সুপারশপ থেকে টং দোকান সবখানেই চলছে তামাকের প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন

87

ওয়াসিম আহমেদ

নগরীর নাসিরাবাদ এলাকার সুপারশপ মিনা বাজারে ঢুকতেই ক্যাশ কাউন্টারের সম্মুখে একটি আলোকসজ্জিত ‘শো-কেস’। যেখানে তাকে তাকে সাজানো ব্যানসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেট (তামাকজাত দ্রব্য)। পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে ক্যাশ কাউন্টারে আসলেই শিশু, নারী, যুবক, বৃদ্ধা সবাইকে প্রলুব্ধ করছে বিজ্ঞাপনটি। আইন অনুসারে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়স্থলেও কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন করা যাবে না। তবুও এমন বিজ্ঞাপনের কারণ জানতে চাইলে মিনা বাজারের ম্যানেজার মো. নুরুল্লাহ পূর্বদেশকে জানান, ‘আমাদের ঢাকা অফিস থেকে নির্দেশনা রয়েছে সিগারেটের শো-কেসটি ওভাবে রাখতে। শুধু আমাদের আউটলেট নয়, সব আউটলেটেও রয়েছে। বাকি কিছু আমি জানি না।’
নগরীর অভিজাত খুলশি এলাকার আরেক সুপারশপ বাস্কেট। ২০১৯ সালের ১২ জুন, আইন না মেনে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রচার করায় এ সুপারশপকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপর কিছুদিন বন্ধ ছিলো। সম্প্রতি বাস্কেটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,শিশু কর্নারের পাশের তাকেই কফি জাতীয় পণ্যের তাক। সে তাকের উপর কাচের বাঁধাই করা শো- কেসে সিগারেটের পসরা। ভেতরে মিটিমিটি রঙিন আলোয় যে কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তামাকের বিজ্ঞাপনটি। বিষয়টি নিয়ে বাস্কেটের হেড অব অপারেশন অফিসার নিজাম উদ্দীনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন শুনে শো-কেসটি নামিয়ে ফেলার কথা জানান তিনি।
জানা গেছে, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালের সংশোধনীসহ) এ রয়েছে, ‘তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার অনুরূপ বা সদৃশ অন্য কোনো দ্রব্য বা পণ্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার উৎপাদন, বিক্রয় বা বিতরণ করিবেন না বা করাইবেন না। তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যে কোনো উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না।’ অর্থাৎ তামাকজাত দ্রব্যের প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন করা যেমন অপরাধ তেমনি পরোক্ষ কাউকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করানোও অপরাধ বলে গণ্য হবে। আইন থাকলেও আইনের সঠিক প্রয়োগ, মোবাইল কোর্টে লঘুদন্ডের কারণে তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু প্রতিদিনি তামাককে ছড়িয়ে দিতে নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে কোম্পানিগুলো। বিক্রেতা থেকে ভোক্তা সবাইকে বিজ্ঞাপন, পুরস্কার, নগদ অর্থ দিয়ে প্রলুব্ধ করছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সুপারশপে তামাকের শো-কেসগুলো প্রদর্শিত করার জন্য মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা দেয় তামাক কোম্পানি। এমনকি মোবাইল কোর্টে যা জরিমানা আসে তা পরিশোধ করে তামাক কোম্পানিগুলো। তাই কোনো ধরনের রিস্ক ছাড়া ব্যবসা হিসেবে তামাকের প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন চালিয়ে যাচ্ছেন সুপারশপের মালিকেরা।
অন্যদিকে রেল বা গাড়ির স্টেশন, গলির মোড়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা যেকোনো জনবহুল এলাকায় টং দোকানের অভাব নেই। যেখানে চা, সিগারেট বা হালকা নাস্তা বিক্রির কথা সবার জানা। কিন্তু প্রায় প্রতিটি টং দোকানের সামনে তামাক কোম্পানির প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনের শো-কেস থাকছে। তার বিপরীতে তামাক বিক্রির জন্য পুঁজি, টার্গেট পূরণে পুরস্কার মিলে তাদের। একইসাথে টং দোকানের মালামাল রাখার বক্সটি যোগান দেয় তামাক কোম্পানিগুলো। নগরীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে এমন চিত্রের দেখা মেলে। বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তামাকজাত পণ্যের কোম্পানিগুলো সিগারেট বিক্রির ওপর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, সেরা বিক্রেতাদের নাম তামাক কোম্পানির বিশেষ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, আকর্ষণীয় উপহার সামগ্রী প্রদান ও প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সরঞ্জাম, যেমন- বিছানার চাদর, আলমিরা, প্রেশার কুকার, রাইস কুকার, বেøন্ডার এবং বিলাসী সামগ্রী, সোনার কয়েন, এলইডি টিভি, এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ এবং দামি গিফট ভাউচার ইত্যাদি দিয়ে থাকে। এছাড়া কোম্পানিগুলো ডিলার, পাইকার এবং খুচরা বিক্রেতাদের উৎসাহ প্রদানের জন্য ডিনার ও দেশে-বিদেশে বিনামূল্যে ভ্রমণের ব্যবস্থাও করে থাকে।
সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ পূর্বদেশকে জানান, গত ২০ তারিখ আমরা একটি সভা করেছি। যেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে তামাক নিয়ন্ত্রণের আইনগুলো অবহতিকরণের। একে তো মানুষ জানে না, দ্বিতীয় বিক্রেতারাও সচেতন নয়। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে তিনটি টাস্কফোর্স রয়েছে। টাস্কফোর্সগুলোর কর্মকান্ড দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও এখন তিন মাস অন্তর মিটিং হবে, পূর্ববর্তীর সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রতিবেদন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলে প্রেরণ করতে হবে।’
জেলা প্রশাসনের নিয়মিত মোবাইল কোর্টে তামাক নিয়ন্ত্রণ অর্ন্তভুক্ত করা হবে জানিয়ে ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ আরও জানান, ‘এখন থেকে জেলা প্রশাসনের নিয়মিত মোবাইল কোর্টে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটিও প্রয়োগ করা হবে। তাহলে অনেকাংশে কমে আসবে।

বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রকাশ্যে তামাকের বিজ্ঞাপন আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’