ২০১৫ সাল থেকে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন উচ্চ হারে বাড়তে থাকে। গত বছর (২০২২) পাঁচ লাখের বেশি নতুন মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৫ লাখের মতো। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিঊট (এআরআই) এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি। এ ছাড়া সড়কের শৃঙ্খলার অভাবতো আছেই। সড়ক খাতে শাসন বলে কিছু নেই। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে হলে আগে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু কথা দিয়ে তো সড়ক নিরাপদ হবে না (প্রথম আলো, ৩ জানু.-২৩)’। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘লাইসেন্স ও নিবন্ধন ছাড়াই মোটরসাইকেল নিয়ে মানুষ সড়কে উঠে যাচ্ছে। এসব বন্ধ না হলে সড়কে প্রাণহানি কমার আশা করার কোন কারণ নেই (প্রথম আলো, ৩ জানু.-২৩)’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় সারা বিশ্বে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ মারা যান। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। এ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানি হয় ২৫ হাজার মানুষের। সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর বিশ্লেষণ অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা বেশি। এর একটা অংশ আবার শিক্ষার্থী। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায়, হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের বড় অংশই বয়সে তরুণ, শিক্ষার্থী। বিষয়টি এমন যে সহপাঠী কিংবা বন্ধুরা একসঙ্গে একই মোটরসাইকেলে চলাচলের সময় দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। দুগ্ধ-পোষ্য কিংবা ছোট শিশু সন্তানসহ পরিবার পরিজন নিয়ে একই সাথে মোটরসাইকেলে ভ্রমণের সময় অহরহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এমন উৎকর্ষতার যুগে সম্ভাবনাময় অসংখ্য শিক্ষার্থী বা তরুন বয়সের মানুষের অকাল মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়। যখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট(এসডিজি) অর্জনের লক্ষে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তখন নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ছাড়া কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। প্রতি বছর ২২ অক্টোবর ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালন তখনই সার্থক হবে যদি ২০১৮ সালের জুনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছয় দফা নির্দেশনা সহ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কমিটির ১১১টি সুপারিশ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ দায়িত্বশীল হলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমবে এবং দেশ ও জাতি অপূরণীয় ক্ষতির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম।