শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক

4

অধ্যক্ষ আব্বাস উদ্দিন আনোয়ারী

১৮৭৩ সালের চাব্বিশে অক্টোবর বরিশাল জেলার ঝালকাটিতে (বাকেরগঞ্জে) জন্মগ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তাঁর পিতা কাজী ওয়াজেদ আলী ব্রিটিশ ভারতের প্রাজ্ঞ দেওয়ানি ও আইনজীবী ছিলেন। মাতা সায়েদুন্নেসা খাতুন। দাদা আরবী,ফারসি ও উর্দু ভাষার পÐিত ছিলেন। সে সুবাদে পারিবারিকভাবে এ.কে ফজলুল হক কোরআন, হাদিস এর জ্ঞানেও যথেষ্ট পাÐিত্য অর্জন করেন। ১৮৮১ সালে বরিশাল জেলা স্কুলে তিনি ভর্তি হন। এরপর ১৮৮৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে সর্বাধিক নম্বর নিয়ে পাস করে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে কলকাতায় চলে যান। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাস করেন। ১৮৯৪ সালে ¯œাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। গণিত,পদার্থ ও রসায়নে ট্রিপল ডিগ্রি আলাদা আলাদা অর্জন করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ কে ফজলুল হক ফুটবল, দাবা, সাঁতারসহ খেলাধুলার প্রতি ছোট বেলা থেকে পরম আসক্ত ছিলেন।
তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি তিনজন মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১ম জন খুরশিদ বেগম। এ ঘরে দু’জন কন্যা সন্তান ছিল। ২য় বিবাহ হয় পশ্চিম বঙ্গের হাওড় এলাকার জান্নাতুন নিসার সাথে। এ ঘরে কোনো সন্তান ছিল না। ৩য় বিবাহ করেন ভারতের উত্তর প্রদেশের মিরাট এলাকার খাদিজার সাথে। এ ঘরে একজন মাত্র পুত্র সন্তান হয়। যার নাম হল আবুল কাশেম মুহাম্মদ ফয়েজুল হক। যিনি একাধারে সাংবাদিক,আইনজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন।
১৮৯৭ সালে আইন শাস্ত্রে জীবনের শেষ ডিগ্রি অর্জন করে কলকাতা ও ঢাকা হাইকোর্টের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় আইন সভায় যোগদান করেন। ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯০৩-১৯০৪ সালে তিনি বরিশাল বার এসোসিয়েশনে সহ-সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯০৬ সালে আইন পেশা ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করে ঢাকা ও ময়মনসিংহে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। তবে সরকারি চাকরি তাঁকে তুষ্ট করতে পারেনি। তাই সরকারি চাকরি ছেড়ে আবার আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯১৯ সালে পান্জাব হত্যাকাÐের তদন্ত কমিটির নির্বাহী সদস্য মনোনীত হন। উল্লেখ্য, ১৯১৯ সালে বহুল আলোচিত পান্জাব হত্যাকাÐে চিত্তরন্জন দাস, মতি লাল নেহেরুসহ অনেকে নিহত হন। কলকাতা বার কাউন্সিলের সদস্যসহ ৪০ বছর তিনি কলকাতা হাইকোর্টে সুনামের সাথে আইনি পেশায় কাজ করে ভারতের জাতীয় আইন পরিষদ কর্তৃক বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বাঙাালি কূটনীতিক হিসেবে স্বীকৃতি পান। আম জনতার মাঝে তিনি শেরে বাংলা নামে পরিচিত ছিলেন। সংসদ সদস্য পদ গ্রহণসহ ১৯৩৫ সালে কলকাতার মেয়র, ১৯৩৭ সালে বাংলার প্রধানমšী¿, ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। এছাড়াও যুক্তফ্রন্ট এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।
তিনি ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ ভারতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক ছিলেন। স্যার সলিমুল্লাহ এবং সৈয়দ নওয়াব আলীর হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। তিনি জীবনের ৫০ বছরের অধিক সময় ব্যয় করেন অবিভক্ত ভারতের মুসলমানসহ সর্বমানবতার কল্যাণে। ১৯১১ সালে কলকাতায় তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করেন স্যার সলিমুল্লাহ। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ ভারতে চরম অবহেলিত কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেন। ১৯১৬ সালে মৌলভী মোহাম্মদ আলী জুহুরের মৃত্যু হলে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের’ চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত হন। মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠিত করতে নিরলস পরিশ্রম করেন। তাঁর অশেষ অবদানে দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হলে এর সম্পাদক করেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমদকে এবং সহ-সম্পাদক করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে । ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে তাঁর সুনাম ও খ্যাতি সর্বভারতে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে। শেরে বাংলা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালায়,ঢাকা, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালায়,ঢাকা, শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম,ঢাকা ও শেরে বাংলা নগর,ঢাকা তাঁর নামেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তাঁর নামে বহু হল ও মিলনায়তন। যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তাঁর নামে হল। এক কথায় তাঁর নামে গড়ে উঠা বিভিন্ন শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাঁকে আজীবন স্মরণীয় করে রাখবে। তিনি কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। ‘বেঙ্গল টুডে’ এর মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ। অসাধারণ কর্মকীর্তিই তাঁকে আজীবন স্মরণীয় করে রাখবে। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল এ মহান মনীষী মৃত্যুবরণ করেন। লক্ষাধিক মানুষ জনপ্রিয় এ মানুষের জানাজায় শরীক হয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবরস্থানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী ও খাজা নাজিমুদ্দনের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। সত্যিকার অর্থে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ছিলেন জনহিতৈষী রাজনীতিবিদ। লেখক : গবেষক ও শিক্ষাবিদ