শোকাবহ আগস্ট

59

আগস্ট শোকের মাস, বাঙালি জীবনের বেদনার মাস। রক্তের আখরে লেখা, চির শোক-কষ্টের এ মাস আবার এসেছে। এ মাসে প্রত্যয় ও শপথে শোককে শক্তিতে পরিণত করার অভয়মন্ত্রে আবার উদ্দীপিত হবে বাঙালি জাতি। আগস্ট বাঙালির চেতনার ধমনিতে নতুন করে সাড়া জাগায়। বীর বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কিত এক অধ্যায় সূচিত হয় এ মাসেই। তাই এ মাস নতুন করে ভাবতে শেখায়। এ মাস প্রতিশোধের চেতনায় শানিত করে সবাইকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন। সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।
আগস্ট এলেই তাই মনে পড়ে যায়, সেই ভয়াবহ স্মৃতি। যা আমাদের বেদনায় সৃৃষ্টি করে নতুন করে যন্ত্রণার। যে বিশাল হৃদয়ের মানুষকে কারাগারে বন্দি রেখেও স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, অথচ স্বাধীন বাংলার মাটিতেই তাঁকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সেই ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আজও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। জাতির জনককে পিতাকে হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি বছরের পর বছর বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারিণী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। রক্তের ভেতরেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি শেখ হাসিনার। রাজনীতিতে নামার অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। পিতা জাতির মুক্তিদাতা। স্বাধীনতার স্থপতি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর কন্যা। এ পরিচয়ই তো অনেক বড়। এ পরিচয়েই তারা পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। শোকের সাগর মাড়িয়ে তাকেই কিনা হাল ধরতে হলো ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণের। আগস্ট মাস এলেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এক দুঃসহ স্মৃতির গহীনে চলে যান।
১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল সৈন্যের হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের দু’জন বাদে সকলেই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নিষ্ঠুর শোকের ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। কারণ তারা দেশে ছিলেন না। মহান আল্লাহ পাকের অপার করুণা তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেন, সেনানিবাস থেকে ট্যাংক বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা হলো। সৈন্যসহ ট্যাংক রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দিয়ে সদর্পে এগিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতির বাড়ি ঘেরাও করল। ঘাতকের গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হলো বাংলার সূর্য সন্তানের হৃদয়। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জাতির জনকের বুকের তাজা রক্ত কালিমা লেপন করল ইতিহাসের পাতায়। পূর্বপরিকল্পিত কষা ছকে এত কিছু ঘটে গেল। অথচ ঘুণাক্ষরেও টের পেল না রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত তৎকালীন গোয়েন্দা বাহিনী।
এটা কি শুধুই গোয়েন্দা ব্যর্থতা নাকি তারাও জড়িত ছিলেন? এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বক্তব্য হচ্ছে, তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা বাহিনী ভূমিকা পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। একের পর এক এতকিছু ঘটে গেল কিন্তু কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ লোক দেখানো এগিয়েছেন। কিন্তু কার্যত যাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা তারা তখন কি করছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐ শুধু একটি খুনের ঘটনা নয়, এর পেছনে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতার রদবদল ঘটিয়ে পাল্টে ফেলা হয়েছে বাংলাদেশের মূল সাংগঠনিক কাঠামোকে। ক্ষমতা পাল্টানোর সহজ উপায় হিসেবে কুচক্রী মহল এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি কখনো কাম্য ছিল না। পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে মিল রেখে এই ঘটনার পটভূমি রচিত হয়েছিল। তারা শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছিল। সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক সরকার নিয়ন্ত্রিত, রাজনৈতিক সরকারকে কখনো সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটাই গণতন্ত্র। ইতিহাসের কালো অধ্যায় থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের সুবাতাস।
গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এত কিছু ঘটে গেল নাকি তারাও জড়িত ছিল সেটাই এখন দেখার বিষয়। যারা সরাসরি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐে জড়িত ছিল তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা নেপথ্যে থেকে হত্যার সমস্ত ইন্ধন যুগিয়ে গেল তারা বিচারের আওতার বাইরে থেকে গেল। এতদিন ধরে এসব ষড়যন্ত্রকারী দেশের ভিতরে আছে এবং তারা এখনো ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হবে।
তৎকালীন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান মুক্তিযোদ্ধা বা দেশে অবস্থানকারী কর্মকর্তা ছিলেন না। তিনি পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন হয়ে এসেছিলেন। তাই তার ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমন ব্যর্থতাও স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের মতো ন্যক্কারজনক অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে হলে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়া সব অপরাধীকে। তাতেও যদি কিছুটা কলঙ্কমুক্ত হয় জাতি।