শোকাবহ আগস্ট

49

কলঙ্কের কালিমালিপ্ত রক্তস্নাত আগস্টে পিতা হারানোর শোক ও বেদনায় ভারাক্রান্ত বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক-মজুর-মেহনতি-ছাত্র জনতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এখনও আশা করে, সুজলা-সুফলা ও শস্য-শ্যামলা এই ভাটি-বাংলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি আরেকবার ফিরে আসতেন! একাত্তরে পরাধীনতার শৃংখল মুক্তির সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে এক কাতারে নিয়ে আসা এ মহান নেতার প্রয়োজন যেন বাঙালি জাতির কাছে কখনোই ফুরোবার নয়। ফুরোবেই বা কী করে! সবচেয়ে কলংকময় হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়েই তো একাত্তরে স্বাধীনতার প্রশ্নে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতির ঐক্যের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে ঘাতকরা। সেই থেকে বাঙালির রক্তে প্রবাহিত হওয়া বিভক্তির জোয়ার সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। দেশ ও জাতির জন্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যুতে আর বাঙালি আর এক হতে পারে নি। অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাই একবিংশ শতাব্দীর অগ্রসরমান বাংলাদেশেও সমান প্রয়োজনীয়তা নিয়েই জাতির সামনে হাজির হচ্ছেন।
বাঙালি জাতির সর্বজনীন ঐক্যের সর্বশেষ প্রতীক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে বিভক্তির অব্যর্থ বীজ রোপিত হল বেদনাময় আগস্টে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিগত সাড়ে চার দশকে যার শেকড় বিস্তৃতি লাভ করেছে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র। তবে, শতসহস্র বিভক্তির মাঝেও দেশের ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন পর্যন্ত একটি বিষয়ে একমত পোষণ করেন, তা হল বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ঐক্যের সর্বশেষ প্রতীক। তাক লাগানো সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ও প্রগাঢ় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পরমতসহিষ্ণু এমন নেতার জন্ম বাঙালি জাতির ইতিহাসে আর ঘটেনি। জন্ম হবে কিনা সেই ভবিষ্যবক্তাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার বহু মত ও পথকে একই বিন্দুতে মিলিয়ে দেয়ার অসীম ক্ষমতা আর বুক চিতিয়ে অধিকারের কথা বলার অমিত সাহস বাঙালি জাতিকে দিয়েছে বীরের মর্যাদা। শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তর্জনী উঁচিয়ে লড়াই-সংগ্রামের ডাক দেয়ার মানসিক দৃঢ়তা বাঙালি শিখেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই। আর এসব কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তি থেকে নেতা এবং নেতা থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকেও বাঙালি জাতি আরেকজন বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পায়নি। যিনি দেশ ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন ও দর্শনকে বুকে ধারণ করে বিশ্ব পরিমÐলে জাতিকে মর্যাদার আসনের দিকে নিয়ে যাবেন। তাই বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে যে মহাশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ার পথেই হেঁটে চলেছে।
ডিজিটাল বিশ্বায়নের কালে এসে বর্তমান প্রজন্ম এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বহুধাবিভক্তির এক নষ্ট সংস্কৃতির অংশ হয়েই বেড়ে উঠছে। পরাজিত শক্তির দুর্ভেদ্য নিশানা বারবার দেশ ও জাতিকে পেছন দিক থেকে টেনে ধরতে চাইছে। স্বার্থবাদী ও ভোগবিলাসী অগ্রজরা সবকিছুকেই কেমন যেন গিলে খেতে উদ্যত। নীতি ও আদর্শকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে চাটুকারিতা আর কম সময়ে বিত্তশালী বনে যাওয়ার কু-শিক্ষা নতুন প্রজন্মকে গ্রাস করতে চাইছে। সাহস করে অধিকারের কথা বলার মুখগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশ ও জাতিকে নিংড়ে খেয়ে আপন বিত্তের পরিধি বাড়ানোর অদম্য প্রতিযোগিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দেয়া-নেয়ার রকমারি সংস্কৃতি দূরদর্শী কিংবা সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আর এসব কারণেই স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরে এসেও বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত খাঁটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মাটি ও মানুষের নেতা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক।