সত্যিকারের গণমানুষের নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

103

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু; বিশেষ একজন মানুষ। একজন মানুষের ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়। এই কঠিনতর বিষয়কে তিনি সহজবোধ্য করেছিলেন। নিজের কর্মগুণে গণমানুষের চোখের মণি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন। নিজেকে উজার করেছেন চট্টগ্রাম তথা দেশের জন্য। এই বিশেষ মানুষকে নানা বিশেষণে উপস্থাপন করা যায়। তিনি নানা অভিধায় পরিচিতজন। বাবুভাই ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান, শিল্পপতি ও দানবীর। চট্টগ্রামের রাজনীতির কিংবদন্তী রাজনীতিক এই কৃতিপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ৩ মে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামে। ছাত্রজীবন থেকে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবেসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি রাজনীতি করেছেন মানুষের জন্য। জনগণের কল্যাণের জন্য। তাঁর কাছে দলের চেয়েও বড় ছিলো চট্টগ্রামের মানুষজন। যেখানে দল-মত-বর্ণ তাঁর কাছে সমান্তরালে থেকেছে। প্রকৃতই তিনি ছিলেন চট্টল দরদী, চট্টলার অভিভাবক।
জনদরদী আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আওয়ামী রাজনীতিতে পরীক্ষিত নেতা। সার্বক্ষণিকভাবে আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে দলের দুর্দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। পরিচ্ছন্ন রাজনীতির বরপুত্র হিসেবে তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে, একথা নিঃশঙ্কে বলা যায়। এদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটা জুপিটার হাউস থেকেই সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পরে জুপিটার হাউস থেকেই সাইক্লোস্টাইল করে প্রচারিত হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সবখানে পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ভারতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়া মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক জনমত ও জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তিনি বিশ্বজনমত গড়তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গমন করেন। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। রাজনীতিতে তিনি গড়ে তুলেন বর্ণিল জীবন এবং অনবদ্য এক ক্যারিয়ার। রাজনীতিতে তাঁর দান ও অবদানের কথা কোনোভাবে ভুলে থাকার নয়।
তিনি ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়ে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দল পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। এছাড়াও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কারাভোগসহ নানা নির্যাতনের শিকার হন। স্বাধীনতার পর তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে বহাল ছিলেন। সাংগঠনিকভাবে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ১৯৭০, ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমার মনে এখনো দগদগ এবং জ্বলজ্বল করছে। বাবুভাই তৃতীয় বারের মতো বিপুল ভোটে সাংসদ হন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি প্রথম সংবর্ধিত হন আনোয়ারা উপজেলার জুঁইদন্ডী ইউনিয়ন থেকে। জে.কে.এস উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। মহান এই ব্যক্তির সাথে এখানেই আমার প্রথম সরাসরি দেখা এবং কথা বলার সূচনা হয়। তিনি তখন থেকেই আমার চোখে দেখা সৌখিন এবং রুঢ় বাস্তবতার একজন মানুষ। ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পরেই তিনি জুঁইদন্ডী ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ও জুঁইদন্ডী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক এবং প্রধান অতিথি হয়েছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিলো আমার উপর। বক্তব্য দেয়ার জন্য যখন তাঁর নাম ঘোষণা করি, তখন তাঁর ব্যাপারে বিশেষ বিশেষণ উচ্চারণ করতেই তিনি স্বভাবসুলভে বলেন- ‘পাম বেশি ন’দিইঅ’। এ কথার পর আমার মনে হয়েছিলো, তাঁর ব্যাপারে আর বেশি কিছু বললে বিলকুল ক্ষেপে যাবেন। তবুও আবেগ আমাকে বিরত রাখতে পারেনি। আমি আমার মতো করে তাঁকে সম্বোধন করেছিলাম সেদিন। আমি মনে করি, ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর কাছে শেখার অনেক কিছুই রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মী হতে শুরু করে সাধারণ জনগণের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন তিনি। তাঁর সাথে কথা বলতে এসে কাউকে কখনো হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়নি। ন্যায় ও ইতিবাচক কাজে তিনি একদিকে উদার ও সরলতার পরিচয় দিলেও অন্যদিকে অন্যায় ও অন্যায্য কাজের ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে প্রভাব ও প্রতাপের অধিকারী হয়েও তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
রাজনীতিতে অবদান আর সাধারণ মানুষের জন্য দান করা তাঁর ছিলো রুটিন ওয়ার্ক। মানুষের প্রয়োজনের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে দান করতেন। আর্থিক অস্বচ্ছল ব্যক্তি থেকে শুরু করে অনেক রুগ্ন শিল্পপতিকেও তিনি নবজীবন দান করেছিলেন। সাধারণ অনেক মানুষকে তিনি স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। এই বিশেষ গুণের কারণে শুধু চট্টগ্রাম নয় সারা দেশে তিনি দানশীলতায় ‘বাবুমিয়া’ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনি দেশবরেণ্য স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিলো- রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কল্যাণে পর্যাপ্ত কাজ করা যায় এবং তাদের মনে ঠাঁই পাওয়া যায়। তাই তিনি ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ রাজনীতি ও জনসেবায় ব্যয় করতেন। তাঁর মৃত্যু পরবর্তী ৪টি জানাযায় লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ ও জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব তাঁর জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করে। সংসদে শোক প্রস্তাবের উপর গৃহীত বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেদিন দেশ ও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘আমি অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিকে দেখেছি কিন্তু বাবু ভাইয়ের মতো দুই হাতে টাকা বিলি করতে কাউকে দেখিনি। তাঁর মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবার নয়।’
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু শুধু ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান থেকে একদিকে যেমন লাখ আদর্শিক কর্মীর জন্ম হয়েছে, তেমনি দুর্দিনে-দুঃসময়ে দিশা পেয়েছে আপামরজনতা। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একটি বিপ্লবের নাম, একটি সংগ্রামের নাম, দিশেহারা জাতির ঠিকানা। ’৭৫ পরবর্তীতে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা, নিকটাত্মীয় ও শুভাকাক্সক্ষীদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস যুগিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে হারানো গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মেধা, শ্রম, অর্থ ও সাহস দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন। সামরিকশাসক জিয়াউর রহমান ও স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাঁকে মন্ত্রীত্ব দেয়ার প্রস্তাব দিয়েও দলে ভিড়াতে পারেননি। সময়ে সময়ে লোভনীয় প্রস্তাব তাঁকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। শুধু রাজনীতিবিদ হিসেবে নয় বরং ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি সফল মানুষ। তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট, দুই মেয়াদে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট, ১৯৮৯ সালে ৭৭ জাতি গ্রæপের তিনিই একমাত্র বাংলাদেশী; যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান, ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান আমলে তিনি বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও অসংখ্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায়ও তিনি অবদান রাখেন। তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ায় (কর্ণফুলী) বহু মসজিদ, মাদরাসা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সারাজীবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে ধারন এবং প্রতিপালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে যুক্ত থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। তাঁর মতো ত্যাগী নেতা ও আদর্শবান ব্যক্তির অভাব কোনোভাবে অন্বিত হওয়া সম্ভব নয়। এমন নেতার জন্ম বারবার হয় না। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের সাহসী সন্তান। সত্যিকারের রাজনীতি যে জনসেবা তার প্রমাণ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। হাজারো ত্যাগী, পরিশ্রমী ও সৎ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর প্রতিচ্ছবি হয়ে বেঁচে থাকবেন পৃথিবীর প্রলয় পর্যন্ত। গণমানুষের এই নেতা ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর অজস্র মানুষকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। আগামীর রাজনীতিকদের জন্য রেখে যান শিক্ষনীয় নানা বিষয়। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যে স্পেস তৈরি করে গেছেন, সেই শূন্যতা পূরণে রেখে গেছেন যোগ্য উত্তরসুরী। তাঁর সুযোগ্য পুত্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন এবং এদেশের একজন সফল মন্ত্রী হিসেবে চট্টগ্রামের সুনাম বাংলাদেশ তথা বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ে তাঁর যুগান্তকারী পদক্ষেপে একদিকে যেমন হচ্ছে আধুনিকায়ন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ হয়রানি ও বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাচ্ছে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, আনোয়ারা প্রেসক্লাব