সড়ক দুর্ঘটনার নতুন হুমকি বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল

33

 

আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা বা শৃঙ্খলা বলা চলে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সড়ক মহা সড়ক এমন কি মফস্বল শহরেও সড়কে নৈরাজ্য অব্যবস্থাপনা বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। ফলশ্রæতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক মহা সড়কসহ ছোট বড় বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বাস ট্রাক কার জিপ মিনিট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছে মোটরসাইকেল আরহীদের মৃত্যুর সংখ্যা। ‘সা¤প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার শীর্ষ কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোটরসাইকেল। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুসারে গত মার্চে সারা দেশে ৫৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭৯ জন। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২২১ জন। এসব কিছুর পেছনে আছে মূলত গতির প্রতিযোগিতা। কে কত দ্রæতবেগে চালাতে পারে, কার চেয়ে কে বেশি গতি ওঠাতে পারে; গতির এই অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা মৃত্যুকে ডেকে আনছে সড়কে’ {সূত্র দৈনিক আজাদী, ১১ মে’২২}। উক্ত প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় ৪২ শতাংশই মোটরসাইকেলের। অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুসারে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৭০ শতাংশ। দেশে বছরে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।
আমাদের দেশের ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো খুবই দুর্বল। তাছাড়া ট্র্যাফিক পুলিশদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের অভাব, সড়কের বেহাল অবস্থা, ফুটপাত দখল করে কাঁচা বাজার গড়ে উঠা, ভাসমান হকারদের রাস্তা দখল, যত্রতত্র অবৈধ পার্কিং, সড়ক দখল করে অবৈধ বাস ট্রাক টেক্সি ট্যাম্পুর স্ট্যান্ড, অদক্ষ এবং লাইসেন্স বিহীন চালক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির অভাব বা শিথিলতা, ভারী মাঝারি ও হাল্কা বাস, ট্রাক, পিকআপ, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসসহ দ্রæত গতির যানবাহনের বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। পাশাপাশি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবাধে বেপরোয়া গতিতে উচ্চ গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল ক্রয় এবং বাজারে সহজলভ্যতা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন বন্ধ থাকলেও অবাধে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ দুই চাকার মোটরসাইকেল।
আমাদের দেশে মোটরসাইকেল চালকদের বৃহৎ অংশ হচ্ছে কিশোর তরুণ ও যুবক যাদের বেশিরভাগ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া। অন্যান্য পেশার মানুষ যে নেই তাও নয়। ট্র্যাফিক আইন অমান্য করে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কিশোর তরুণ যুবকদের বেপরোয়া গতির গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে তাঁরা প্রাণ হারাচ্ছে, আহত বা পঙ্গু হয়ে পড়ছে এবং অন্যরাও সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অহরহ। জানা গেছে, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই ১৪ থেকে ৪০ বছর বয়সী। ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মতো মহাসড়কেও এখন অবাধে মোটরসাইকেল চলছে। অথচ অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় এটি অন্তত ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সব মিলিয়ে মোটরসাইকেলে ঝুঁকির মাত্রা সবসময়ই বেশি’। এবছরের মার্চে সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যে যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্রে দেখা যায়, শুধুমাত্র মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী হয়েছে ২২১ জন তা শতকরা হিসেবে (৩৭.৫২%)। যা জাতির জন্য গভীর দুঃখের উদ্বেগের এবং শঙ্কার।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ১৩টি সুপারিশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এগুলোর অন্যতম কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া; মাত্রাতিরিক্ত গতি সম্পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা; মহাসড়কে মোটরসাইকেলের আলাদা লেন তৈরি, গণপরিবহন উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা। এছাড়া দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো, গণপরিবহনের চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কের সার্ভিস রোড নির্মাণ করা, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সড়ক মহাসড়কে মফস্বল সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য ট্র্যাফিক ব্যবস্থা উন্নতকরণ, জন সচেতনতা বৃদ্ধি, ট্র্যাফিক বিআরটিএ সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি তদারকি নজরদারি করার গুরুত্ব অপরিসীম। সড়ক ও মহাসড়কে ক্রমবর্ধমান অনাকাক্সিক্ষত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বন্ধে অবিলম্বে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করার পাশাপাশি উচ্চ গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল আমদানি উৎপাদন বিপণন বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট