সাহিত্য চর্চায় নারীর ভূমিকা ও নানা প্রতিবন্ধকতা

236

এদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে একটি বিরাট অংশজুড়ে নারীদের অবস্থান। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষেত্রে নারী তাদের অবদান রেখে যাচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে নারীদের অবস্থানও পোক্ত হচ্ছে। সেই বেগম রোকেয়ার পর থেকে শুরু করে আজ অবধি নারীরা শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বার বার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এক সময় বাল্য বিবাহ একটি সাধারণ ও মামুলী ব্যাপার ছিল। আমাদের নানী, দাদী, মা, খালা, বড় বোনদের সেই বাল্য বয়সে বিবাহ হয়েছে। লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাল্য বিবাহ হচ্ছে। মেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এর মধ্যে অনেক নারী সাহিত্য চর্চার সাথে জড়িত। ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের মেধার পরিচয় দিচ্ছে। নারীদের এই অবস্থানের পেছনে আমাদের নারী ভাষা যোদ্ধাদের অবদান অনেক। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির আগে ও পরে অনেক নারী ভাষা সৈনিক নিজের অবস্থান থেকে আন্দোলনে ছিলেন। কুমিল্লার এক সংগ্রামী নারী ছিলেন অধ্যাক্ষ লায়লা নুর। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার পদচারণা ছিলো প্রশংসনীয়। ১৯৪৮ সাল থেকে বায়ান্নর সব আন্দোলনেই তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারীর পর ছাত্রজনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য সকল ছাত্রীদের আহ্বান জানালে তিন (৩) জন নারী একাত্ম ঘোষণা করেন। তারা হলেন সুফিয়া খাতুন, রিজিয়া খাতুন ও রবি। ভাষা আন্দোলনে আরেক অগ্রনী নারী হচ্ছেন ড. সুফিয়া আহমেদ। আরেক নারী ভাষা সৈনিক ড. শরীফা খাতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারণে ২০/২১ জন ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। ভাষা সৈনিক সংগ্রামী অধ্যাপক চেমন আরা সক্রিয়ভাবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৪৮ সালে প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। আরেক ভাষা সংগ্রামী নারী রওশন আরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’-এই স্লোগানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ৪জন নারী ভাষা সৈনিকের মিছিল হয়। সেই মিছিলে জুলেখা, নুরী, সেতারা ও হালিমা খাতুন ছিলেন। ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে নারী ভাষা সৈনিকদের ভূমিকা চিরদিন অম্লান থাকবে। নারী ভাষা যোদ্ধা ও ভাষা সৈনিকদের পথ অনুসরণ করে যে নারীরা সাহিত্য চর্চার সাথে জড়িত তাদেরকে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত এই ক্ষেত্রেও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। বিশেষ করে একটি পরিবারের সব কিছু সামলিয়ে নিজেকে সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত করতে একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। সময়-সুযোগ স্থান বের করতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। ‘যে নারী লেখালেখি করতে চায়, তার দরকার কিছু টাকা, আর নিজের একটি ঘর’- প্রায় ৯০ বছর আগে এ কথা লিখেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ। এই নিজের ঘরটা আসলে কী? একটা চার দেয়ালে ঘেরা কক্ষ, যেখানে বসে একজন নারী লিখে চলেছেন নিজের মনে? নাকি তাঁর একান্ত কিছু সময়, নিজের কিছু ভাবনা, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষের বা সমাজের তৈরি করে দেওয়া নয়। ভার্জিনিয়া বহুবার আক্ষেপও করেছেন এই বলে-কত জেন অষ্টিন হারিয়ে গেছেন শুধু নারী বলে, নারীর লেখালেখি কোথাও কোনোখানে মর্যাদা পেল না বলে, অথবা নারী নিজেই তার স্বীয় লেখাসত্তাকে মূল্য দিল না বলে। নারীরা সাহিত্য চর্চা করবে- এইটি মেনে নিতে অনেকেই এগিয়ে আসে না। আমাদের দেশে অনেক বড় বড় পুরুষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আছে। কিন্তু নারীদের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য নেই। সেই বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে রিজিয়া রহমান হয়ে আজ অবধি নারীরা শিক্ষা প্রসার ও সাহিত্য বিকাশে নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে আসছে। সারাদেশে অনেক নারী লেখক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেমন: শাহীন আখতার, শারমীন তানিয়া, আফসানা বেগম, তাসনুভা অরিন, ফাতেমা আবেদীন, রিমঝিম আহমেদ, শাওন আজিম, অঞ্জল দত্ত, সাদিয়া মেহজাবীন ইমাম, অদিতি ফাল্গুনী, রুমা মোদক, আফসানা বেগম, ফজিলাতুন্নেসা শাপলা, রাফেয়া আবেদীন। সময়-সুযোগ-সাহায্য-সহযোগিতা পেলে আরো অনেক নারী সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসতেন। যেই হারে শিক্ষার হার বাড়ছে সেই হারে নারীদের সাহিত্য চর্চা বাড়ছে না। ২০১৮ সালে ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ক্যামিলা শামসি বলেন, সাহিত্য পুরস্কার, বইয়ের সমালোচনা, প্রকাশনা, ইত্যাদি সবখানেই নারী-পুরুষে বৈষম্য আছে। ইংল্যান্ডে লন্ডন রিভিউ অব বুকস পত্রিকায় বছর জুড়ে যে রিভিউ করা হয় তার মাত্র ২৬ শতাংশ নারীদের লেখা নিয়ে। অথচ নারী লেখকরা নানান প্রতিকুলতায় তাদের লেখালেখি চালিয়ে যান। পুরুষ প্রাধান্যের এই লেখালেখি জগতে নারী লেখকদেরকে প্রতিদ্বন্দি¦তায় নামতে হয়। তবুও তাদের বার বার প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়। ব্রিটেনে বিশ^ সাহিত্য অনুদিত বইয়ের মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী লেখকদের। ১০ বছর ধরে বুকার পুরস্কার পাওয়া লেখকদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ হলেন পুরুষ। অথচ ব্রিটেনে সর্বাধিক জনপ্রিয় সেরা ১০ লেখকদের তালিকায় ৯ জনই নারী। সংসার, সন্তান, ক্যারিয়ার, সামাজিক দায়দায়িত্ব সব সামলে শেষ পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে নিতে হয়। এক একটি লেখা সম্পন্ন করতে নারীরা তাদের সব মেধা-শ্রম-ভালবাসা ব্যয় করে থাকেন। একটি লিখাকে ছাপানোর অবস্থানে নিয়ে যেতে নারীদের ঘাটে ঘাটে পুরুষের সাহায্য নিতে হয়। আমাদের দেশে এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য নারী টাইপিং নেই। হাতের লেখা সম্পদগুলো কম্পিউটারে টাইপ করতে অনেক নারীকে অন্যের দারস্থ হতে হয়। আবার লেখাগুলো প্রুফ রিডার দিয়ে ঠিক করে আবার কম্পিউটারে সম্পূর্ণ নির্ভুল করে সেই সম্পদগুলোকে বের করতে হয়। এরপর নিজে গিয়ে, অন্যের সাহায্যে ও ই-মেইলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। এরপর কোন পুরস্কারের জন্য সেই লেখা যাচাই-বাছাই করে পাঠাতে গিয়েও নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মত পুরুষশাসিত এই সাহিত্য সম্ভারে ও বাজারে নারীরা অনুচ্চারিত, অনুল্লেখ্য, অসমালোচিত থেকেই গেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সাহিত্য চর্চ্চাগুলো পুরুষ দ্বারা শাসিত ও শোষিত। পদক প্রাপ্তি, পুরস্কার প্রাপ্তি ও স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে নারীদের যোগ্যতা-দক্ষতা-মেধা-মনন-সাহিত্যভান্ডারকে মূল্যায়ণের মাপকাঠিতে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। মুখোমুখি হতে হয়। পুরুষশাসিত সাহিত্য জগতে আগে থেকেই নারী লেখকদের খানিকটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। নারী লেখরা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। আমাদের নারীরা সব দিকের মত সাহিত্য চর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এ বছরের বই মেলায় অনেক নারী লেখকের বই প্রকাশিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে। ২০২০ মুজিব বর্ষ উপলক্ষে একুশে বই মেলায় নারী লেখকদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও গবেষণাধর্মী অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু মেলা আয়োজক কমিটির কাছে মোট কতজন নারীর কতটি বই প্রকাশিত হয়েছে তার আলাদা কোন পরিসংখ্যান নেই। সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে তুলনায় অনেক কম হলেও নারী লেখকদের অগ্রগতি ও ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। বিভিন্ন ষ্টলে নারী লেখকরা নিজের লেখার বইটির প্রচার-প্রসারে শ্রম দিচ্ছে। বর্তমানে কয়েকটি নারী প্রকাশকের প্রকাশনী থেকে অনেক বই বেরিয়েছে। আমাদের নারী প্রকাশকরা স্বীয় অবস্থানে সম্মান ও প্রশংসার দাবিদার। প্রথমা প্রকাশনের নতুন ১০০টি বইয়ের তালিকায় নারী লেখকদের বইয়ের সংখ্যা ৫টি। বাতিঘর থেকে প্রকাশিত বইয়ের দীর্ঘ তালিকাতেও নারী লেখকদের সংখ্যা হাতে গোনা। অন্যন্যা প্রকাশনীর মধ্যেও তেমন উল্লেখযোগ্য নারী লেখকের বই প্রকাশিত হয় নাই বল্লেই চলে। নেতিবাচক সমালোচনার কারণেও অনেক নারী লেখক প্রকাশনার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে যান না। সাহিত্যের এই বিশাল আঙ্গিনা থেকে অনেক সময় ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার সম্মুখিন হতে হয়। সাহিত্য ও প্রকাশনার জগতে এখন সুস্থ বাজার নেই। ভালো পাঠক নেই। ভালো সমালোচনা নেই। বর্তমানে নারী পাঠকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রীদের অনেকেই দেশ-বিদেশের লেখকদের বই পড়ছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন দেশের ও ভাষার বই পড়ে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীরা নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও নারীদের কন্ঠে উজ্জীবিত গল্পগুলো এখনো প্রেরণার উৎস। নারীদের সাহিত্য চর্চাকে আরো সহজ করে তোলার জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম