সিআরবি’র ইতিহাস-ঐতিহ্য সবুজ ভূখন্ড রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ বীর চট্টলা

34

 

ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রাম শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর ছিল। পাহাড় কেটে বনাঞ্চল ধ্বংস, প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় গুরুত্বপূর্ণ খাল-নদীর-পাড় দখল করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করে বন্দর নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে প্রতিনিয়তই ধারাবাহিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছে। গত পাঁচ বছরের চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের একটি পরিসংখ্যান- ২০১৫ সালে ৩টি, ২০১৭ সালে ১১টি, ২০১৮ সালে ১৫টি, ২০১৯ সালে ২৮টি, ২০২০ সালে ৮৩টি এবং ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৯টি পাহাড় কাটার প্রকৃত নজির রয়েছে। (সূত্র- পরিবেশ অধিদপ্তর)। এতো তথ্যের পরও চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যমÐিত সবুজ ভ‚খÐ সিআরবি নিয়ে অর্থ পিশাচদের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের সিআরবি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক স্থান। এ স্থানের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট কোনভাবেই চট্টগ্রামবাসী মেনে নিতে পারবে না। কারণ শত শত বছরের বৃক্ষরাজি, শান্ত পরিবেশ, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রামের নান্দনিক এই হেরিটেজ ও পরিবেশ ধ্বংস করা মানেই চট্টগ্রাম নগরবাসীর ফুসফুস ছিড়ে ফেলা। দেশ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের অনুকূলের জন্য বনাঞ্চলের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বনাঞ্চলের বিদ্যামান না থাকলে পৃথিবী মরুভূমি হয়ে উঠত। যার ফলশ্রæতিতে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হতো। পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্যই বজ্রপাতের সময় মানুষ প্রাণ হরাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চট্টগ্রামে রেলওয়ের ভূমিতে পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এ ৫০০ শয্যার হাসপাতাল এবং ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য আহুত আইএফবি (ইনভাইটেশন ফর বিট) নোটিশে সিআরবি’র এই নির্দিষ্ট এলাকার নাম ছিল কিনা চট্টগ্রামাবাসী জানার অধিকার রাখে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর তৃতীয় সপ্তাহেই আইএফবি আহŸান করা হয়েছিল। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) এবং প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষরিত এই নোটিশে সিআরবির নির্দিষ্ট নাম ছিলই না। কে বা কারা, কোন ক্ষমতাবলে বা কিসের লোভে পরিকল্পিতভাবে সুকৌশলে সিআরবির ছয় একর ভূমি ঢুকিয়ে ইউনাইটেডের সাথে চুক্তি করা হলো। বীর চট্টগ্রামবাসী ঐতিহাসিকভাবে সাহসী, প্রতিবাদী এবং ঐক্যবদ্ধ। ২০০৮ সালে প্রকাশিত গেজেট প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সিডিএ (ডিএপি) ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের মাধ্যমে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সিডিএর মাস্টার প্ল্যানেও সিআরবি এলাকাটি ‘হেরিটেজ এন্ড কালচার’ হিসেবে চিহ্নিত। প্রকৃত অর্থে আইন অনুযায়ী প্রাকৃতিক ঐতিহ্যবাহী জায়গা হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ ‘ক’ এবং ২৪ অনুচ্ছেদ কর্তৃক সংরক্ষিত বিধায় জায়গার আকৃতি, প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলো অবগত থাকার পরও কিভাবে এমন পদক্ষেপ নিল তা বোধগম্য নয়। প্রথমত: ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইন (দ্যা এর্টিকুইটি অ্যাক্ট) এর বিধান অনুযায়ী বিশেষায়িত অঞ্চল। দ্বিতীয়: সিআরবি এলাকা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত। তৃতীয়ত: দ্যা প্রটেকশন অব দ্যা ওয়ার্ল্ড কালচারাল এন্ড ন্যাচারাল হেরিটেজ কনভেনশন ১৯৭২ অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষিত এলাকার অধিভুক্ত। চতুর্থত: চাকসুর সাবেক জিএস শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রবসহ রেলের তৎকালিন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গণকবর। “হাসপাতাল নির্মাণ করার জন্য চিহ্নিত ভূমিতে রয়েছে”।
রেলওয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রেলের ভূমি সংরক্ষণ করার দায়িত্ব। তারা সোজা পথে না হেঁটে, উল্টো কিসের বিনিময়ে রেলের ভূমি অন্যদের দখলে দিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গত কারণেই দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে আন্দোলন করতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের বৃহৎ অঞ্চল রেলের মালিকানায় রয়েছে। পূর্বপুরুষের কাছে শুনা সিআরবির মূল ভবনটি একসময় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিল। সিআরবি পাহাড়ের ভবনের স্থাপত্যশৈলী সমূহ পর্যবেক্ষণ করলে ব্রিটিশ-বাংলার প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসের হাসি-কান্নার শব্দ শুনা যাবে। সিআরবি এলাকার সৌন্দর্য্যরে প্রশংসায় বিদেশীরা ‘বিউটি কুইন অব দ্যা ইস্ট’ উল্লেখ করে চট্টগ্রামের নাম দিয়েছিল। হাসপাতাল মানুষের সেবার জন্যই করতে হয়। আর যে হাসপাতাল মানুষ চায় না- সেটা কখনো কি হাসপাতাল হতে পারে? সুদীর্ঘ বছরের নান্দনিক ঐতিহ্য ও বিনোদনের উপজীব্য ধ্বংস করে কখনো চট্টগ্রামবাসী মানুষের গলাকাটা মার্কা হাসপাতাল মেনে নেবে না, নিতে পারবেই না। বিশাল বৃক্ষরাজির ঢালে ঢালে কত শত শত পাখির আবাস এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ দেশের অন্যান্য শহরগুলো থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। সিআরবি এলাকাটি নগরবাসীর জন্যই কেবল স্বস্তিদায়কই নয়, বরং এটি জীববৈচিত্র্যের অনন্য আধার। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ৭০ লক্ষ মানুষের মুক্ত অক্সিজেনের জায়গা, সাংস্কৃতিক ও উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র, ধনী-গরিবের মিলনমেলার স্থান ধ্বংস করা যায় না। ইউনাইটেড হাসপাতাল নির্মাণে গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের অর্থাৎ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোন উপকারেই আসবে না। তাই এই হাসপাতালের নাম দিয়ে দেশের অন্যতম হেরিটেজ সিআরবিকে ধ্বংস করার অপকৌশল কোনভাবেই গ্রহণ করা যায় না। চট্টগ্রামবাসী বসবাসের অযোগ্য নগরী চায় না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা কি রেখে যাচ্ছি? “রূপবতী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গাছ-পাহাড় কেটে- ইট-পাথরের স্থাপনা সিআরবিতে নয়”।
আসুন ইতিহাস সম্পর্কে নির্বিকার না হয়ে ইতিহাসের এই সকল উল্লেখযোগ্য দিকগুলো বাস্তবসম্মত পর্যালোচনার মাধ্যমে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প বাতিল করার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব।
লেখক: প্রধান সমন্বয়কারী, পর্যটন শিল্প উন্নয়ন ফোরাম