সিআরবি : দুটি চাপা নিঃশ্বাস ও দায়মুক্তি

16

 

এক. অবিভক্ত ভারতের বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ের সদর দপ্তর নির্মাণ করা হয়েছে ১৮৯৫ সালে।শতবর্ষী রেইনট্রি আর বিভিন্ন পাহাড়, উপাত্যকা ঘেরা এ এলাকাটি সব ধরনের বয়সী সাধারণ মানুষের প্রাণ খুলে মুক্ত বাতাসে ঘুরতে আাসা মানুষের প্রাণকেন্দ্র হয়ে গড়ে উঠেছে। হাজার মানুষের বিরোধিতার পরও এখানে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি প্রাইভেট হাসপাতাল। সিআারবিতে বসবাসরত মানুষ এমনকি মুক্ত বাতাসে অক্সিজেন নিতে আসা মানুষ গুলো সিআরবিতে আর কোন হাসপাতাল চান না, এটা মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের কাছে পরিষ্কার। দেশের রোগীরা পুঁজিবাদ বুঝেন না। তার বুর্জোয়া, মাফিয়া এসব শব্দের সাথে পরিচিত নন। অথচ তাদের অসুস্থতাকে কাজে লাগিয়েই ফাইন্যান্সিয়াল সাফল্য হাতিয়ে নিতে চায় ইউনাইটেড গ্রæপ। সিআরবির গাছগাছালির সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। শত বছরের এই ঐতিহ্য লুন্ঠনে, এই ধ্বংসযজ্ঞ আয়োজনে রেলওয়ের জিএম, ডিজির উদ্যত আচরণ ও একের পর এক বক্তব্য রেখেই চলেছেন। আমি যতদুর জানি এই ইউনাইটেড গ্রুপ খুব ছোট থেকে আজ এই মহিরুহ হয়ে গড়ে উঠেছেন।তিন কিংবা চার জন বন্ধু মাত্র ত্রিশ হাজর টাকা করে পুঁজি বিনিয়োগ করে আজ এই শত কোটি টাকার মালিক।তাদের এ উত্থানে নিশ্চয় সততার গল্পও আছে।তাদের কাছে আমার করজোড়ে মিনতি- আপনার মিডিয়ায় চোখ রাখুন,খবরের কাগজ দেখুন, চট্টগ্রামের মানুষের মনের বেদনা বুঝতে চেষ্টা করুন। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের যে স্পিড মানি দিয়েছেন তা উগলে দিতে বলুন। আপনারা ফিরে যান সসম্মানে।
দুই. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এই সিআরবি ছিলো বিপ্লবের সূতিকাগার। আন্দোলনে শহীদদের কবর, শহীদদের নামে সড়ক সেই সব আজ ধোঁয়াশা, কেবল ইতিহাস মাত্র। আজ আমরা ভুলতে বসেছি ব্রিটিশ আন্দোলনের কথা। বিপ্লবী মহা নায়ক সূর্য সেনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই সিআরবি তে। এই মহানায়কের নেতৃত্বে অস্ত্র কেনার জন্য রেল কর্মচারীদের বেতনের সতের হাজার টাকা লুণ্ঠন করে তিনি কলকাতা পাঠিয়েছিলেন। সেই অগ্নি যুগে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিলো রেল।এই রেলে বিপ্লবীরা ছদ্মবেশে তাদের গোপন আক্রমণ শাণিত করতেন। সিআরবির রাস্তা পাহাড়ের গায়ে বিপ্লবীদের কত-শত পদচিহ্ন বিরাজমান তা ইতিহাসবিদরা লেখে গেছেন। এ যুগের রেলমন্ত্রী একটু ইতিহাস ঘাটলে বিপ্লবী সূর্য সেন আর প্রীতিলতাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাবেন। একবার আওয়াজ উঠেছিলো সিআরবিতে ‘মাস্টার দা সূর্যসেন চত্বর’ গড়ে তোলার কথা। কেন তবে সিআরবিতে ‘মাস্টার দা সুর্য সেন চত্তর’ আজো হয়ে উঠলো না? একটি কথা না বললে নয় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জে.এম. সেন হল প্রাঙ্গণে ১৯৭৫ সালের ১৮ ই এপ্রিল ‘চট্টগ্রাম বিপ্লবতীর্থ স্মৃতি সংস্থা’ কলকাতার উদ্যোগে মাস্টার দা সূর্য সেনের ব্রোঞ্জের আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। মাস্টার দার এ ভাস্কর্য ভারত থেকে আনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন, জে.এম সেন হলে স্থাপন, অনুষ্ঠানমালার এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি যুক্ত থেকে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এবার দাবী উঠুক সিআরবির এই ঐতিহাসিক অক্সিজেন ফ্যাক্টরিতে আর কোন হাসপাতাল নয় গড়ে উঠতে পারে- ‘বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টার দা সূর্যসেন চত্বর’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আপনার বাবার মতো আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়ে চট্টগ্রামবাসীর গভীর ভালোবাসায় হৃদয়ে থাকুন। আপনি নিশ্চয় জানেন, বন্দর নগরীর এই সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ কলোনিয়াল স্থাপত্যের নিদর্শনের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকলা।
নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য কিংবা ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা উপাদান হিসাবে বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ২য় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে এই এলাকাটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করেছে। আর যদি না করা হয়ে থাকে তাহলে আপনার আদেশে চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত এই সিআরবি কে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করুন। এই শতবর্ষীয়ান গাছ কেটে যে কোন ধরনের স্থাপনার হাত থেকে এই ঐতিহাসিক সিআরবি কে আপনি রক্ষা করুন।
লেখক: সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক