সংলাপ ও সার্চ কমিটি নিয়ে যত কথা

16

পূর্বদেশ ডেস্ক

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি যে সংলাপ করছেন, তা কোনো সমাধান নয় বলে মনে করে বিএনপিসহ নিবন্ধিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাই বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন এসব রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাদের মতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ বা মতবিনিময় কার্যত ‘আনুষ্ঠানিকতা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। সংলাপের মাধ্যমে নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। এর আগে দুবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এবারও ব্যতিক্রম কিছু ঘটার সুযোগ নেই।
ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বিএনপি। গত ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে এখন পর্যন্ত ১৪টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন গঠনে এই সংলাপের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিবি, এবং ইসলামি আন্দোলনও আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
সংলাপ অর্থহীন : বিএনপি বলছে, এই সংলাপের মাধ্যমে সার্চ কমিটি নাটক করে যে কমিশন হবে তা সরকারের পছন্দেরই হবে। আর তারা মনে করেন আগে নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে তা ঠিক করতে হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না।
গতকাল শনিবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আরমগীর বলেন, আমরা তো এই সংলাপকে অর্থহীন মনে করছি। আমরা মনে করি, বর্তমান যে রাজনৈতিক সঙ্কট, সেই সঙ্কটটা নির্বাচন কমিশন গঠনের সঙ্কট নয়। আর আইন তৈরি করারও সঙ্কট নয়। প্রধান যে সংকট সেটা হলো, নির্বাচনকালীন কোন রকম সরকার থাকবে? সেটাই হচ্ছে প্রধান সঙ্কট।
তিনি বলেন, যদি আওয়ামী লীগ সরকারে থাকে তাহলে তো এই নির্বাচনের কোনো মূল্যই হতে পারে না এবং কোনো অর্থই হতে পারে না। অবশ্যই আমরা যেটা বলেছি, নির্বাচনকালীন একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার থাকতে হবে। যারা নিরপেক্ষভাবে একটা ইসি গঠন করে তাদের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে বুধবার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, বিগত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিয়ে তাদের মতামত দিয়েছিল। বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে সুস্পষ্ট প্রস্তাব লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছিল। কিন্তু সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচনকালীন আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেআইনি ব্যবহার, নির্বাচন কমিশনের চরম ব্যর্থতা, অযোগ্যতার কারণে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের দলীয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পরপর দুটি নির্বাচন কমিশনই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপি বিশ্বাস করে- নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার ব্যতিরেকে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কোনো নির্বাচন কমিশনই অনুষ্ঠান করতে পারবে না। রাষ্ট্রপতি নিজেই বলেছেন, তার কোনো ক্ষমতা নেই পরিবর্তন করার। সেই কারণে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ কোনো ইতিবাচক ফলাফল আনতে পারবে না। বিএনপি অর্থহীন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করবে না বলেও তিনি জানান।
চলমান সংলাপ তামাশা মাত্র : নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে চলমান সংলাপ একটি তামাশা মাত্র দাবি করে গণফোরামের একাংশের নেতারা বলেছেন, এই সংলাপের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব হবে না।
গতকাল শনিবার সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী লিখিত বক্তব্যে বলেন, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ এক যুগসন্ধিক্ষণে। এই ক্রান্তিকালীন সময়ে মৌলিক প্রশ্ন উঠেছে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত যে গণতান্ত্রিক, অসা¤প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ আজ কোথায়? গণতন্ত্র নিখোঁজ। সা¤প্রদায়িক অপশক্তি ফণা তুলেছে। শোষণ, দুর্নীতি ও বৈষম্য বাংলাদেশকে গ্রাস করেছে। মানবাধিকার নেই, জনগণের সরকার নেই।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান। তিনি সংবিধানের তৃতীয় তফসিল ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ নিয়েছেন, ‘আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব।’ ১১৮ অনুচ্ছেদের উল্লেখিত নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি তার শপথ যথার্থভাবে পালন করছেন কিনা সে প্রশ্ন যে কোনো নাগরিক উত্থাপন করতে পারেন।
গণফোরামের এই সিনিয়র নেতা আরও বলেন, সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত ‘সংলাপের নাটক’ বাংলাদেশে ইতোপূর্বে দুবার অনুষ্ঠিত হয়েছে, প্রথমবার ২০১৪ সনে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে ও দ্বিতীয়বার ২০১৮ সনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সাহেবের সঙ্গে।
তিনি বলেন, এই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে গণফোরাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বস করে, বর্তমান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে চলমান সংলাপ একটি তামাশা মাত্র। যার মাধ্যমে কোনো কাক্সিক্ষত নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব নয়।
সংলাপে যাবে না সিপিবি ও ইসলামী আন্দোলন : নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ রক্ষায় অপরাগতা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও ইসলামী আন্দোলন ।
নতুন জাতীয় নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি সোমবার (৩ জানুয়ারি) সিপিবিকে আমন্ত্রণ জানান।
গতকাল শনিবার (১ জানুয়ারি) সিপিবি কর্তৃক রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠানো চিঠিতে এ অপারগতার বিষয়ে জানানো হয়।
এতে বলা হয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন থাকা একান্তভাবে প্রয়োজন। কিন্তু অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সেটাই যথেষ্ট নয়। নির্বাচন ব্যবস্থার মৌলিক গলদ দূর করতে না পারলে অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। এ মৌলিক বিবেচনা থেকে সিপিবি নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্য ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ সহ ৫৩টি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের সুপারিশমালা ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আপনার কাছে প্রদান করেছিল। এ অবস্থায় হুবহু একই আলোচ্য সূচিতে ও একই প্রকরণের আরেকটি সংলাপে যোগ দিয়ে সিপিবির নতুন কোনো কথা বলার নেই। সে কারণে তাতে যোগদান করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি না।
অপরদিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির আহŸানে চলমান সংলাপে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম। গতকাল শনিবার দুপুরে পুরানা পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মুফতি রেজাউল বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে দেশের চিন্তাশীল মহল, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ জনগণের মাঝে আমরা কোনো আগ্রহই দেখতে পাচ্ছি না। বরং জনগণ মনে করছে, রাষ্ট্রপতির সংলাপে ফলপ্রসূ কিছু হবে না। অতীতের দুটি সংলাপ যেমন জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, চলমান সংলাপেও এর ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে জনগণ মনে করে না। অতএব, জনগণের আকাক্সক্ষার বিপরীতে গিয়ে এমন একটি আবেদনহীন ও তাৎপর্যহীন সংলাপে অংশ নেওয়াটা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সঙ্গত মনে করে না।
সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না : নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান।
তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা রাজনৈতিক দ্ব›েদ্বর মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না। সরকারের পছন্দের তালিকাভুক্ত লোক দিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।
কে এম নূরুল হুদা কমিশন আইনের সঠিক প্রয়োগ করে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা ও ভালো নির্বাচন করতে পারতো, যা বাস্তবে হয়নি, বলেন আকবর আলী খান।
গতকাল শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে স্থানীয় সরকার নেই। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই স্থানীয় সরকার চলছে। স্থানীয় সরকারের আর্থিক ক্ষমতা নেই। এখানে জনপ্রতিনিধি ও কর্মচারীদের বেতন কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে আসে। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকার এতিম নয়, বরং তা এত বেশি ক্ষমতাশালী যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। আবার স্থানীয় সরকারের সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা হওয়ার নিয়ম একমাত্র বাংলাদেশেই আছে। স্থানীয় সরকারের অনিয়ম ও অভিযোগের তদন্ত করে থাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। অথচ এ ধরনের তদন্তের জন্য স্বাধীন কমিশন থাকা উচিত। অতীতে একটি কমিশন থাকলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন করতে হলে বর্তমান আইন পরিবর্তন করতে হবে।
এদিকে সরকারবিরোধী দলগুলোর একাধিক সূত্র বলছে, রাষ্ট্রপতির সংলাপ থেকে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের আশা তারা করছে না। বরং সার্চ কমিটিতে কারা থাকছেন এবং পরবর্তী সময়ে এই কমিটি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে কতটা গুরুত্ব দেবে, এর ওপরই রাজনৈতিক পরিবেশ নির্ভর করছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদপূর্তির আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ যে সংলাপ শুরু করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ, তবে যথেষ্ট নয়। শুধু সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন পদ্ধতিতে ইতোপূর্বে কাক্সিক্ষত ইতিবাচক ফল আসেনি। তাই নির্দলীয়, সৎ ও গ্রহণযোগ্য ইসি নিয়োগে অবিলম্বে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
উল্লেখ্য, আগামী ১৪ ফেব্রæয়ারি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ১৫ ফেব্রæয়ারি নতুন কমিশনকে দায়িত্ব নিতে হবে।