সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় ২১ বিশেষ অঙ্গীকার

48

টানা দশ বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ তোলার পর এখন তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে সম্পৃক্ত করে সেই পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি এসেছে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে। দলটির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেলে তার দল ‘টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ নিশ্চিত করবে। এটাই তাদের এবারের অঙ্গীকার।
২০০৮ সালের ‘দিনবদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ এর পর আসন্ন ৩০ ডিসম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’।
প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান, গত দশ বছরের অর্জন এবং আগামী দিনের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ধরে সাজানো হয়েছে ৮০ পৃষ্ঠার এই ইশতেহার।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এই ইশতেহার ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা, যিনি গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের সরকার পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ইশতেহারের শুরুতেই আওয়ামী লীগের ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলোতে তারা জোর দেবে আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেলে।
বিশেষ অঙ্গীকার : প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ; তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর; কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ; নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা ও শিশু কল্যাণ; পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা; সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল; মেগা প্রজেক্টসমূহের দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন; গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা; দারিদ্র্য নির্মূল; সকল স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি; সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি; সকলের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা; সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা; আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থার লক্ষ্য যান্ত্রিকীকরণ; দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন; জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা; ব্লু-ইকোনমি-সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন; নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা; প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও অটিজম কল্যাণ; টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। খবর বিডিনিউজের
লিখিত ইশতেহারে বলা হয়, আমরা বিভেদ, হানাহানি, জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস, অবরোধ বিশৃঙ্খলার রাজনীতি চাই না। চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আমরা জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি।
আওয়ামী লীগ বলছে, জনগণের রায়ে আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশ থেকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি নির্মূল করে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে সুসংহত করবে। সমাজের সকল পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতায়নে তারা বদ্ধপরিকর।
সেবামুখী দক্ষ জনপ্রশাসন ও জনহিতৈষী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তুলে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের জন্য শান্তিশৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা বিধান করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
আবার ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ যা করবে : সর্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করা করা হবে। নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পেলে আগামী ৫ বছরে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে জনবল নিয়োগ করা হবে।
জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির প্রতি আমাদের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হবে।
আগামী ৫ বছরে জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫ হাজার ৪৭৯ ডলারেরও বেশি।
প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করব। শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেব। আগামী ৫ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। পাকা সড়কের মাধ্যমে সকল গ্রামকে জেলা/উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।
প্রতিটি উপজেলায় ‘যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের তথ্য সম্বলিত একটি ইন্টিগ্রেটেড ডাটাবেইজ তৈরি করা হবে।
তরুণদের সুস্থ বিনোদনের জন্য প্রতিটি উপজেলায় গড়ে তোলা হবে একটি করে ‘যুব বিনোদন কেন্দ্র’। প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘যুব স্পোর্টস কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলা হবে।
আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজন করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। প্রতি উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার যুব/যুব মহিলাকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।
বাল্যবিবাহ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করবে তারা। নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আলাদা ব্যাংকিং ও ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
দারিদ্র্যের হার ১২.৩ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।
প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজনের নিয়মিত রোজগার নিশ্চিত করা হবে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে। সহজ শর্তে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আয়বর্ধকমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা হবে।
ছোট ও মাঝারি আকারের দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামার প্রতিষ্ঠা এবং মৎস্য চাষের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনমত ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতি সহায়তা বৃদ্ধি করা হবে।
২০২০ সালের মধ্যে সকলের জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং ৫,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হবে।
পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে আধুনিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আইটি শিল্প পার্ক স্থাপন করা হবে।
প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে ১০০টি উপজেলায় এ ধরনের ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলছে।
নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের বেতন গ্রেডসহ শিক্ষাখাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়ে গেছে, তা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিরসন করা হবে।
১ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের উপরে সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। সকল বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালু করা হবে। দেশের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোকে আধুনিকায়ন করা হবে। আগামী ৫ বছরে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে।
মহাসড়কের পাশে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের নিরপত্তার জন্য আন্ডারপাস/ওভারপাস র্নিমাণ করা হবে। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করার জন্য যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ করা হবে।
দেশের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা, ইতিহাস বিকৃতি রোধ এবং প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিতকরণ, শহিদদের নাম-পরিচয় সংগ্রহ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে।
কোরান-সুন্নাহ বিরোধী কোনও আইন করা হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির যেসব ধারা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চর্চায় সাংবাদিকদের উৎসাহ প্রদান ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
ইশতেহারের শেষে বলা হয়েছে, আসুন আমরা সবাই মিলে এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে মানুষের মৌলিক সব চাহিদা পূরণ নিশ্চিত হবে, গড়ে উঠবে সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, যার যার ধর্ম পালনে স্বাধীনতা ও সম-অধিকার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, তরুণদের শ্রম ও মেধার সৃজনশীল বিকাশ, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণ, দূষণমুক্ত পরিবেশ। গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ-রাষ্ট্র।
জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে আওয়ামী লীহের ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠান শুরু হয় । পরে আওয়ামী লীগের শাসনমালের উন্নয়নের বিবরণ তুলে ধরা হয় তথ্যচিত্রের মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির আহব্বায়ক সাংসদ আব্দুর রাজ্জাকের স্বাগত বক্তব্যের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তারপর মঞ্চে এসে ইশতেহার ঘোষণা শুরু করেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, কূটনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।